ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday 22 April 2018

মরিবার হল তার সাধ : চন্দন ঘোষ


ছবিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া
বিশ্বাস করুন আত্মহত্যা করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না আমার। কিন্তু আমাকে যে কাজটা দেওয়া হয়েছে তা তো আত্মহত্যা সংক্রান্তই! আর হাতে কলমে অভিজ্ঞতা না থাকলে কি কলম ধরা যায় মশাই?

বস্তুত জীবনে এত আত্মহত্যা আমি দেখেছি যে চোখ পচে গেছে, ঘেন্না ধরে গেছে মশাই। দু-একটা তো স্রেফ আন্দাজই করতে পারিনি আগের রাত্তিরেও। হস্টেলে সমীরণদার সঙ্গে দেখা হল চারতলার সিঁড়ির মুখে। আমি ডিনারে নামছি। ও উঠছে দিব্যি মৌরী চিবোতে চিবোতে। এক গাল হেসে বল্ল, কী হে চন্দ্রবদন। খেতে নামছ বুঝি। কী প্রশান্তি মুখে তার। সেই রাত্তিরেই সে ১০০টা বারবিচুরেট খায়। আজও জানতে পারিনি কীসে খেল তাকে। তারপর ধরুন, গীতশ্রী। সে ছিল আমার এক বোন। আগের রাতেও কত গল্প করলাম তার সঙ্গে। ভোরবেলায় চলে গেলাম কাজে। ও ঘুমোচ্ছে ভেবে ডাকিওনি, গুড মর্নিং বলিওনি। আত্মহত্যাকারী বড়ো তঞ্চক হয়। প্রবীর তার মাকে প্রায়ই বলত, বেঁচে থেকে আর কী হবে? চলো মা দুজনে একসঙ্গে আত্মহত্যা করি। বেচারা মা! বুঝতেই পারেনি কিছু। ছেলেটার মতিগতি ফেরাতে কত যে ঠাকুর-দেবতার কাছে ছুটেছে। কত যে শিকড়বাকড়, তাবিজকবজ এনেছে তার ইয়ত্তা নেই। একটা জিনিস শুধু করেনি। ডাক্তারের কাছে যায়নি কখনও। তাই একদিন মাকে না নিয়েই সে হুট করে চলে গেল। তারপর আমার রিকশাওলা ঝড়ু অধিকারী, সে তো রেললাইনে শান্ত ছেলের মতো গলা দিয়ে চাকার বাজনা শুনতে গেছিল। "নরক থেকে নরকে, নরক থেকে নরকে"। ট্রেনটা কী নিষ্ঠুর! তাকে শুধু চুমু খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

আত্মহত্যা আসলে জীবনের বিপক্ষে এক দীর্ঘ নীরব ষড়যন্ত্র। তিল তিল করে তার সলতে পাকায় মানুষ। তিল তিল করে তার সপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে থাকে মনের ভেতর। তারপর একদিন দমকা হাওয়া ঝড় হয়ে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আত্মহত্যার এক নিজস্ব দর্শন আছে। যা মানুষকে ভেতরে ভেতরে আত্মহননের সপক্ষে শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করে।

এই তো বেশ এগোচ্ছে ব্যাপারটা! হ্যাণ্ডস অন অভিজ্ঞতার আগে সিচুয়েশনটা তৈরি করতে হবে তো! আত্মহত্যার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে তো! কিন্তু কী কারণে আত্মহত্যা করা যায়? আমি তো খুঁজেই পাচ্ছি না কিছু। পরীক্ষায় ফেল করিনি, প্রেমিকা পালিয়ে যায়নি, বউ তেমন মুখঝামটা দেয় না, দুবেলা খেতে দেয়, চাকরি নট হয়ে যায়নি, লোকে তেমন হ্যাটা করে না। তবে? কোনো ওয়াজাই তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা, কোনো কারণ নেই, এটাও তো একটা কারণ হতে পারে, চাঁদু। একটা অশ্লীল রকমের প্রাচুর্যও তো কারণ হতে পারে। অন্তত জীবনবাবু তো সেকথাই বলে গেছেন। জানলার দিকে তাকাই। না কোনো উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতার কোনো পাত্তাই নেই। কিন্তু একথাও তো সত্যি যে, যে জীবন ফড়িংএর দোয়েলের, তার সঙ্গে আমার মতো মানুষের এখনও দেখা হয়নি। তাহলে? তাহলে কি করেই ফেলা যায়?

এক গাছা দড়ি আর অশ্বত্থ গাছের খোঁজ করা যাক তবে। ওদিকে ঘরের কোণে এসে দাঁড়িয়েছেন কাফকা সাহেব। ইশারায় বলছেন, এতসব আয়োজনের কী দরকার ভাই। আমাকে দেখ। আমার ছুরি লাগেনি, দড়ি লাগেনি, বারবিচুরেট লাগেনি। আমি তো আসলে আত্মহত্যাই করেছিলাম। না কি? অতি ধীর, নিশ্চিত সেই মৃত্যু। জীবনের সব দরজাগুলো একটি একটি করে বন্ধ করে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। তাকে কী বলবে তোমরা? আত্মহত্যা না ইচ্ছামৃত্যু। উত্তর দিতে পারি না। হাতের দড়ি হাতেই থেকে যায়। হাতে কলম ওঠে না। হাতে কলমে আর কিছুই করা হয়ে ওঠে না।

1 comment:

  1. " ঘাড় হেট করে জল দেওয়ার দরকার নেই, দরকার নেই সব যুক্তিসঙ্গত করার।কেতাদুরস্ত হবার জন্য নিজেকে সম্পাদনা করার দরকার নেই বরং ক্ষমাহীনভাবে ধাওয়া কর তীব্র আবেশকে।"
    কাফকা
    মনে পরে বিজন ভট্টাচার্যের মেঘে ঢাকা তারায় তর্জনী আকাশে তুলে বলা " I accuse" । ঋত্বিকের সেই ক্ষোভ আত্মহননের প্রতিরূপে মদের তরলে মিশে গেছিল যেন। যেন উন্মাদ টোবা টেক সিং এর নো ম্যানস ল্যান্ডে শুয়ে পড়া মৃত্যুর মধ্যে মান্টোর মাত্র ৪৩ তে চলে যাওয়াও কেবল চোলাই নয়, ছিল সেই ক্ষমাহীনভাবে নিজের তীব্র আবেশকে ধাওয়া করার ইচ্ছে।

    ReplyDelete