৩
মালওয়া উপজাতিদের দেশ মালওয়া প্রদেশ। মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ অংশের আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের পাথর জমে তৈরি এই মালভুমি পৃথিবীর প্রাচীনতম একটি জনপদ। ৪৭-এর আগে এর এক নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় ছিল। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের মালওয়া এজেন্সি মধ্য ভারত, যাকে মালওয়া ইউনিয়ন বলা হত, তার সঙ্গে মিশে যায়। রাজনৈতিক সীমারেখা বরাবরই ভঙ্গুর...একটি জনপদের রূপরেখা কী রাজনৈতিক ম্যাপ বলে দেয় না তার সাংস্কৃতিক প্রভাব? মালওয়ার ক্ষেত্রেও বারবার তাই ঘটেছে। মহাকবি কালিদাস আর লেখক ভারতিহরির দেশ এই মালওয়া নিজস্ব ও অনন্য নৈসর্গিক আর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে এই দেশের মুলধারার সংস্কৃতিকেই সিঞ্চিত করেছে হাজার হাজার বছর ধরে। আর লোকায়ত নাচগানের মাদকতা! অবনঠাকুরের রাজকাহিনির ভিল সর্দার আর শোলাঙ্কি রাজকুমারির ঝুলন খেলা হয়েছিল এই মালওয়ার কোন নাম না জানা পাহারের কোলে তা ভেবে রোমাঞ্চ হয়! সমুদ্র থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উঁচু এই মালভূমি দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে আনত। চম্বল নদী আর নানা শাখা ও উপনদী এর দক্ষিণ অংশকে স্নাত করেছে। পশ্চিমে মাহি নদী। চোখ বুজলেই রণঝংকার আর গুপ্ত কী মৌর্য যুগের কথাকাহিনির উজ্জয়িনী আর আজকের নব্য শহর ইন্দর। মাদকতা এর রক্তে...তাই আফিমের মৌতাত! একদিন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আফিম চাষ হত নাকি এখানে। মধ্যপ্রদেশের দিওয়াস, ধর, ইন্দর, ঝাবুয়া, মান্দসাউর, নিমাচ, রাজগড়, রাতলাম, সাজাপুর, উজ্জয়িনী, আর গুনা ও সেহরের কিছু অংশ, রাজস্থানের ঝালোয়ার জেলা ও বান্সাওয়ারান্দ আর চিত্তগড় জেলার কিছু অংশ মালওয়ারের ভেতর পড়ে। এর উত্তর-পুর্বে হাতোদি আর উত্তর-পশ্চিমে মেওয়ার। পশ্চিমে ভাগাড় আর গুজরাট। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের শিলায় তৈরি মালভুমিতে নানা উপজাতিদের বাস হাজার হাজার বছর ধরে। রাজস্থানী মারাঠি গুজরাটি লোকায়ত সংস্কৃতি একে পুষ্ট করেছে। যদিও এখন আর তেমন চল নেই হিন্দির দাপটে তবু মালওই বলে একটি আঞ্চলিক ভাষা আছে যা হয়ত বিলুপ্ত হবে তাড়াতাড়ি আরও অনেক আঞ্চলিক ভারতীয় ভাষার মতোই। যেমন ভুলতে বসেছি খ্রীষ্টপুর্ব ৫০০ বছর আগের অভন্তি রাজ্যের কথা। পঞ্চম শতকের গুপ্তযুগে মালওয়ার স্বর্ণযুগ ছিল। মধ্যযুগে মারাঠারাও বরাহমিহির আর ভোজ্ রাজের স্মৃতিচিহ্ন মাখা মালওয়া শাসন করেছে। সেই হারিয়ে যাওয়া জনপদ খুঁজে পাওয়া যাবেনা আজকের রাজনৈতিক ম্যাপে— জাতিগত বিদ্বেষে দীর্ণ এই দেশকে আজও খুঁজে পেতে হলে আমাদের লোকায়াত শিল্পের হাত ধরতে হয়— নাচে গানে ছবিতে তাদের দেশজ গন্ধে সব সীমারেখা মুছে যায়। সেখান থেকেই আসে লাভনি নাচের কথা।
লাভনির নাচনিরা মূলত দলিত সম্প্রদায়ের— ভাতু, কালোয়াত, কোলহাতি, মাহার, মাতাঙ আর ডোমবারি এইসব দলিত গোষ্ঠির লোক, অথচ সেই গানের গীতিকাররা বা শাহিরিরা বেশিরভাগ উচ্চবর্ণের লোক।এখানেই এই নাচের সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কৌম রাজনীতির সঙ্গে প্রথাগত শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত দলিত মেয়েদের নিজস্ব যৌনমুক্তি ও পুরুষতান্ত্রিকতাকে নস্যাৎ করার প্রয়াস। লাভনির সুত্র খুঁজতে গিয়ে ১৩ শতকের কাছাকাছি পৌঁছতে হলেও মুখ্যত ১৯ শতকের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পেশোয়াদের আর পশ্চিম মহারাষ্ট্রের মারাঠা শাসকদের আনুকুল্যে এর প্রচার ও প্রসার বাড়ে। পরবর্তীকালে মধ্যবিত্তের আমোদপ্রমোদের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর ফিল্মের মতো গণমাধ্যমেও নানা ভঙ্গীতে, কখনও বিকৃত রুপেও— লাভনি যৌনতার উদ্দামতাময় দ্বর্থ্যবোধক শব্দের জাদুতে, ঢোলকের আওয়াজ আর নাচনিদের পায়ের মলের দ্রুত তালে মাতাতে থাকে। যদিও ১৯৪৮-এ মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বালাসাহিব খেরের জমানায় লাভনি আর তামাশাকে ব্যান করা হয়, যা দুবছর পর তুলে নেওয়া হলেও ‘আন্ধারি লাভনি’ বা ‘অন্ধকারের লাবণ্য’কে বাতিল করা হয়। এই অন্ধকার হল মধ্যবিত্তের যৌনতার প্রতি বিরূপ ভাবনার দ্যোতক। সরকারের মত ছিল লাভনিকে ভদ্র হতে হবে। কী হাস্যকর এই প্র্য়াস। স্যানিটাইজড করার চেষ্টা হল লোকশিল্পের ডানা ছেঁটে। লাভনির গানের যেসব শব্দে সরাসরি যৌনতার কথা আছে, আছে যৌনক্রিড়ার ভঙ্গীর কথা, বা পুরুষের বহু নারীসঙ্গের ব্যাভিচার কী পুরুষত্বহীনতা নিয়ে অথবা যেখানে পুরুষতন্ত্রকে শ্লেষের সঙ্গে ব্যঙ্গ করা হয় যে গানে, সেই সব হল ওই ‘অন্ধকারের’ অংশ। নীতিবাগিশদের লাভনির দিকে আঙুল তোলা দেখে বিশ্বাস করা কঠিন যে এদেশেই খাজুরাহ কোনারক তৈরি হয়েছিল। কেবল যৌনতামাখা কথাই নয় আর পাঁচটা লোকশিল্পের মতোই সমাজের সকল সুখদুঃখের পাঁচালি বলা হত— জাত-পাত কী ধর্মীয় বিভাজন থেকে রাজনীতি এমনকী প্রেম ও যৌনতা কিছুই অচ্ছুত ছিল না। কখনও তা যেন তর্জার মতোও। ঢোলকের অসম্ভব দ্রুত তালে নাচনিরা নাচে আর শরীরের বিভঙ্গ বা নানান ঝটকা-মটকা, যার অক্ষম নকল করে মুম্বাই-সিনেমার কোরিওগ্রাফাররা।
সম্প্রতি জে এন ইউ’র গবেষক ও নৃত্যশিল্পি সেজেল যাদব এক সাক্ষাৎকারে তাই বলেছেন, “আমার গবেষণা চলাকালীন একটা ঘটনা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেছিলাম। আমি বেশ কিছু নাচনির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন একজন বলল, স্টেজে তাদের নাচে্র তালে যৌনভঙ্গি আনতে হবে তখন পুরুষ নাচিয়ে হস্তমৈথুনের ভঙ্গি করবে সর্বসমক্ষে। আমি রাগে ফুটছি একথা শুনে। কিন্তু নাচনিরা বলল প্রথম প্রথম এগুলো অসুবিধা করলেও আদপে তো এগুলো অভিনয় এবং সেটা চালিয়ে যেতে হবে। আমাকে অনেক নাচনিই বলেছে বার বার প্রশিক্ষণ নিয়ে এইসবে ধাতস্থ হয়ে যায় ফলত যাই ঘটুক অভিনয়টা চালিয়ে যেতে পারে। যেটা শুনে আমি লাভনির দলগুলো কতটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছে সে ব্যাপারে আবার পুর্নমূল্যায়ন করতে