কবিতাই বলব। গোটা আঠারোটা নির্মেদ
উত্তর-আধুনিক কবিতা। শব্দের তরঙ্গ মেপে মেপে যেন কানে তোলা শব্দকে কেটে
কেটে খাপে বসানো হয়েছে। এত নিখুঁত তার বিন্যাস। অথচ অাভিধানিক বেনিয়মে
ঠাসা। কথা বলছি বিতান চক্রবর্তীর "শরণার্থী" নিয়ে। বইটি নাকি কিরীটী
সেনগুপ্তের "রিফ্লেকশনস অন স্যালভেশন"-এর অনুসরণে লেখা। কবি নিজে যেহেতু তা
স্বীকার করেছেন, ফলে অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু মজাটা এরকম যে,
আপনি মুখবন্ধ ছিঁড়ে শুধু বই-এর কবিতাগুলো পড়ুন। রন্ধ্রে রন্ধ্রে খুঁজে
পাবেন "শান্তিরামের চা"-এর সেই শান্ত, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী
গল্পকার বিতান চক্রবর্তীকেই। নিটোল, নির্মেদ, এবং নিরুপদ্রব।
মোক্ষ
কি? কীভাবে জীবনে মুক্তি আসে? এই প্রশ্নের উত্তরেই আবির্ভাব হয়েছিল "যত মত
তত পথ"-এর। "শরণার্থী"ও আসলে একটা পথ; আধুনিক জীবনের জটিলতা থেকে নিজ
সত্তা আবিষ্কারের, নিজেকে চেনার, জানার পথ — আত্মানাং
বিদ্ধি। বরং একটু মনোযোগ সহকারে দেখলে, কিরীটী সেনগুপ্তের লেখা
নৈবর্ক্তিক, কিন্তু বিতান চক্রবর্তী একেবারেই আত্ম-অন্বেষণে রত। 'জাফরান',
'আচরণ বিধি', 'দান', 'ছুটি' তার প্রমাণ। এখানেই বিতান স্বতন্ত্র। আর
এখানেই "রিফ্লেকশনস অন স্যালভেশন" থেকে "শরণার্থী"-র আলাদা হওয়া শুরু।
"শরণার্থী"
আমজনতা বাঙালির চোখ। তাই সেখানে বিদেশি কেতায় বাঙালির নিত্য
নৈমির্ক্তিকতাকে বোঝানোর দায় নেই যা "রিফ্লেকশনস..."-এর আছে। এ যেন
কৃত্তিবাসী রামায়ণের মতোই একান্ত বাঙালির ঘর দুয়ার মেপে মেপে লেখা। একটা
ছোট উদাহরণ দেওয়ার আগে শেষ প্রভেদটার কথা বলব। প্রথমেই লিখেছি "কবিতা বলব"।
হ্যাঁ, বিতানের বইতে আছে আঠেরোটা উত্তর-আধুনিক কবিতা যার নির্দিষ্টকৃত
ফর্ম নেই। চেতনার বোধ অবচেতন দিয়ে ঢাকা (এক্ষেত্রে অবশ্য কিরীটী সেনগুপ্ত
বিতানকে ছাপিয়ে গেছেন)। অাপাত অসংগত শব্দ বা ব্যাখ্যান তাড়িয়ে নিয়ে যেতে
চাইছে পাঠককে কোনও এক গভীরতর ফল্গু ধারণায়। আর সর্বোপরি পুরো কনটেক্সটা।
কিরীটী লিখেছেন,
Why
do we commission a priest to worship the household gods? I wonder if we
are not capable enough to perform the action on our own. We are perhaps
glued to the sacred thread, the holy saligram, and we nurture the very thought of listening to the loud chants of the religious verses. Aren't we cursed badly by ourselves?
