ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday, 22 April 2018

নামহীন বেঁচে থাকা অথবা একটি গদ্য : সুমন সাধু

ছবি : Bernd Luz
"মৃত্যুর ভিতরে আছে অদ্ভুত সাঁতার! / সে দীঘির পার নেই, পারাপার নেই, / জীবন সম্পূর্ণ হবে শুধু মৃত্যুতেই, / মৃত্যুর ভিতরে আছে অদ্ভুত সাঁতার!"

বিস্ময়ে এ বোধের জন্ম হয় বারবার। বিকেল শেষের পর যখন নদীর ঘাটে গিয়ে বসি এই বিস্ময়সূচক চিহ্ন আমায় হনন করে, ভিতরের ক্লান্ত আমি একটা চূড়ান্ত সফরে বেরোই আরও একটু ক্লান্ত হব বলে। এই পথ চলার অবচেতনে একটা পাহাড়ের ছায়া আছে। যে ছায়া কখনো সখনো অনায়াসেই আশ্রয় দিতে পারে। বহুযোজন পথ অতিক্রম করে রচিত হয় কবিতার সত্যি,কবিতার মিথ্যে। একটা চিরন্তন গতি আমাকে প্রশ্রয় দেয়, অন্তরজালে বেঁধে রাখার প্রশ্রয়। আমরা রোজ সকালে বাজারে যাই, ক্রেতা হয়ে দর করি। শুকনো সবজির বদলে আসে টাটকা কিছু জিনিস। এক ব্যাগ দর কষাকষি নিয়ে বাড়ি ফিরে ক্রমশ সিদ্ধ হতে থাকে রোজকার সকাল। আরামে আয়েশে পাত পেড়ে যাই এবং দুপুরের অবশ্যম্ভাবী ঘুমে বাজারি ক্রেতার দামে স্বপ্ন মাখি, স্বপ্ন গিলি। নিজেকে বদলাতে দেখি, নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে ফেলি। এইরকম সমস্ত কিছুর বদল হওয়া মেনে নিতে পারি কি! কবিতা পড়তে পড়তে চারটে লাইন ক্রমশ অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। এই ইঙ্গিতটুকু আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই, ভুলে যাই অপরিণত বয়সের জীবন সম্পর্কে বোধ। "হাঁটার ভঙ্গিটি চাই বদলে দিতে / বসার ভঙ্গিটি চাই বদলে দিতে / বদলে দিতে চাই পদ্ধতিও, / বদলে নিতে চাই নিজে জন্মাবধি।"

নিজের মধ্যে একা থাকা আর সকলের মধ্যে একা থাকার তফাৎ বুঝি পরিণত বয়সে এসে। এক একজনের কাছে যা স্বভাব, অন্যের কাছে তা-ই স্বভাবদোষ। অতএব নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। শেষমেষ লেখার কাছে ফিরে আসি - একটু রাত বাড়লে আমি চলে যাব। তুমি হয়ত একা পড়ে থাকবে। মাছি এসে তোমার গায়ে বসবে ,গন্ধ শুঁকবে।...রোজকার মতো বাড়ি ফিরে শুকিয়ে যাওয়া চারাগাছটায় জল দেব। রোজকার মতো আমিও নিজেকে সুমন হয়ে যেতে দেখব।

হুবহু মিলে যাওয়া স্বপ্ন, যেখানে তর্কে মশগুল হই আমরা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা মাঝেমধ্যে স্বপ্নে এসে যায়, গাছের নীচে বসে থাকা বন্ধুদের খানিক তর্কও এসে জোটে। তর্কের মধ্যিখানে বন্ধুদের যেভাবে নিজের করে দেখতে পাই, সেভাবে নামহীন বেঁচে থাকাগুলো আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। বন্ধুদের হাত ধরে আমি হয়ে যাই সেই পাহাড়ের পথিক। এমতাবস্থায় ফিরে যাই 'পারফিউম' ছবির শেষ দৃশ্যের ছেলেটির কাছে। একের পর এক হত্যা যাকে ক্লান্ত করে রোজ। অথচ তীব্র একটা গন্ধ নিয়ে আরামে বেঁচে থাকা যায়, প্রেমে পড়া যায়, নিজেকে শাস্তি দেওয়াও যায়।
      
