ক্লোরোfeel-এর পাতা

Wednesday, 1 March 2017

ব্যক্তিমানুষ সময় হিসেবে কেমন যেন অসহায়... : শিবাশিস দত্ত


বইয়ের নাম : ‘রবি সেনের দুটি উপন্যাস’। দুটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস নিয়ে এ বই। প্রথমটি মাত্র ২৯ পাতার(ভাবা যায়!), নাম ‘রেডলাইট এরিয়ায় ক্ষমতার হস্তান্তর’। এ এক ধ্বস্ত মাতৃভূমি তথা ভূখণ্ডের কাহিনি যেখানে জনগোষ্ঠী তার ভূ-প্রকৃতিকে আপন করতে জানে না, নদী যাদের কাছে পর হয়েই থাকে কিংবা তা হয়ে দাঁড়ায় মিউনিসিপ্যালিটির ভ্যাট। দূষণে দূষণে বিপর্যস্ত হয় এ তল্লাট, আর সে পরিবেশের রিয়ালিটিকে ধারণ করতেও পারে না ‘সমাজ’। শহরে মাথাচাড়া দেয় রেডলাইট এরিয়া, গ্রামেও গজিয়ে ওঠে বেশ্যাঘর। কথাকারের ভাষায়, “এসব রিয়ালিটি ঠিকই, আবার রিয়ালিটির বমনও”।

ইয়াসিন মিঞার কাপ্তেনি ছিল এ রেডলাইট এরিয়ায়। দলীয় সংঘর্ষে ইয়াসিন খুন হয়, আবার ইয়াসিনের দলের কেউ খুন করে দেয় নতুন কোনও কাপ্তেনকে। দখলদারি নিয়ে এ মুলুকে খুনোখুনি চলতেই থাকে। রাতবিরেতে হাতবোমার লড়াই শুরু হয়ে যায়, রাস্তাঘাট হয়ে দাঁড়ায় শুনশান। যেন এখানে কোনও থানা নেই। যৌনকর্মীরা এ তল্লাটে শরীর বেচে, তাছাড়া এরাই ছড়িয়ে দেয় রেডলাইট এরিয়া দখলের যুদ্ধকালীন খবর। নানা কিসিমের গুজবও ছড়ানো হয়। “বাঘের আগে ফেউয়ের মতো গুজব আসে ঘোড়ায় চড়ে। আমজনতার মনস্তত্ত্ব বলে যদি কিছু থাকে তা হল : “কথা বলো না। ভয় যখন পেয়েছ তখন তাকে মান্য করো।”
        
এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মালতী। সরলমতি, স্বভাব-অভিমানী কিংবা ফুলের মতো নরম একটি মেয়েকে কল্পনায় হাজির করে তারই উপমায় মালতীকে দেখতে চেয়েছেন লেখক। নয়নতারার উপমায় এসেছে মালতী। সে গ্রামের মেয়ে, উল্লুকের সঙ্গে তার গ্রামদেশেই দেখা হয়। উল্লুকের ভালোবাসায় প্রশ্রয় পেয়ে তার হাত ধরে মালতী চলে আসে শহরে। উল্লুক লোকাল বডি সদস্য নিমাই সাধুখাঁর দলের ক্যাডারও বটে। সরল বিশ্বাসে তাই সে মালতীকে তুলে দেয় নিমাইদার হাতে। পরবর্তীতে মালতী ধর্ষণের শিকার হয়। তাকে ঠেলে দেওয়া হয় রেডলাইট এরিয়ার অন্ধকারে।

