ক্লোরোfeel-এর পাতা

Thursday, 2 March 2017

ভ্যানিটি ব্যাগ : স্বপ্নময় চক্রবর্তী



ভ্যানিটি ব্যাগের সঙ্গে অঙ্গে অঙ্গে যুক্ত থাকেন মহিলাগণ, পুরুষদেরও ব্যাগ থাকে। ওই ব্যাগকে ভ্যানিটি ব্যাগ বলা হয় না। পুরুষদের ব্যাগের নাম কখনও অ্যাটাচি, কখনও অফিস ব্যাগ, কখনও বা ঝোলা। মহিলাদের সঙ্গে যে ব্যাগটা থাকে ওটাকে ভ্যানিটি ব্যাগ কেন বলা হয় কে জানে! কবে থেকে ওই ব্যাগটার নাম ভ্যানিটি ব্যাগ হল তাও জানি না।

মেয়েদের পোশাকে পকেট ছিল না। আজকাল তো মেয়েরা জিন্স পরেন, শার্ট পরেন। সেইসব পোশাকে পকেটও থাকে। পকেট থাকা সত্ত্বেও মেয়েদের কাঁধে একটা ব্যাগ থেকে যায়। ছেলেরা দিব্যি পকেটসর্বস্ব হয়ে ঝাড়া হাত-পায়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। পকেটেই মোবাইল, টাকা পয়সা, কার্ড ইত্যাদি রাখতে পারে কিন্তু আজকাল মেয়েরা পকেট অর্জন করা সত্ত্বেও পকেটে ভরসা করতে পারে না। একটা ব্যাগ রাখতেই হয়।

এখন না হয় পকেট অর্জন করেছেন কিছু কিছু মহিলা। কিন্তু মহিলাদের চিরাচরিত পোশাকে পকেট ছিল না কখনও। গাউন বা স্কার্টে পকেটের ব্যবস্থা ছিল না। করলে কিন্তু করাই যেত। একটা গাউন বা স্কার্টের এক পাশে পকেট বানাতে গেলে কতটুকুই বা বেশি কাপড় লাগত? কিন্তু এ নিয়ে পোশাক নির্মাতারা কিছুই ভাবেনি কখনও। সালোয়ার-কামিজেও পকেট নেই। বুক-পকেটে অসুবিধে থাকলে সাইড পকেট করাই যেত। পুরুষের পাঞ্জাবিতে তো দিব্য পকেট থাকে। এটাও বোধ হয় পুরুষ আধিপত্যের ব্যাপার। পকেট নিয়ে মেয়েরা সোচ্চার হয়নি। টুকটাক জিনিসপত্র বহন করার জন্য একটা আলাদা ব্যাগ সব সময় রাখতেই হয়েছে সঙ্গে। শাড়িতে পকেট বানানো বেশ কষ্টকর ব্যাপার। আজকাল বুটিকে এমন সব শাড়ি পাওয়া যায়, যেখানে কায়দা করে এমন সব নকশা করা থাকে, যা ঠিকমতো পরতে পারলে অভিনবত্ব ফুটে ওঠে। আজকালকার ফ্যাশন ডিজাইনাররা ইচ্ছে করলে একটা পকেটের ব্যবস্থা করে ফেলতেই পারেন, করলে হয়তো জনপ্রিয়ই হবে, কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনাররাও ওই লাইনে ভাবছেন না। মেয়েরা চুল বয়কাট করছে, শার্টপ্যান্টও পরছে, কিন্তু পকেটের ব্যবহারে আজও পিছিয়ে। যদিও আধুনিক মেয়েদের মুখে সংলাপ শুনেছি পকেটে একদম পয়সা নেই, কিংবা পকেট গড়ের মাঠ ইত্যাদি।