লুকিয়ে লুকিয়ে আমি শৈশবের ঘাটে বসি। মা'কে দেখি তেলেভাজা হাতে। আমি আলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকি, যতক্ষণ না আমার ছায়া আমাকেই অতিক্রম করে যাচ্ছে। লুকিয়ে লুকিয়ে আমি সদ্য মৃত বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বসি। বাহুজনিত খেলার পরবাস ছেলেমানুষীর উপরিস্থলে হানা দেয়। "শৈশব হল সেরকম একটা গানের মতো, যেটা আমারই শুধু মনে পড়ছে।" এখানে ইচ্ছাপূর্বক আমিটিকে বসাই। নতুন করে পাড়া বেপাড়া ঘুরি। ক্লাসরুমের ডাস্টার ক্রমশ টেবিলে ঠুকি। নিজেকে মনে করার জন্য এসব উপলক্ষমাত্র। বেমালুম মিথ্যে হয়ে যাওয়া ভিড়ের চাপে আমি বড় হয়ে যাই, আরও বড়। একটা বিশাল ক্ষেত্রে নিজের বর্গ রচনা করি।

মাস বসন্ত। শহর ধারণ করেছে হলুদ হলুদ দাগ। চাপা নিঃশ্বাসে পালাবার পথ খুঁজি। পথচলতি ইশারাগুলোকে দুর্বোধ্য লাগে বেশ। কিন্তু কেন? বুঝতে চাইছি না কি! বুঝতে চাওয়া এবং বুঝতে না চাওয়ার কিছু পঙক্তি বইয়ের তাকে যত্নে সাজিয়ে রেখেছি বেশ। পাশাপাশি হাত ধরে তারা নিজেদের মতো একটা যাপন তৈরি করে ফেলেছে। সেসবের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা আর করিনা।

একটা সানাইয়ের সুর ক্রমশ শরীরে আলতো করে মাদুর বিছিয়ে দিচ্ছে। সুর মিলনেরও হতে পারে, বিচ্ছেদেরও। ভিতরে চলতে থাকা প্রশ্ন উত্তরের সন্ধানে ফেরে। মহাজাগতিক কিছু উদ্ধার করে তুলে আনে মায়াবারান্দায়। আমি জানালা দেখি, আলো খুঁজি। ঋদ্ধ হই ভিতর ভিতর। যাবতীয় সম্বোধনের ভুলত্রুটি ভেদ করে 'ব্যাকরণ মানছ না' ভেবে লিখি, এভাবে সমস্ত আপনি জলজ হয়ে ওঠেন। তুমি হয়ে ওঠে একটা গন্তব্য। এই এত এত না বলার পর যদি মুখটি তোলো, বুঝবে কীভাবে হিংস্র 'সে' আদিম বুনো নেকড়ের চেয়েও অভিমানী।

আমরা আগুনে দিন কাটাতে ভালবাসি। হাসি হাসি মুখে তপ্ত শরীরে বেশ একটার পর একটা সিনেমা দেখে ফেলি। নায়কদের দেখি রাস্তার মধ্যিখানে বসে থাকতে। সংসার ধর্ম কিংবা সম্পর্ক উপেক্ষা করে যে বা যারা নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা করছে বারবার। এই নিরুদ্দেশ কখনো হয়ে উঠতে পারে শাশ্বত শৈশব। যাকে মুছতে চেষ্টা করলেও আপাত অর্থে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। "এইভাবে শৈশব সবসময় একটা প্রতিশোধ নেয়। সমস্ত গুলিয়ে দেওয়ার প্রতিশোধ।" আমি এসব সঙ্গে নিই। এসবের হাত ধরে চলি। আর 'জরা' ও 'জীর্ণতা' শব্দদুটির অন্তর্নিহিত অর্থ থেকে মুক্তি পাবার  আশায় বারবার কবিতার কাছে ফিরি। তাৎক্ষণিক স্থায়ীত্ব মুছে ফেলে প্রবহমান শাশ্বতর দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। পাশে পড়ে থাকে বই, মন জুড়ে থাকে চারটে লাইন - 
      "জরা ও জীর্ণতা থেকে প্রকৃতই মুক্তি পেতে চাই। / ঝরা পাতা নজরে না পড়ে, / হলুদ ও লোল বৃদ্ধ নজরে না পড়ে, / বসন্তের কাশফুলে কোঁচড় ভরেছি, / নজরে যা পড়ে তাকে বলে কিশলয় - / দুরন্ত যৌবন ফেরে আমাদের ঘরে।"


*লেখাটিতে রইলেন, 
'কিছু মায়া রয়ে গেলো' - শক্তি চট্টোপাধ্যায়, 
'গানের হৃদয়' - জয় গোস্বামী

1 comment: