একেকটা ঋতুতে, প্রত্যেকটা ঋতুতেই কলেজ স্ট্রিটকে আলাদা করে
বোঝা যায়। কলেজস্ট্রিট সেই আয়নার মতো, যাতে ছায়া পড়ে দুনিয়ার দিনগুজরানের।
আমি ঠিক ঠিক জানি কেমন করে কলেজস্ট্রিট আমার দিকে হাত বাড়াবে কোন সময়ে। এও
জানি, কোন কোন রাস্তা দিয়ে ঘুরে আমি কী কী বই কিনব ঠিক কোন কোন ঋতুতে।
তপ্ত গ্রীষ্মে আমি সোজা শিয়ালদা স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা ছ্যাকরা মার্কা বাস ধরব এম জি রোড ফ্লাইওভারের নীচের রাস্তা থেকে। জানালার ধারে বসে দেখব একটা একটা করে ঘেমো রোদে পোড়া টানা রিকশা আর অটোকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সেই বাস। চোখ তুলে দেখব রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনের পুরনো বাড়ি, যার দোতলার কড়িবরগার ছাদের তলায় ডাঁই হয়ে আছে শরৎ রচনাবলী, দুষ্প্রাপ্য সাহিত্যসম্ভার, সঞ্জীবচন্দ্র রচনাবলী আরও কত কী। বাস আস্তে আস্তে এগোবে অনুষ্ঠানের কার্ড তৈরি করার দোকানগুলোর পাশ দিয়ে, এসে থামবে আমহার্স্ট স্ট্রিট ক্রসিংয়ে। মোড়ের মাথায় দেখতে পাব বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর পুরনো বাসা। মাথায় ভেসে উঠবে ‘শ্রী শ্রী সদগুরু সঙ্গ’ বইয়ের লে-আউট। রাস্তায় জানো পুরনো বইয়ের দোকান দেখতে দেখতে লোভ হবে একবার নেমে বই ঘাঁটার। তারপর হঠাৎ করেই ক্রসিং আসার আগেই হুট্ করে কন্ডাক্টরকে তাড়া দিয়ে নেমে যাব, মহেন্দ্রদত্তের ছাতার দোকানের উল্টোদিকে। গলিপথে ঢুকে যাব সোজা য়ুনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের সামনে দিয়ে। গন্তব্য প্যারামাউন্ট। চোখের উপর নেমে আসা ঘাম মুছে পর্দা ঠেলে ঢুকব ভিতরে। হ্যাংলার মতো হাঁকব, ভাই একটা ডাব শরবত, বরফ ছাড়া। শরীর মন শীতল করার পর বেরিয়ে আসব ফুটপাথে। তারপর টস করব মনে মনে, মনীষা গ্রন্থালয়ের পুরনো ভাঁড়ার, নাকি সোজা পাতিরাম বুকস্টল।
মাঝ আষাঢ়ের কোনো এক দিনে আমি মেট্রো করে এসে নামব এম জি রোড
স্টেশনে। ক্রসিং আসার আগেই অভিমানী ইলশেগুঁড়ি এসে ভেজাবে চশমার কাচ। আমি
পায়ে পায়ে এগিয়ে যাব গলিঘুঁজির বিফ কাবাব আর হাতরুটির সংসারে। কৈশোরের
স্বাদ জিভে মেখে নেওয়ার পর অঝোরে বৃষ্টি নামবে। ছাতা খুলে পাতিরামের দোকান
পর্যন্ত যেতে যেতে আকাশ ঘনশ্যাম মেখে নেবে সারা গায়ে। দৌড় দৌড় দৌড়ে
পাতিরামে গিয়ে ঘাঁটতে থাকব বিভাব, দিবারাত্রির কাব্য, পরিকথা, এবং
মুশায়েরা - ফুলঝুরির মতো বহুরঙা শতেক লিটল ম্যাগাজিন। তারই কিছু ঝোলায় পুরে
জমা জলে ছপরছাঁই করতে করতে দিলখুশা। কোবরেজি কাটলেটে দিলখুশ করে ঢুঁ মারব
খালি পড়ে থাকা এমসি সরকারের দোকানে। সুধীর সরকারের পুত্র এখনও মাঝেমাঝে
আসেন সেখানে। তাঁকে অথবা কোণের দিকের ভাঙা টেবিলটায় বসে থাকা চেকচেক শার্টের
ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করব আরও বিচিত্রকাহিনী, বা মৌচাকের পুরনো
সংখ্যাগুলোর কথা। বাইরে আকাশ আকুল হবে আরও। আমি ঝুলপড়া ঘরের চারদিকে তাকিয়ে
ভাবব সেই বিখ্যাত এমসি সরকারের সাহিত্যিক আড্ডার কথা। চোখে পড়ে যাবে
ধুলোয় মাখা এককপি গড্ডলিকা। বৃষ্টি একটু ধরে এলে পায়ে পায়ে দু’পা দূরের দেজ-এ। আউট অফ প্রিন্ট বইগুলো ছাপা হল কিনা তার খোঁজ নেওয়া।
মাঠে যখন সদ্য মাথা তুলেছে কাশফুলের দল তখন আমি যাব একবার
কলেজস্ট্রিট। শ্যামবাজার থেকে বিধান সরণি ধরে হাঁটতে হাঁটতে। রাস্তায় এক
দুবার থামব সংস্কৃত পুস্তকভাণ্ডারে আর সারস্বত লাইব্রেরিতে। কিনব না