নিমাইদার মন ছিল বেবাক নষ্টামিতে ভরা। আদালতে মালতী জানিয়েছে সে কদর্যতার কথা।...“হুজুর, আমি খেরস্তানের ভাষা জানি না। নেমাইদা আমাকে শেখায় পাছা, গাঁড়, ঊরু, জঘন ও যোনি।” মালতীকে, মালতীর ভাষাকেও নষ্ট করতে চেয়েছে নিমাইদা। মালতী কেন লক-আপে? ওর নামে নাকি আদালতে চুরির মামলা আছে। অভিযোগ সাজানো হয়েছে মালতী একে কানীন মেয়েছেলে, অ্যাকটিং করতে গিয়ে পরপুরুষদের প্রলুব্ধ করে। এও রটনা হয় যে, আত্মঘাতিনী হয়েছে মালতী। সে নাকি আগুনে পুড়েছে, মতান্তরে ভোঁতা ছুরি দিয়ে সে তার কন্ঠনালী কেটেছে। মালতীর পক্ষ নিয়ে যে উকিল কোর্টে দাঁড়ায়, তার জামাপ্যান্ট খুলে নেওয়া হয়। মালতী আদতে কে, কী তার পরিচয় সবই লোপাট করে দিতে সক্রিয় হয় কুচক্রীরা। কথাকার জানান, ধর্ষণেরও দর্শন আছে যা খোলা বাজারের সঙ্গে যুক্ত। সেক্স ইন্ডাস্ট্রি, কমফোর্ট উইমেন সাপ্লায়ের ব্যবসা এ সবই একটা সিস্টেমের অন্তর্গত হয়ে ওঠার দরুন মালতীরা একটা শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে। এ সিস্টেমের জন্ম দেয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। সে কারণেই নেপাল বাংলাদেশের মেয়ে কলকাতা দিল্লি মুম্বাই করাচী ইসলামাবাদের রেডলাইট এরিয়ায় হাজারে হাজারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অতএব, মালতীদের মুক্তি নেই। শুধু কি তাই! মালতীও জানে, গ্রামের অনেক মেয়ে বিয়ে হয়ে চলে যায়, আর ফেরে না। কেউ এ নিয়ে প্রশ্নও তোলে না। বিবাহ এ যেন এক্ষেত্রে একটা লোকদেখানো ব্যাপার।

নিজের দলের লোকের হাতেই খুন হয়েছিল উল্লুক। উল্লুকের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মালতীর বাবা কৃত্তিবাস এসেছিল শহরে। মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য কৃত্তিবাসকে শহরে পাঠিয়েছিল মালতীর মা কিন্তু মালতী ফেরেনি। সে তার বাবাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। মালতীর মনে ভয় ছিল, গ্রামের মেয়ে গ্রামে ফিরে এলে মেয়ের বাবা-মার ওপর যদি কোনও আঘাত নেমে আসে? ধর্ষিতা মালতী তার নষ্ট শরীরকেও ভয় পায়
তার ছোঁয়ায় গ্রামে যদি কোনও অঘটন ঘটে? নদী যদি দূরে সরে যায়! উপন্যাসের গোড়ায় কথাকার এক কালী অমাবস্যার রাতের কথা উল্লেখ করেছেন। সে রাতে রাতকানা একটি কিশোর একজন স্ত্রীলোকের আঁচলা ধরে তার পাশে পাশে ঘুরছিল। স্ত্রীলোকটি আর কেউ নয়, ওই কিশোরেরই মা। উপন্যাস শেষ হয় এই রাতকানা কিশোরের জিজ্ঞাসা দিয়ে : “মা, জন্মাইতে কি বাপ লাগে!” যৌনতা যে সময় আর কালে পণ্য হয়ে দাঁড়ায়, সে সময় শিশুজন্ম নিয়ে কোনও কিশোরের মনে এমন প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়। লেখক কি তবে সে বার্তাই দিতে চেয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে উপন্যাসটির মোটিভ বোঝা দরকার। উপন্যাসে পড়ি :
“আমি কোনও সিচ্যুয়েশন তৈরি করতে চাইছি না, চরিত্রও নয়। বৃত্তান্তকে গুটিয়ে তুলতে যে কল্পনা-মণীষার দরকার হয়, তারই ছোঁয়ায় চরিত্ররা বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। তাছাড়া ইদানীং পশ্চিমে রচনা লেখকদেরও মৃত্যু হয়েছে। অথচ দেখুন, আমি নিজেই এ বৃত্তান্তে আছড়ে পড়েছি। বলছি, এটা জানি, সেটা জানি, এটা দেখেছি, ওটা বলব না। আগের পরে কত কী। আসলে এ বৃত্তান্তে আমিও ‘হয়ে’ উঠতে চাইছি কীনা কে জানে।”

উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হয়, লেখার কৃৎকৌশলকে সর্বাগ্রে বোঝা দরকার। নয়তো এ বৃত্তান্তকে সঠিক আন্দাজ করা যাবে না। উপন্যাসকার ঘটনার বিবরণ সাজাতে যেন কৌশল করেন। এপিসোডের পর এপিসোড রচনা করেন না। কিছু কথা কেবল সাজিয়ে দেন, যার অভিঘাতে সিরিয়াস উপন্যাসের একটা ডোমেইন তৈরি হয়ে যায়। কে না জানে, পুঁজিকেন্দ্রিক সমাজ গভীর ক্ষত নিয়েই বাঁচে
উন্নয়ন বা সংস্কৃতির যে বড়াই থাক, খোলা বাজারের মূল্যবোধ ও দর্শন এ ধরনের সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। যৌনতা যেখানে পণ্য, নারীর ইজ্জত সেখানে লুঠ হবেই। এটা কোনও নির্দিষ্ট গ্রামের বা মালতী নামধারী কোনও ধর্ষিতার নির্দিষ্ট কাহিনি নয়, সমস্যাটা দুনিয়াজোড়া। লেখক সে বিষয়ে পাঠককে সচেতন করতে চেয়েছেন।
 