এর অনুসরণে বিতান লিখছেন,
"আমার
পৈতে হওয়ার সময় ঈশ্বর আরাধনার মন্ত্র শিখেছিলাম। অথচ আমার ধুতি পরতে ভালো
লাগে না বলেই বাড়িতে পুরোহিত আসেন। পুরোহিত মশাইয়ের কাছে শালগ্রাম শিলা
আছে। তিনি ধুতিও পরেন। তিনি পবিত্র। আমি ঠাকুরঘরের বাইরে অপেক্ষা করি। দরজা
বন্ধ। পুজো চলছে; শুভ মন্ত্রগুলো আমাকে ঘিরে থাকে। ক্রমশ অবশ লাগে।
পুরোহিত মশাই কি সম্মোহন জানেন? নাকি সাবধানে সরিয়ে রাখেন আমাদের, আমাদের
থেকে!"
"ধুতি"— এই
একটা প্রসঙ্গ আমদানি করেই বাঙালিয়ানার প্রশ্নে বিতান কেল্লাফতে করে
ফেলেছেন। কিরীটীর সব সঞ্চিত ধন একলমহায় নিজের করে ফেলেছেন। "শরণার্থী"র
সাফল্য এখানেই। বিতানের সাফল্যও।
অনুসরণ
বা অনুবাদের সমস্যা এই, বিষয়ের কৃতিত্ব মূল লেখক অধিকার করে রাখেন। এখানেও
সে কৃতিত্ব "রিফ্লেকশনস..."-এর। নিষ্কাম কর্মকে পদে পদে প্রশ্নের মুখে
দাঁড় করানো হয়েছে। ধর্ম পালন কেন? কেন সন্ন্যাস? কেন জীবনের আনন্দের থেকে
অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে কৃচ্ছ্রসাধনাকে? এইসব প্রশ্নের ক্রমাগত তীর বিঁধেছে
পাঠককে। সে অর্থে পাঠ-প্রতিক্রিয়ার অস্তিত্বে এ বই উদ্ভাসিত। পাঠক একবার
পড়ে কিছুতেই সেই কাঙ্ক্ষিত কাব্যসৌন্দর্যে পৌঁছাতে পারবে না। দুটি বই-ই
পাঠকের বহুপঠন দাবী করে, অথবা বলা ভালো, মনোযোগী পাঠকের থেকে তার বহুপাঠ
আদায় করে ছাড়ে। লেখাগুলো পড়তে পড়তে বারেবারেই মনে পড়ছিল একটা গান, গোঁসাই
নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়-এর লেখা। বারেবারেই মনে পড়ছিল লালনের কথা। ঠোকা দিয়ে
যাচ্ছিল বাউল আচরণের বিধিগুলো—
১| মনা রে তীর্থে যাবি সেখানে কি পাপী নাই
কোন দেশে যাবি রে মন?
চল দেখি যাই
কোথা পীর হও তুমি রে!
...
যে জন বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে যায়
স্বপ্নদোষ কি হয় না সেথায়?
আপন মনের বাঘে যাহারে খায়
কে ঠেকাইবে তাহারে?...
২| being with at the same time being detached...
'আম-রাজ', 'আচরণ বিধি', 'ধ্যান', 'ফেরা' নামের কবিতাগুলো এই গন্ডীর চারধারে ঘোরে, প্রশ্ন করে, বিব্রত করে, সর্বোপরি ভাবায়।
ভাবিয়েছে এমন অনেক কিছুই। যেমন—
"মৌমিতার চলে যাওয়া মনে পড়েছে জয়িতা দি-র সাথে ফেসবুক আলাপে" — এ তো আমাদের প্রতিদিনের চেনা ছবি। অথচ কেমন অকপট কবিতা হয়ে উঠেছে।
নিষ্কাম
কর্মে আস্থা নেই আজ আর। তাই ফলের আশা না করে, কাজ করে যেতে বলা ডাক্তারের
ফার্টিলিটি সেন্টার রূপান্তরিত হয়েছে বিউটি পার্লারে।
বেদ যজ্ঞ করতে বলেন, ঘৃতাহুতির কথা বলেন, অথচ গাছ কাটার জন্য পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। তাহলে বেদজ্ঞ ত্রিকালদর্শী হলেন কীভাবে?
—এইসব
টুকরো টুকরো কথায় সূক্ষ্ম রাজনীতি গোঁজা পুরো বই জুড়ে। পাঠকের কাজ শুধু
নিমগ্ন হয়ে খোঁজা। লেখক আর কবি হাত ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বলছেন— "দাগ ঢুঁঢতে রহ যাওগে..."