কিছুই। হেদুয়া পেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরাব। কলেজের টিফিনবেলা শুরু হয়েছে
তখন। বসন্তকেবিনে ভিড়। ধোঁয়ার রিংয়ের মতো আবছা স্মৃতি কলেজদিনের। ঠনঠনে
পেরিয়ে সোজা প্রেসিডেন্সির গা ঘেঁষে দাঁড়ানো পুরনো বইয়ের দোকানগুলোয়। হয়তো
পেয়ে যাব একখণ্ড কোলরিজ, উঁকি দিয়ে যাবে রাধাকৃষ্ণনের ইন্ডিয়ান ফিলোসফি।
অনেকক্ষণ দরকষাকষি করে ঝোলায় পুরব বসওয়েলের লাইফ অফ স্যামুয়েল জনসন।
একটাও পূজাবার্ষিকী কিনব না। কিছু উদ্বৃত্ত পয়সা থাকলে সোজা চ্যাটার্জী
চক্রবর্তীর দোকানে। একটু একটু করে বেছে নেব মহাকাশবিদ্যার বইগুলো। কার্ল
সাগান, ব্রায়ান গ্রীনের বইগুলোর মলাটে আলতো হাত বুলিয়ে নেব। গিয়ে বসব
কফিহাউসের ব্যালকনিতে। ব্ল্যাক কফির অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরাব।
তারপর ভাবতে থাকব পুরনোদিনের কথা। সোনালীদিনের কথা।
হেমন্তের শেষে শীত যখন নববধূর লজ্জায় পা ফেলছে সেরকম একটা
সকালে আবার আমি শিয়ালদা স্টেশনে পা রাখব। এপিসি রোড ধরে এগোতে এগোতে বেঁকে
যাব সূর্যসেন স্ট্রিট ধরে। পদক্ষেপে থাকবে অগোছালো বিষন্নতা। শ্রদ্ধানন্দ
পার্কের আগে টাইপের দোকান অনেক। মন দিয়ে দেখব তাদের। ক্লান্ত আঙুল কিছু
খেলা করছে টাইপরাইটারের উপর দিয়ে । রাস্তার দুধারের ছোট ছোট বিষণ্ণ
দোকানঘরগুলো আমার মনখারাপ করিয়ে দেবে। অনর্থক বুক মুচড়ে উঠবে শীতদুপুরের
নির্জনে। জোর পায়ে হেঁটে যেতে যেতে চোখে পড়ে যাবে শিব্রামের মেস, প্রিয়
চায়ের কেবিন। মন ভালো করার জন্য অনর্থক পয়সা খরচ করে কিনে ফেলব হালকা কিছু
বই। হুমায়ুন আহমেদ, শীর্ষেন্দু, কিছু অলৌকিক কাহিনির বই। গোলদীঘির বেঞ্চে
গিয়ে বসব। আমার পাশে একজোড়া কপোতকপোতী। তাদের অগ্রাহ্য করে একটা সিগারেট
জ্বালাব। তারপর সূর্যটাও যখন আমায় নিঃসঙ্গ করে চলে যাওয়ার তোড়জোড় করছে, লাফ
দিয়ে উঠে দাঁড়াব। বেরিয়ে এসে ট্রাম ধরবো ৫ নম্বরের। ধর্মতলায় গিয়ে প্রিয়
বারের কোনায় প্রিয় ব্র্যান্ডের হুইস্কি নিয়ে বসে থাকব যতক্ষণ না বাকি সমস্ত
বোধের সাথে সাথে একাকীত্বের বোধও লোপ পায়।
বইমেলা শেষ হলে খালি পকেটে আরও একবার। এবার কিছু কেনা হবে না।
খালি হেঁটে যাওয়া। কলেজ স্কোয়ারের গোল চক্কর। কলেজ রো-র ভিতরে হেঁটে হেঁটে
পত্রভারতী বা গল্পগুচ্ছ পত্রিকা দফতরে চলে যাওয়া উদ্দেশ্যহীন। প্রেসিডেন্সি
কলেজের ক্যান্টিনে, করিডোরে গিয়ে বসা বন্ধুর সাথে। বসন্ত এসেছে তখন। আমি
শিমুলগুচ্ছের রক্তিমাভা লাবডুবে পুরে হার্ডিঞ্জ হোস্টেলের পাশ দিয়ে হেঁটে
যেতে থাকি। আবার কোনো একদিন ফিরে আসব বলে।
এরকম অভিজ্ঞতার কথা কমই পড়া যায়। মিতুলের প্রয়াস কে এই জন্যই স্বাগত জানালাম। আপনাকে শ্রদ্ধা।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Deleteএরকম অভিজ্ঞতার কথা কমই পড়া যায়। মিতুলের প্রয়াস কে এই জন্যই স্বাগত জানালাম। আপনাকে শ্রদ্ধা।
ReplyDeleteদেখতে পেলাম চোখের সামনে। গন্ধ পেলাম , আলাদা আলাদা দোকানের আলাদা বই গন্ধ। চমৎকার মনোরম লেখা।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ।
Deleteঅপূর্ব একটা লেখা...। মন কেমন করা, মন ভাল করাও।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। আপনার ভালোলাগায় আমার উৎসাহ জন্ম নেয়, প্রিয় কবি।
Deleteভালো লাগলো। চেনা মানচিত্র।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
ReplyDelete