লাগলাম।” লাভনি নাচের নাচনি যেমন তাদের গানে দূরবর্তী প্রেমিকের জন্যে তার শরীরী কামনাকে মুক্ত কন্ঠে ব্যাক্ত করে তেমন এর মধ্যে বিচ্ছেদ দুঃখ বিপন্নতার কথাও বুনে দেয় কারণ এইসব দলিত মেয়েদের সেই পেশোয়ার সময় থেকে বেচা হয়েছে প্রায় বিনামূল্যের বেগারখাটা শ্রমিক হিসেবে আর যখন খুশি যৌন ইচ্ছা মেটানোর জন্যে। তাই উচ্চবর্ণজাত গীতিকারেরা গানের মধ্যে পেশোয়াদের আর মারাঠা শাসকদের যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটানোর সফল কারিগর হয়ে নিম্নবর্গের নাচনিদের সেভাবে গড়ে তুলেছে। এইসব নাচনিদের বিয়ে হত না। মঞ্চে মঞ্চে নেচে নেচে যৌবন বয়ে যেত। তাই নাচনিরাও নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজেছে নিজেদের মতো করে। যদিও আধুনিক সমাজে শেষমেষ ধিকৃত হয়েছে তারা। বিষয়টা ক্রমে আরও জটিল হয়ে ওঠে। বাবাসাহিব আম্মেদকরও লাভনির বিরুদ্ধে গেছিলেন, কারণ তার মতে উচ্চবর্ণের লোকেরা দলিত মেয়েদের লাভনির প্রসারের ছলে বেশ্যা বানিয়েছে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের সুইডিস পন্ডিত তোর আন্দ্রে বলেছিলেন “we need to become acquainted with great personalities of the world religions in those garments in which the pious faith of the followers have clothed them…something of the magic of their personalities which we might not understand in any other way, speaks to us through the poetry of faith”। লোকসাহিত্য ও সংষ্কৃতিকে যুগোপো্যোগী করার চেষ্টায় বা যুক্তিবাদের ঘেরাটোপে শুদ্ধিকরণ করতে গিয়ে যদি বাউল থেকে দেহতত্ত্ব বা বৈষ্ণব পদ থেকে রাধার প্রেমিক কৃষ্ণের অবতাররূপের বিশ্বাসকে হটিয়ে দিই তবে রসাস্বাদনের জন্য কী পড়ে থাকে? আর দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে লাভনির মতো লোকায়ত নাচের ধারা একটা রূপ পেয়েছে, তাকে বন্ধ করাটাই একমাত্র রাস্তা, নাকি দক্ষিণের দাসী-নাট্যমের মতো এর উত্তরণ ঘটবে তা নিয়ে এখন সেজেলের মতো অনেকেই বলছেন। বস্তুত দাসী-নাট্যমও মন্দিরের দেবদাসীদের নাচ এবং সেখানেও যৌনতার বিশেষ অংশ ছিল। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ও উদয়শংকরদের উদার চোখে তা স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তা ভারতীয় নাচের চিরায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলতে পেরেছে। লাভনিকে স্যানিটাইজ না করেই নাচনিদের অভিনয় কলাকে স্বীকৃতি দিয়ে ও তাদের শিল্পীর সম্মান দিয়ে কীভাবে মধ্যমেধার মর্যালিটির তোয়াক্কা না করে উন্নীত করা যায় তা নিয়ে অনেকেই এখন সরব হচ্ছেন। যে প্রধান প্রশ্নগুলো উঠে আসছে তা হল লাভনি কোথায় অভব্য বা অশালীন? কী করে পপুলার সিনেমাতে লাভনিকে ব্যবহার করেও শিল্পের আসন দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া শৃঙ্গারিক, আধ্যাত্মিক আর পোয়াড়া বা ব্যালাড লাভনির এই যে তিন ধারা তার মধ্যে কোনটাকে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে ও গেলে