এ বইয়ের দ্বিতীয় উপন্যাস
‘বসন্ত-শ্রুতি ব্রিগেড’। কোনও নিটোল পারিবারিক গল্প নয়, এ এক বেপথু দাম্পত্যের কাহিনি। বসন্ত-শ্রুতির একমাত্র সন্তান বাবুল এক মানসিক প্রতিবন্ধী। জন্মাবার আধঘন্টা পরে নাকি কেঁদেছিল সে! ওর আড়ষ্টতা এবং অস্পষ্ট মনোভাব গড়ে উঠেছিল জন্মানোর প্রক্রিয়ায়। ফরসেপ ডেলিভারির দরুন মস্তিষ্কে যে আঘাত লেগেছিল, তাতেই নাকি বাবুলের এমন দুর্ভাগ্যজনক অস্তিত্ব অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। বসন্ত এজন্য দায়ী করে সেই নার্সিং হোম এবং সেখানকার সার্জন ডাক্তার সোমকে যার হেপাজতে বাবুলের জন্ম। বসন্ত স্হির করে এজন্য সে ডাঃ সোমকে খুন করবে। খুন করার পরিকল্পনা অবশ্য শেষ পর্যন্ত রূপায়িত হয়নি কারণ, সে নার্সিং হোমেরই পাত্তা মেলেনি। সে নার্সিং হোম উঠে যায়, ডাক্তার সোমও মারা যান।

বসন্তর খুনে মানসিকতা জেগে উঠল কেমন করে? সে একবার কিডন্যাপড হয়েছিল। বসন্ত অবশ্য বলে, নাগা রেবেলদের হাতে সে বন্দী হয়েছিল। প্রশ্ন, এ ঘটনা কি কোনওভাবে বসন্তর মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলেছিল? এমন কথা হয়তো জোর দিয়ে বলা যাবে না, তবে কোনও ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক আচরণে পুরোনো অভিজ্ঞতা যদি কোনও প্রভাব ফেলে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

এ উপন্যাসে কথাকারও একটি চরিত্র হয়ে উঠেছেন। বসন্ত খুন করবে, আর সে অ্যাকশন স্কোয়াডের সঙ্গী হতে সে অনুরোধ জানিয়েছে লেখককে। অন্যদিকে লেখকও বসন্তর ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন : “আপনার জীবনসংগ্রাম যেখানে ক্লাস স্ট্রাগল থেকে তফাত হয়ে গেছে, সেখানে আপনি মরবিড
।” প্রত্যুত্তরে বসন্ত জানায় : “ক্লাস স্ট্রাগল এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের হেঁশেলে রুটির সঙ্গে মাখন খাবে বলে লাইনে দাঁড়িয়েছে।” আজকের দুনিয়ায় মার্কসবাদীদের কাছে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব কিছুটা হলেও নিষ্প্রভ; বসন্তর জীবনে তারই পরিচয় মেলে। বিপ্লববাদী বসন্ত রাজনীতিতে আদর্শভ্রষ্ট হয়ে যায়, শেষমেশ সে বিদ্রূপের রক্তমাংস হয়ে ওঠে। পারিবারিক জীবনের অভিজ্ঞতা বসন্তর যুক্তিবুদ্ধিকে অসমীচীন করে তোলে। সন্তান বাবুলের পঙ্গুজীবনকে বসন্ত মেনে নিতে পারেনি। এই না-মানার ভাবনা থেকে সে উদ্ভট কল্পনায় গা ভাসিয়েছে এবং শেষমেশ বিদ্রূপসম হয়ে উঠেছে। তথাকথিত বিপ্লবীরাও হয়ে উঠেছে তার  বিদ্রূপের খোরাক।

বাবুলের কথায় আসা যাক। কথাকার হাবা স্বভাবের বাবুল সম্পর্কে মন্তব্য জানাবার অছিলায় চলমান দুনিয়াকে তির্যকস্বরে বিঁধেছেন : “ওকে হাবা বলে জানতে আমি কুন্ঠা বোধ করি। পৃথিবীটাই কি কম বাবা?” তবে কিশোর বাবুলের হাবামি নিয়েও কোনও সংশয় নেই। বাবুল খেলতে শেখেনি, স্নান শেখেনি, খেতেও শেখেনি। সে মানসিক প্রতিবন্ধী স্কুলে যায়, কিশোর বয়সেও কখনও মায়ের দুধকে খাদ্য হিসেবে পেতে চায় সে। বাবুলের মনের বয়স কি তবে বাড়ে না? হায়, পৃথিবীর কাছে কিছু চাইতেও শেখে না বাবুল। বসন্তর আক্ষেপ, বাবুলের হাতের তালপাতার ভেঁপু আজও বাজল না। শ্রুতি মফঃস্বলের মেয়ে, স্কুলশিক্ষক। বসন্তও স্কুলমাস্টারের চাকরি করে। শ্রুতি কখনও বলে ওঠে, “বাবুল আমাদের মর্মর।” কখনও বলে, বাবুল ওর হারমোনিয়াম। আর বসন্ত বলে, “বাবুল আমাদের চেয়ারম্যান।” বাবুলের অক্ষম অস্তিত্বকে ভুলতে কত না কথা বানায় ওর বাবা মা। এহেন জড়বুদ্ধিসম্পন্ন সন্তানকে নিয়ে শ্রুতি-বসন্তরা কী করবে? এটা তো ইউরোপ বা আমেরিকা নয় যে দেশের সুপ্রজননবিদরা লক্ষ্য রাখবে যাতে পঙ্গু শিশু না জন্মায়। বাবুল তো জন্মে গেছে। এ জন্ম তো ফেরানো যাবে না। স্টেটসম্যান পত্রিকাতে একদল দম্পতির সাক্ষাৎকার ছেপে বেরিয়েছিল। তারা জানিয়েছিল, সন্তানরা ইঁদুরদৌড়ে নামুক তা তারা চান না। সে কারণে তারা সন্তানের জন্ম দিতে আগ্রহী নয়। কিন্তু তারা তো সব এলিট দম্পতি। বসন্ত-শ্রুতি এসব কথা জেনে কী করবে? প্রবাসী দম্পতিদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কথাগুলো শ্রুতি জেনেছে ওর কলেজ জীবনের বন্ধু রেবেকার কাছে। রেবেকা বিদেশে থাকে, দেশে ঘুরতে এসেছে। ও হাবা বাবুলের জন্য একটা গিফট আইটেম এনেছে। সেটা কী? একটা সায়েন্টিফিক ডিকশনারি! রেবেকা এও জানায় যে, আমেরিকায় আধুনিক প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তি ও বৈশিষ্ট্যকে তন্ন তন্ন করে খোঁজার ধুম এখন
। আর ভারত! কত পিছিয়ে আছে। রেবেকার স্বামী শুভ্রর মতে, ভারতবর্ষ এক আধকপালে দেশ। এ দেশের বর্ণনা প্রসঙ্গে কথাকার লিখেছেন :

বুনো রামনাথের দিন গেছে। প্রযত্নে ওয়েলফেয়ার স্টেট। আর আমজনতার কাছে ওয়েলফেয়ার স্টেটের খোলা চিঠির বক্তব্য এ ভাবেই শেষ হয় : “মেনে নাও, মানিয়ে নাও।” বসন্ত তার ডায়েরিতে লেখে, ভারতীয় রাজনীতি বন্দুকের গুঁতোয় সবকিছুর সমাধান চায়। লেখক প্রশ্ন তোলেন বিজ্ঞান নিয়ে, বিজ্ঞানের ব্যবহার নিয়ে। বসন্তর বক্রোক্তি শোনা যায় : “বুলডোজারও তো বিজ্ঞান, দি আপনার বুকে চালান করে।”