ছোটবেলায় প্রথম ভ্যানিটি ব্যাগ দেখি আমার পিসিমার হাতে। পিসিমা কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরতেন, সেলাই শিখতে যেতেন আর রিকশা চড়ে ম্যাটিনি শো-তে সিনেমা দেখতে যেতেন। হাতে ছিল লাল মতো একটা ভ্যানিটি ব্যাগ। বোধহয় চামড়ারই ছিল। তখনও অত রেকসিনের চল হয়নি। পিসিমার ব্যাগে লিপস্টিক-ফেস পাউডার ইত্যাদি থাকত না। থাকত কিছু খুচরো পয়সা, আর একটা ডিবে। ওই ডিবের মধ্যে থাকত পান-সুপুরি। পান খাওয়া রাঙা ঠোঁটই ছিল সেকালের লিপস্টিক। ভ্যানিটি ব্যাগের পূর্ববর্তী স্তর হল পুঁটুলি। চলিত কথায় পোঁটলা। আমার ঠাকুরমার ভাই থাকতেন শোভাবাজারে। বাগবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে বাপের বাড়ি যেতেন আমাকে সাথে নিয়ে। বাপের বাড়ি গিয়ে কখনও দিন কতক থাকতেন। সঙ্গে থাকত একটা পুঁটুলি। ওই পুঁটুলিটা আয়তনে খুব একটা বড়ো হত না। নিশ্চয়ই কাপড়-চোপড় থাকত না। থাকত টুকিটাকি জিনিসপত্র। হয়তো সুপুরি কাটার জাঁতি, গুরুদেবের ছবি এইসব হয়তো থাকত। জপের মালাও থাকত। বিয়েবাড়ির তত্ত্বে এখনও ননদ পুঁটুলি শব্দটা ব্যবহার হয়। ননদ পুঁটুলিতে অবশ্যই দেওয়া হয় ভ্যানিটি ব্যাগ। সেই ব্যাগে থাকে নানা কসমেটিকস। সেইসঙ্গে শাড়িও থাকে।

পিসিমার দেখাদেখি আমার মা-ও একটা ভ্যানিটি ব্যাগ কিনেছিলেন। ভ্যানিটি ব্যাগের নিম্নতর সংস্কারকে বলা হয় বটুয়া। বটুয়া সাধারণত কাপড়ের হয়, দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে। দড়ির ফাঁস খুলে ওই ব্যাগের ভিতরে হাত ঢোকাতে হয়। আজ থেকে চল্লিশ/পঞ্চাশ/ষাট বছর আগে যে সব কার্টুন ছাপা হত, তাতে তৎকালীন আধুনিকাদের ছবি দেখা গেছে।

মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ ধারণ নিয়ে ছড়াটড়া ছাপা হত। বনবিহারী মুখোপাধ্যায় শনিবারের চিঠিতে সাম্য নামে আধুনিক মেয়েদের নিয়ে একটি পদ্যে লিখেছিলেন

Flesh কালারের সিল্ক মোজায়
হালকা তাঁদের দিলকে বোঝায়
পলকা জুতোয় ইঞ্চি তিনেক হিল কি বাহার
মরদগুলোর সঙ্গে গরমিল কী আর,
ঝুলছে হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ চমকদারী
উঠছে বাসে উঠছে ট্রামে চড়ছে গাড়ি।

কুমারেশ ঘোষ যষ্টিমধু পত্রিকায় বিদ্যাসাগরের 'শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা'-র একটা প্যারোডি করেছিলেন, “প্রস্থান সময় উপস্থিত হইল। মিসেস গৌতমী এবং মাস্টার শাঙ্গরব ও শ্বারদ্বত নামে দুই পাড়াতুতো দাদা শকুন্তলার সমভিব্যাহারে গমনের নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন...কতিপয় পদ গমন করিয়া শকুন্তলার গতিভঙ্গ হইল। শকুন্তলা ‘আমার ভ্যানিটি ব্যাগ ধরিয়া কে টানিতেছে?’ এই বলিয়া মুখ ফিরাইলেন। কর্তা কহিলেন তোমার ডগিটি তোমার গতিরোধ করিয়াছে। মা সুকু, তুমি হিল সামলাইয়া চল।...”

