লেখাটি কোথা থেকে শুরু
করব জানি না। আসলে একটা মুগ্ধতার ঘোর কাটতে সময় তো লাগেই, তার চেয়েও বেশি লাগে
ইচ্ছে। আসলে আমার ইচ্ছেই করছে না ঘোর কাটাতে। বইটির নাম 'প্যাস্টোরাল সিম্ফনি' /
অঁদ্রে জিদ। মূল ফরাসী থেকে অনুবাদ করেছেন তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী। ফরাসী ভাষায় আমার
বিদ্যের দৌড় ওই হিব্রু আর সোয়াহিলির মতই। তাই ইন্টারনেট ঘেঁটে La
Symphonie Pastorale অক্ষরমালায় শোভিত শব্দগুচ্ছ নিয়ে ভাবতে
বসলাম। এটি আসলে বিঠোভেন-এর এক বিখ্যাত সিম্ফনির নাম। আবার এই নামটি
উপন্যাসিকাটিরও নাম। অভিধান ঘেঁটে যদি বাংলা করতে হত তাহলে 'যাজকীয় স্বরসংগতি'
গোছের কিছু দাঁড়াত। তাতে নামটির সুরেলা আভাসটিও বিলীন হত। নামটি ইংরিজিতে রাখাই
বরং শ্রেয়তর হয়েছে। অঁদ্রে জিদ নোবেল পেয়েছিলেন সাহিত্যে সেই আমাদের স্বাধীনতা
পাবার বছরে। নোবেল পুরস্কার দান করার সময় সুইডিশ অকাদেমি তাঁর লেখায় “দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি ও সত্যের প্রতি নির্ভীক
ভালবাসার তুলিতে মানুষের জীবনের সমস্যাগুলি তুলে ধরার নৈপুণ্যের” কথা বিশদে
প্রশংসা করেছিলেন। এসব কথাও সাহিত্যের পাঠকের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু এসব বাহুল্য
ছেড়ে যদি উপন্যাসিকাটির ভেতরে প্রবেশ করি পাঠক, সেটিই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আম খেতে
এসে আমগাছের পাতা গোনে শুধু আহাম্মকেরাই। সে ছিল এক আশ্চর্য সময়! গত শতকের প্রথম
দিককার কথা বলছি। জিদের এই উপন্যাসিকাটির কাহিনি মোটামুটি সে সময়কারই ১৯১৯ সালে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে তার আগের বছরেই। এক পাদ্রীর, মানে খৃষ্টান ধর্মে যারা
প্যাস্টর বলে জ্ঞাপিত তাঁর কাহিনি। প্রোটেস্ট্যান্ট খৃষ্টানদের এই প্যাস্টরেরা
শুধু দীক্ষাই দেন না, তাঁরা নিয়ত বাইবেল-নির্দিষ্ট পথে মানুষকে পরিচালিত
করার কাজ চালান। ধর্ম বলতে আমরা চিরকাল বুঝি ইন্দ্রিয় নিবৃত্তি ও ঈশ্বর কামনা।
সেটি সব ধর্মের ক্ষেত্রে সত্য। তবে হিন্দুদের সাধুরা যেমন সংসার বিরহিত ঈশ্বর ভজনা
করেন, ধারণাটি পুরোপুরি তেমন নয়। এ কাহিনিতে এই প্যাস্টর তাঁর ঈশ্বর পরিচালিত কাজ
করতে গিয়েই এক প্রণয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর স্ত্রী আছে, সন্তানাদি আছে তবু
তিনি জড়িয়ে পড়েন। কীভাবে মানুষের কল্যাণ করার আকাঙ্ক্ষা নিজের ভেতরকার
ইন্দ্রিয়সেবী মানবসত্তাকে জাগরিত করে দেয় সেটিই খোলাখুলি পাঠকের সামনে তুলে ধরেন
লেখক। আমাদের অনেকের ধারণা 'সাধু' ঘোষিত করে দিলেই তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিও 'সাধু' হয়ে
যায়। সে যে একেবারে মিথ্যে সেকথাই দেখা যায় কাহিনির পরতে পরতে। এমন দ্বন্দ্ব এবং
খুব রোজকার জীবনের রক্তমাংসের দোলাচলের ছবি লেখক আঁকেন পাঠকের সামনে। এরপর আমাদের
সাহস হবে তো কাউকে 'সাধু' বলে তাঁর কী কী করণীয় নয় বলে তার বিচার করতে? ইন্দ্রিয়
কি পুঁথিগত শুকনো নিয়ম মানতে পারে? না মানতে পারলে মানুষ কী করে? বিশেষ করে ধর্ম
কেন্দ্রিক মানুষেরা? তাদের সমস্যা তো আরও গভীর। কারণ তাঁরা 'সাধারণ' নন। আর 'অ-সাধারণত্বের' ভার যে কীনির্মম!