কীভাবে। এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এই ডিসেম্বরেই মুম্বাইতে গোদরেজ ইন্ডিয়া ক্লাবে লাভনি নিয়ে ওয়ার্কশপ ও অনুষ্ঠান হয়ে গেল। ডকুমেন্টরি ফিল্ম ‘নাটালে তুমচাসাথিতে’(সুশোভিত পর্দার আড়ালে) তাই এক নাচনি বলে, “লোকেরা ধ্রুপদী নাচের নাচিয়েদের সম্মান করে কিন্তু আমাদের করে না কেন?” গবেষক সাবিত্রী মেধাদুল ও ভূষণ কোরগাঁওকরের ‘সঙ্গীত বারি’ বলে ২০১৪-তে প্রকাশিত বইটিতে এইসব নাচনিদের নিয়ে অনেক বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। গত বছর তাঁরা শকুন্তলা নাগারকর, মোহনাবাই মহালঙ্গেরকর নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন, সেখানে শিল্পীরা নাট্যানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও নিজেদের জীবন নিয়ে বলেছেন। এবছর বিশিষ্ট মারাঠি নাট্য ব্যাক্তিত্ব সুষমা দেশপাণ্ডের লেখা ‘তিচিয়া আইচি ঘোস্ত আরহাত মাজহা আথভানিচা পাহাদ’ বা ‘এক মায়ের অভিনয়ের স্মৃতি’ শীর্ষক নাট্যরূপে রাজশ্রী সাওয়ান্ত ওয়াড় অভিনয় করেছেন।
লাভনির নাচনিরা মূলত দলিত সম্প্রদায়ের— ভাতু, কালোয়াত, কোলহাতি, মাহার, মাতাঙ আর ডোমবারি এইসব দলিত গোষ্ঠির লোক, অথচ সেই গানের গীতিকাররা বা শাহিরিরা বেশিরভাগ উচ্চবর্ণের লোক।এখানেই এই নাচের সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কৌম রাজনীতির সঙ্গে প্রথাগত শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত দলিত মেয়েদের নিজস্ব যৌনমুক্তি ও পুরুষতান্ত্রিকতাকে নস্যাৎ করার প্রয়াস। লাভনির সুত্র খুঁজতে গিয়ে ১৩ শতকের কাছাকাছি পৌঁছতে হলেও মুখ্যত ১৯ শতকের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পেশোয়াদের আর পশ্চিম মহারাষ্ট্রের মারাঠা শাসকদের আনুকুল্যে এর প্রচার ও প্রসার বাড়ে। পরবর্তীকালে মধ্যবিত্তের আমোদপ্রমোদের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর ফিল্মের মতো গণমাধ্যমেও নানা ভঙ্গীতে, কখনও বিকৃত রুপেও— লাভনি যৌনতার উদ্দামতাময় দ্বর্থ্যবোধক শব্দের জাদুতে, ঢোলকের আওয়াজ আর নাচনিদের পায়ের মলের দ্রুত তালে মাতাতে থাকে। যদিও ১৯৪৮-এ মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বালাসাহিব খেরের জমানায় লাভনি আর তামাশাকে ব্যান করা হয়, যা দুবছর পর তুলে নেওয়া হলেও ‘আন্ধারি লাভনি’ বা ‘অন্ধকারের লাবণ্য’কে বাতিল করা হয়। এই অন্ধকার হল মধ্যবিত্তের যৌনতার প্রতি বিরূপ ভাবনার দ্যোতক। সরকারের মত ছিল লাভনিকে ভদ্র হতে হবে। কী হাস্যকর এই প্র্য়াস। স্যানিটাইজড করার চেষ্টা হল লোকশিল্পের ডানা ছেঁটে। লাভনির গানের যেসব শব্দে সরাসরি যৌনতার কথা আছে, আছে যৌনক্রিড়ার ভঙ্গীর কথা, বা পুরুষের বহু নারীসঙ্গের ব্যাভিচার কী পুরুষত্বহীনতা নিয়ে অথবা যেখানে পুরুষতন্ত্রকে শ্লেষের সঙ্গে ব্যঙ্গ করা হয় যে গানে, সেই সব হল ওই ‘অন্ধকারের’ অংশ। নীতিবাগিশদের লাভনির দিকে আঙুল তোলা দেখে বিশ্বাস করা কঠিন যে এদেশেই খাজুরাহ কোনারক তৈরি হয়েছিল। কেবল যৌনতামাখা কথাই নয় আর পাঁচটা লোকশিল্পের মতোই সমাজের সকল সুখদুঃখের পাঁচালি বলা হত— জাত-পাত কী ধর্মীয় বিভাজন থেকে রাজনীতি এমনকী প্রেম ও যৌনতা কিছুই অচ্ছুত ছিল না। কখনও তা যেন তর্জার মতোও। ঢোলকের অসম্ভব দ্রুত তালে নাচনিরা নাচে আর শরীরের বিভঙ্গ বা নানান ঝটকা-মটকা, যার অক্ষম নকল করে মুম্বাই-সিনেমার কোরিওগ্রাফাররা।