যতীন সেন, হরিপদ রায়, ওমিও, রেবতীভূষণ, কাফি খাঁ এঁদের আঁকা ব্যঙ্গচিত্রে দেখেছি আধুনিকাদের পায়ে হাই হিল জুতো, আর কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ।

ভ্যানিটি ছাড়া ‘আধুনিকা’ ভাবা যেত না। ভ্যানিটি ব্যাগের হিন্দি অনুবাদ নাকি ফুটানি কা ডিব্বা। বোঝাই যায় রক্ষণশীল সমাজ এই ব্যাগটাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। এ জন্যই হয়তো আমার মা তথাকথিত ভ্যানিটি ব্যাগ না কিনে বটুয়া কিনেছিলেন।

আজকাল আধুনিকাসব এই দ্রব্যটিকে আর ভ্যানিটি ব্যাগ বলেন না। ভ্যানিটি শব্দটি বাদ দিয়েই বলেন। শুধু ব্যাগ। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে ব্যাগ ব্যবহার করেন। কোনও কোনও ব্যাগাড়ুর ডজনাধিক ব্যাগ থাকে। ব্যাগ সংগ্রহ ওদের হবি। ব্যাগের জন্য আলমারিও রয়েছে আলাদা। কেউ কেউ যেখানে বেড়াতে যান সেখান থেকেই একটা করে ব্যাগ সংগ্রহ করেন। ব্যাগের নানা ঘরানা আছে। মণিপুরী ব্যাগের একরকম বৈশিষ্ট্য তো জয়পুরী ব্যাগের আলাদা। সম্বলপুরী ব্যাগের এক ধরনের ডিজাইন তো গুজরাটি ব্যাগের আলাদা। বিশেষ বিশেষ নকশা। জয়পুরী শাড়ি পরলে তার সঙ্গে জয়পুরী ব্যাগ, সম্বলপুরীর সঙ্গে সম্বলপুরী। ম্যাচিং একটা আর্ট। লিপস্টিকের রং, শাড়ি-ব্লাউজের রঙের সঙ্গে ব্যাগেরও একটা ব্যাপার থাকে।

এখন একটা ব্যাগ হাওয়া উঠেছে। কিছুকাল আগে যেমন পাঞ্জাবি হাওয়া উঠেছিল। পাঞ্জাবের খালিস্তানি বিপ্লবটা সরে এসেছিল পশ্চিম বাংলার পাঞ্জাবিতে। পাঞ্জাবিতে কত কী লেখা! কত রকম কাজ। পাঞ্জাবি দেখলেই বোঝা যেত লোকটা কী করেন। বাচিক শিল্পীর পাঞ্জাবিতে কবিতার লাইন। সরোদ-সেতার-তবলা শিল্পীদের ঘন রঙের পাঞ্জাবি। প্রায়শ সিল্কের। কংগ্রেসি ঘরানার পাঞ্জাবি কলার তোলা। এরকম। এখন ব্যাগ। ভ্যানিটি ব্যাগ। বলা যায় ব্যাগের আমি ব্যাগের তুমি ব্যাগ দিয়ে যায় চেনা।

সেই গল্পটাতো সবাই জানেন এক ভদ্রলোক এক মহিলাকে বাসের মধ্যে থাপ্পড় মেরে ফেলেছিলেন। কারণটা হল কন্ডাকটার ভাড়া চাইলে মহিলাটি ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি ব্যাগ বার করলেন। আগের ব্যাগটির চেন আটকালেন। এবার ছোট ব্যাগটির চেন খুললেন। চেন খুলে আবার একটা আরও ছোট ব্যাগ বার করলেন। চেন বন্ধ করলেন। সেই ব্যাগটার ভিতর থেকে আবার একটা আরও ছোট ব্যাগ। সেই ব্যাগটার চেন খুললেন। তারপর তার ভিতর থেকে...

লোকটি ধৈর্যহারা হয়ে গেলেন, সপাটে চড় মেরে দিলেন ভদ্রমহিলাকে। এটা শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প। এটা হয়তো নিছক গল্প। কিন্তু চেন খোলার চেনা শব্দ এখনও সত্যি। জিপ খোলার শব্দের মধ্যে কিছু একটা থেকে যায়। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যাপারটা ভালো করে লিখতে পারতেন। এখন ব্যাগগুলি চেন জর্জরিত। জর্জরিত না বলে অলংকৃত বললেই ভালো হত। কিন্তু বলা গেল না। কারণ ব্যাগ-বিলাসীরা নিজেরাই ভুলে যান কোন খাপে কী রাখা আছে। প্রয়োজনীয় জিনিসটি পাবার জন্য বারবার চেন খুলতে হয় এবং চেন বন্ধ করতে হয়। এবং ওই শব্দে অনেক পুরুষের মনেই চিনচিনানি হয়।