একইসাথে আরেকটা বিষয়ে নজর টানে।
ডিমনিটাইজেশন
চলছে দেশজুড়ে। "মিত্রঁ" বললেই কি আর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে? গরীবগুর্বো মানুষগুলো
ধুঁকছে। এসবিআই-এর অ্যাসেট লায়াবিলিটি রেট ১.৮। যে কোনও দিন ধ্বসে পড়বে
সিস্টেম। কে ভাবে মশাই এদের কথা! কিন্তু সেই যে বস্তায় পচানো উক্তি চালু
আছে "সাহিত্য সমাজের দর্পণ", আর সমাজের অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রথমে গর্জে
উঠতে হয় সাহিত্যিকদেরই। সঙ্গে সমাজবিদদের। কিরীটী এবং বিতান তাদের সে
দায়িত্ব এড়িয়ে যায়নি।
"তুমি
তো সন্ন্যাসী, তুমি জ্ঞানী। কার্য-কারণ সম্পর্কের বাইরে থাকো তুমি।
কিন্তু ওই যে লোকটি কাজ করেন মূল্যের বিনিময়ে, যাতে তার সংসার চলে... সে
আসলে মূর্খ! কোথা থেকে সে শিখেছে ভগবানের কাছে পরিবার পরিজনের কল্যাণ কামনা
করতে। আরও কিছুকাল প্রিয় মুখগুলোর সাথে থেকে যেতে। "
সত্যি বলতে কি, এই সামগ্রিক কনটেন্ট একটা চোরাস্রোতের ইঙ্গিতবাহী। ব্রাজিলিও শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরে তাঁর পেডাগজি অব দ্যি অপ্রেসড
বইতে দেখান কীভাবে প্রত্যেক সমাজে সামান্য কিছু ব্যক্তি সমগ্র জনগণের উপর
ক্ষমতা চালায় এবং ফলস্বরূপ তৈরি হয় "ডমিনেটেড কনশাসনেস"। এই অবস্থান থেকে
বেরিয়ে ফ্রেইরে মানুষকে "পলিটিক্যাল কনশাসনেস" -এ উন্নীত করতে চেয়েছেন।
কিরীটী ওরফে বিতানের টেক্সট-এ এই পলিটিক্যাল কনশাসনেসকে সূক্ষ্মভাবে লেপটে
থাকতে দেখি। বেশ মজা লাগে। লে পাগলা! কোথায় তোর কবিতা, আর কোথায় রাজনীতি;
কোথায় সমাজ আর কোথায় বুর্জোয়া অর্থনীতি—সবকে ঘেঁটে দিলাম। তুই চুলকে ঢুঁঢ লে। দারুণ।
নিম্নবর্গের
ইতিহাস লিখতে গেলে বুঝতে হবে উচ্চবর্গের খামতিগুলো। দুজন বামুন নিজেদের
কৌমকে বারবার খোঁজাচ্ছে, "চোখে আঙুল দাদা"-র মতো সেঁধিয়ে যাচ্ছে নিজেদের
পূর্বপুরুষের তৈরি বিধিতে। আবার নিজের জাগ্রত চেতনায় ফিরে দাঁড়াচ্ছে
আমার-তোমার পাশে। নিজের কৌমের বিরুদ্ধে লড়াই, এ অত সহজ তামাশা নয়। তবু তাতে
ছক্কা হাঁকিয়ে দিয়েছে কিরীটী সেনগুপ্ত, সঙ্গতে বিতান চক্রবর্তী, আর
একেবারে নগ্ন দুটো বই — Reflections on Salvation এবং শরণার্থী।
শরণার্থী (অক্টোবর, ২০১৬) (পেপারব্যাক)
গ্রন্থকারঃ বিতান চক্রবর্তী
প্রকাশকঃ শাম্ভবী
প্রচ্ছদঃ সৌরীশ মিত্র
দামঃ ১০০ টাকা
গ্রন্থকারঃ বিতান চক্রবর্তী
প্রকাশকঃ শাম্ভবী
প্রচ্ছদঃ সৌরীশ মিত্র
দামঃ ১০০ টাকা
No comments:
Post a Comment