সম্প্রতি জে এন ইউ’র গবেষক ও নৃত্যশিল্পি সেজেল যাদব এক সাক্ষাৎকারে তাই বলেছেন, “আমার গবেষণা চলাকালীন একটা ঘটনা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেছিলাম। আমি বেশ কিছু নাচনির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন একজন বলল, স্টেজে তাদের নাচে্র তালে যৌনভঙ্গি আনতে হবে তখন পুরুষ নাচিয়ে হস্তমৈথুনের ভঙ্গি করবে সর্বসমক্ষে। আমি রাগে ফুটছি একথা শুনে। কিন্তু নাচনিরা বলল প্রথম প্রথম এগুলো অসুবিধা করলেও আদপে তো এগুলো অভিনয় এবং সেটা চালিয়ে যেতে হবে। আমাকে অনেক নাচনিই বলেছে বার বার প্রশিক্ষণ নিয়ে এইসবে ধাতস্থ হয়ে যায় ফলত যাই ঘটুক অভিনয়টা চালিয়ে যেতে পারে। যেটা শুনে আমি লাভনির দলগুলো কতটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছে সে ব্যাপারে আবার পুর্নমূল্যায়ন করতে লাগলাম।” লাভনি নাচের নাচনি যেমন তাদের গানে দূরবর্তী প্রেমিকের জন্যে তার শরীরী কামনাকে মুক্ত কন্ঠে ব্যাক্ত করে তেমন এর মধ্যে বিচ্ছেদ দুঃখ বিপন্নতার কথাও বুনে দেয় কারণ এইসব দলিত মেয়েদের সেই পেশোয়ার সময় থেকে বেচা হয়েছে প্রায় বিনামূল্যের বেগারখাটা শ্রমিক হিসেবে আর যখন খুশি যৌন ইচ্ছা মেটানোর জন্যে। তাই উচ্চবর্ণজাত গীতিকারেরা গানের মধ্যে পেশোয়াদের আর মারাঠা শাসকদের যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটানোর সফল কারিগর হয়ে নিম্নবর্গের নাচনিদের সেভাবে গড়ে তুলেছে। এইসব নাচনিদের বিয়ে হত না। মঞ্চে মঞ্চে নেচে নেচে যৌবন বয়ে যেত। তাই নাচনিরাও নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজেছে নিজেদের মতো করে। যদিও আধুনিক সমাজে শেষমেষ ধিকৃত হয়েছে তারা। বিষয়টা ক্রমে আরও জটিল হয়ে ওঠে। বাবাসাহিব আম্মেদকরও লাভনির বিরুদ্ধে গেছিলেন, কারণ তার মতে উচ্চবর্ণের লোকেরা দলিত মেয়েদের লাভনির প্রসারের ছলে বেশ্যা বানিয়েছে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের সুইডিস পন্ডিত তোর আন্দ্রে বলেছিলেন “we need to become acquainted with great personalities of the world religions in those garments in which the pious faith of the followers have clothed them…something of the magic of their personalities which we might not understand in any other way, speaks to us through the poetry of faith”। লোকসাহিত্য ও সংষ্কৃতিকে যুগোপো্যোগী করার চেষ্টায় বা যুক্তিবাদের ঘেরাটোপে শুদ্ধিকরণ করতে গিয়ে যদি বাউল থেকে দেহতত্ত্ব বা বৈষ্ণব পদ থেকে রাধার প্রেমিক কৃষ্ণের অবতাররূপের বিশ্বাসকে হটিয়ে দিই তবে রসাস্বাদনের জন্য কী পড়ে থাকে? আর দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে লাভনির মতো লোকায়ত নাচের ধারা একটা রূপ পেয়েছে, তাকে বন্ধ করাটাই একমাত্র রাস্তা, নাকি দক্ষিণের দাসী-নাট্যমের মতো এর উত্তরণ ঘটবে তা নিয়ে এখন সেজেলের মতো অনেকেই বলছেন। বস্তুত দাসী-নাট্যমও মন্দিরের দেবদাসীদের নাচ এবং সেখানেও যৌনতার বিশেষ অংশ ছিল। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ও উদয়শংকরদের উদার চোখে তা স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তা ভারতীয় নাচের চিরায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলতে পেরেছে। লাভনিকে স্যানিটাইজ না করেই নাচনিদের অভিনয় কলাকে স্বীকৃতি দিয়ে ও তাদের শিল্পীর সম্মান দিয়ে কীভাবে মধ্যমেধার মর্যালিটির তোয়াক্কা না করে উন্নীত করা যায় তা নিয়ে অনেকেই এখন সরব হচ্ছেন। যে প্রধান প্রশ্নগুলো উঠে আসছে তা হল লাভনি কোথায় অভব্য বা অশালীন? কী করে পপুলার সিনেমাতে লাভনিকে ব্যবহার করেও শিল্পের আসন দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া শৃঙ্গারিক, আধ্যাত্মিক আর পোয়াড়া বা ব্যালাড লাভনির এই যে তিন ধারা তার মধ্যে কোনটাকে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে ও গেলে কীভাবে। এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এই ডিসেম্বরেই মুম্বাইতে গোদরেজ ইন্ডিয়া ক্লাবে লাভনি নিয়ে ওয়ার্কশপ ও অনুষ্ঠান হয়ে গেল। ডকুমেন্টরি ফিল্ম ‘নাটালে তুমচাসাথিতে’(সুশোভিত পর্দার আড়ালে) তাই এক নাচনি বলে, “লোকেরা ধ্রুপদী নাচের নাচিয়েদের সম্মান করে কিন্তু আমাদের করে না কেন?” গবেষক সাবিত্রী মেধাদুল ও ভূষণ কোরগাঁওকরের ‘সঙ্গীত বারি’ বলে ২০১৪-তে প্রকাশিত বইটিতে এইসব নাচনিদের নিয়ে অনেক বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। গত বছর তাঁরা শকুন্তলা নাগারকর, মোহনাবাই মহালঙ্গেরকর নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন, সেখানে শিল্পীরা নাট্যানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও নিজেদের জীবন নিয়ে বলেছেন। এবছর বিশিষ্ট মারাঠি নাট্য ব্যাক্তিত্ব সুষমা দেশপাণ্ডের লেখা ‘তিচিয়া আইচি ঘোস্ত আরহাত মাজহা আথভানিচা পাহাদ’ বা ‘এক মায়ের অভিনয়ের স্মৃতি’ শীর্ষক নাট্যরূপে রাজশ্রী সাওয়ান্ত ওয়াড় অভিনয় করেছেন।
(চলবে...)
codeflare.net services for money site, monetize a blog, backlink profile, SEO Analyst, internet business, money online, affiliate, tips & trick, tutorial, custom widget, landing page, digital marketing, online promoter, sales page, and web application.
ReplyDeleteWe simplify your online job for maximum results. Please, contact us 24/7 for more information and discount sales.
Landingpage blogger template
Free download premium landingpage blogger template
CodeFlare Blog
Campfire Project
CodeFlare Profile
Gratis download template landingpage blogger
Cara Membuat Sitemap Blog Untuk Mempercepat Index Blogspot
WhatsApp Button Code