এবার আসি অনুবাদ প্রসঙ্গে। কারণ আমার পড়া অনুবাদেই। এতক্ষণ খেয়ালই হয়নি বিষয়টিকে যে অনুবাদ পাঠ করলাম। এতই সাবলীল কোনো কোনো অংশে তো একেবারেই মৌলিক তার মান। কিছু কিছু জায়গা বলি - “প্রত্যাদেশের ফলে পাপ আবার নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত হয়েছে” কিংবা “আমি নিজেকে পাপ-চিন্তার থেকে আরো ঊর্ধ্বে টেনে তোলার চেষ্টা করছি। অথচ পাপকে আমার অসহ্য মনে হচ্ছে। তাছাড়া আমি মোটেই যীশুকে পরিত্যাগ করতে চাই না। না জ্যার্থ্রুদের প্রেমে পড়ে আমি পাপকে বরণ করব না। কিন্তু হৃদয় থেকে ঐ প্রেমকে উপড়ে ফেলতে গিয়ে মনে হচ্ছে যেন হৃদয়টাই উপড়ে ফেলছি। কী কারণ তার? আমি যদি ওকে ভালো না-ই বাসি, অন্তত ওর প্রতি দয়ায় আমার ওকে ভালবাসা উচিৎ...।” দর্শনের অংশের অনুবাদ করা যে কত কঠিন তা যিনি করেন তিনিই জানেন। কারণ দর্শন বস্তুটিই খটমট। আর উপন্যাসিকাটির পাতায় পাতায় দর্শন ও জৈবিক টানাপোড়েনের কথা। অনুবাদ কতটা আত্মস্থ করলে এমন একটি কাজ করতে পারেন! বিশেষ প্রশংসার যোগ্য এর টীকাগুলি। আগ্রহীদের খুব সাহায্য করবে সেগুলি। বাঙালি পাঠককে অনুবাদ পড়তে বললে গায়ে জ্বর আসে। কারণ অনুবাদগুলি কখনওই অনুবাদকের জারণলব্ধ ফসল হয় না। এখানে সেটি একেবারেই অনুপস্থিত। উচ্চারণ সম্পর্কে বলি ইংরিজি ভাষার দাপটে কোনও দেশের নিজস্ব উচ্চারণের হদিশ পাওয়াই তো দুষ্কর! যেমন কিনা এ উপন্যাসিকার ইংরিজি ভার্সানে নায়িকার নাম Gertrude এখানে জ্যার্থ্রুদ পড়ে খুব আনন্দ পেলাম। স্প্যানিশ অনুবাদক হিসাবে ঠিক এই লড়াইটিও আমি করে চলি কিনা! ইংরেজের কল্যাণে দোন কিখোতে হয়ে যান ডন কুইক্সোট! পাঠকের মন থেকে পূর্ব ধারণা হটানো কি সোজা কথা! ব্যক্তিগত ভাবে আমি কৃতজ্ঞ বইটি যশোধরা রায়চৌধুরী আমার হাতে পড়তে তুলে দিয়ছেন বলে। এ লেখা না পড়লে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত বলে মনে করি। অনুবাদককে অন্তরের শুভেচ্ছা কাজটি করার জন্য।
প্যাস্টোরাল সিম্ফনি - অঁদ্রে জিদ
অনুবাদ - তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী
প্রকাশক - শব্দহরিণ
No comments:
Post a Comment