এখন বিশ্বায়নের বাতাস লেগেছে। সারা পৃথিবীর সবকিছু যেন এক রকম হয়ে যাচ্ছে। ফ্যাশন টিভি খুললে দেখা যায় মডেলদের কাঁধে ব্যাগ। কোমরে বেল্টও থাকে। পোশাক-ব্যাগ-বেল্ট নিয়ে গোটা একটা ডিজাইন। ইতালি-ফ্রান্স-জার্মানি-ব্রাজিল-মেক্সিকো সব এক রকম। সেই হাওয়া ভারতেও এসেছে। বড়ো বড়ো শপিং মলে ব্যাগের আলাদা বিভাগ আছে। রোমের ব্যাগ মুম্বাইতেও দিব্যি পাওয়া যায়। প্যারিসের ব্যাগ ব্যাঙ্গালোরে।

সেইসঙ্গে এথনিক ব্যাগও হারিয়ে যায়নি। পুরীতে মধ্যবিত্তদের শপিংয়ে ব্যাগ একটা থাকেই। বটুয়াও শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের বাড়িতে মিক্সিও থাকে, শিলনোড়াও থাকে। বিশ্বজোড়া ব্যাগায়ন হয়েছে সত্যি, তবু আজও বটুয়া, ঝোলা, সবই আছে। এমনকী পুঁটুলিও। ননদ-পুঁটুলি নয়, কাপড়ের পুঁটুলি। নাবাল খাটতে আসা মহিলারা পুঁটুলি খুলে মুড়ি খায়। পুঁটুলির মধ্যে ব্যাগে থাকে একটা ছোট আয়না, প্লাস্টিকের চিরুনি এই সব। ওতে কোনও ভ্যানিটি নেই। থাকে না।


কার্টুন : শুভেন্দু সরকার

6 comments:

  1. আমার বড়মাসি থাকতেন আসামে। মেসো কে জীবনে চোখে দেখিনি। মাসি কিন্তু প্রতিবছর নিয়ম করে আসতেন আমাদের কাছে । একাই আসতেন। বড়মাসির কিন্তু পকেট ছিলো। সায়ার অভ্যন্তরে । একা অতদূর থেকে আসতে হতো বলে টাকা পয়সা সাবধানে রাখতেই সেই স্পেশাল পকেট। আমাদের ছোটদের জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ থাকতোই মিষ্টি খাওয়ার জন্য । যদিও ওই বয়সে নগদ টাকা হাতে পেলে কে আর মিষ্টি খাওয়ার মতো বোকামি করে !

    ReplyDelete
  2. আমার বড়মাসি থাকতেন আসামে। মেসো কে জীবনে চোখে দেখিনি। মাসি কিন্তু প্রতিবছর নিয়ম করে আসতেন আমাদের কাছে । একাই আসতেন। বড়মাসির কিন্তু পকেট ছিলো। সায়ার অভ্যন্তরে । একা অতদূর থেকে আসতে হতো বলে টাকা পয়সা সাবধানে রাখতেই সেই স্পেশাল পকেট। আমাদের ছোটদের জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ থাকতোই মিষ্টি খাওয়ার জন্য । যদিও ওই বয়সে নগদ টাকা হাতে পেলে কে আর মিষ্টি খাওয়ার মতো বোকামি করে !

    ReplyDelete
  3. Daarun laglo swopnomoy babur Lekha ta. Rosiye rosiye tothyo aar golpo poribeshon koraay tNar juri aar keu achhe naki!

    ReplyDelete
  4. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  5. সত্যি ভাবা যায় ওই ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়েই একটা অনবদ্য গল্প ।গল্পে কোথাও কোন আড়ষ্টতা নেই ।অবলীলায় পরতে পরতে রং ছড়াতে ছড়াতে চপলা নদীর মতো বয়ে গেল শেষ পানে ।

    ReplyDelete