শ্রুতি-বসন্তর দাম্পত্যেও সংশয় তৈরি হয়েছে। যে বসন্ত একদা ভাবত, জীবনানন্দের ‘সিন্ধুসারস’ কবিতা তার মধ্যে কথা বলে ওঠে এবং তারই অনুষঙ্গে সে শ্রুতিকে ছুঁতে চায়, সেই বসন্ত পরবর্তীতে শ্রুতিকে সন্দেহ করে। কথাকার জানান, আমাদের রূঢ় সময়ের কবিই হয়তো বলতে পারেন কেমনটি এই সিন্ধুসারস আর বাবুল কেনই বা পৃথিবীতে এসেছে। বসন্ত-শ্রুতির সম্পর্কের জট-জটিলতা তবে কোন গোত্রের? বসন্ত রেবেকাকে স্পষ্ট জানিয়েছিল, “আমাদের রাত্রি নেই।” ওদের যৌনজীবন নিঃশেষিত হয়ে গেল কেন? সে কারণেই কি বসন্ত রেবেকার কাছে আমিষ-রূপকথা শুনতে চেয়েছিল? তার আগে আমরা জেনেছি, শ্রুতি বসন্তর এক বন্ধুর ডায়েরি লুকিয়ে পড়েছে। শ্রুতিকে এও বলতে শুনি, “বসন্ত ভুল জেনেছিল যে সে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।” পারস্পরিক বোঝাবুঝির ভুলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে চিড় লেগেছে, এটুকু বললে তা যথেষ্ট বলা হয় না। আমাদের মনে হয়েছে, চেতন-অবচেতনের দ্বন্দ্বে বসন্তর মনে উদ্ভট ভাবনা জড়ো হয়েছে যাকে অব্যবস্থিত চিত্ততা বললে অত্যুক্তি হয় না। উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হয়, এ এক রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের জট যেন। এ জটের সবটা একসঙ্গে খোলা যায় না। রেবেকা যখন তার সমবয়সিনী বৌদিকে(পারমিতা) বসন্ত-শ্রুতির গল্প শোনায়, পারমিতাও ঠিক তখন এই রহস্য রোমাঞ্চ, জট
ইত্যাদি  কথাগুলোই বলে। কথাকার আরও একটি প্রশ্ন তুলেছেন : বসন্তবাবু কি উদয়ন ঘোষের গল্পের মতো দাম্পত্য পাল্টে নিতে চেয়েছিলেন? নাকি এ শুধুই বসন্তর ব্যক্তিগত ভাবনা? উদয়ন ঘোষের গল্প ‘কবিতার কথা অথবা ceremony of ashes’-এ দাম্পত্য পাল্টাপাল্টির প্রসঙ্গ এসেছে। আবার এ গল্পেই পড়ি এমন লাইন যাতে এসেছে লেখক রবি সেনের প্রসঙ্গ।...“কবিতা ও মলয়ের মাঝখানে ঢুকে পড়ল রবি সেন। আস্ত এক গদ্য। সম্প্রতি ঐ রবি সেনের ‘উট সম্পর্কে প্রকৃত বৃত্তান্ত’ পড়ে মলয় গদ্য সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিল এইভাবে যে, কেবল মুখের কথাই গদ্য নয়, গদ্য আসলে আটপৌরে আর্বানিটি।” রবি সেনের লেখা পড়তে পড়তে উদয়ন ঘোষের গল্পে ঢুকে পড়াটা কোনও আকস্মিক বিষয় নয়। ভাবনার সাঁকো যেন নির্মিত হয়ে আছে আগে থেকেই, কেননা উভয় লেখকই তাদের লেখায় প্রেম-দাম্পত্য-যৌনতার জটিল রসায়ন বোঝাতে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জট-জটিলতায় ডুব দেন। এ অভিজ্ঞতা আমাদের আছে।
 
কয়েকটি চমৎকার শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়েছে এ উপন্যাসে। ‘লড়াইচোর’, ‘ফুটপাতের ক্যাসেটের জঙ্গল’, ‘ইভেনচ্যুয়ালিটি’, ‘অনাবাসী অশ্রু’, ‘আমিষ রূপকথা’ ইত্যাকার কথাগুলো বেশ অর্থবহ এবং কোনও কোনওটি উপন্যাসে বিদ্রূপাত্মক আবহ গড়ে তুলতে পেরেছে। এ আবহের মাঝেই বুঝতে হবে বসন্তকে। রেবেকা তো বলেইছে, “ব্যক্তিমানুষ সময় হিসেবে কেমন যেন অসহায়...।” আমাদের মনে হয়, বসন্ত প্রবলভাবে নিউরোসিসে আক্রান্ত। শ্রুতির কথায় কোনওভাবে কি তার আভাস মেলে?



রবি সেনের দুটি উপন্যাস : রেডলাইট এরিয়ায় ক্ষমতার হস্তান্তর ও বসন্ত-শ্রুতি ব্রিগেড
রক্তকরবী/২০০৪/৫০ টাকা

No comments:

Post a Comment