রাজস্থান কার?
রানা প্রতাপের। রাজসিংহের। রানা কুম্ভের। মীরাবাঈয়ের। পদ্মিনীর। বাপ্পার। হাম্বীরের। ধাত্রীপান্নার।
কিন্তু রাজস্থান আসলে কার?
জয়পুরের রোডসাইড ধাবার মালিক যুধবীর গুলিয়ার। ট্যুরিষ্ট গাইড দশরথ শেখাওয়াতের। আমের কেল্লার মূল ফটকের পাশে বসে যিনি রোজ রাবণহাতথা তারযন্ত্র বাজান সেই প্রভুদাস ডোগরার। নাহারগড় দুর্গের অদূরে পুতুলনাচের আখড়ার ঢোলবাদক গোকুলদাস নারকার। আরটিডিসি-র হোটেলের সামনে বুটপালিশ নিয়ে রোজ বসে থাকা বলবন্ত নাগরালের।
হরিয়ানা সীমান্তের পরে আরাবল্লী পর্বত শুরু। রাজপুত নারীর মতো দয়িতের অপেক্ষায় জীবন কাটিয়ে তার সারা শরীরে বার্ধক্য আর আশাভঙ্গের ছাপ। মাঝে মাঝে যেটুকু শ্যামল কমনীয়তা চোখে পড়ে, তা দেখে ঠাহর করা যায়- একদিন সে রূপসীই ছিল।
বীরভূমি রাজপুতানার সর্বাঙ্গে পরাক্রম, ঐশ্বর্য আর রাজকীয়তার ছাপ। সিটিপ্যালেস, আর চন্দ্রমহলের সিলিং-এ সোনার কাজের মাঝে ঝলমল করে রুবি আর খুদে খুদে পান্না। রানীর মহলে বাগিচা আর ঝারোখার ছড়াছড়ি। জলমহলের রহস্যে ইতিহাসের হাতছানি। সোনা আর হাতির দাঁতে বাঁধানো তলোয়ারের মুঠে পরাক্রম আর ষড়যন্ত্রের কিস্যা। এই রাজপুতানাকে আপনি খুঁজে পাবেন কর্নেল টডের অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিস এর পাতায়, পাবেন অবন ঠাকুরের রাজকাহিনীতে (সৃজিতের নয় আবার তাই বলে!!!!!!!!)।
যে রাজপুতানাকে আপনি কখনও জানেননি, দেখেননি, তাকে আপনি রানাদের গৌরবগাথায় পাবেন না। তাকে কিল্লার পরিখা প্রাকার শিশমহলেও পাবেন না। তাকে পাবেন গাইড দশরথের ঠেকনো হিন্দিতে। তাকে পাবেন জয়পুর দিল্লি কানেক্টরের পাশে নির্মল ধাবার যুধবীর গুলিয়ার দেশি হুঁকোর তামাকের কড়া সুবাসে। তাকে পাবেন কোনও আম হাভেলির আঙিনায়, পিপল এর ছায়ায়।
টুরিস্ট মনোরঞ্জনের জন্য প্রভুদাস রোজ এসে বসেন আমের কেল্লার সিং দরজার পাশে। ভিড়ের মন রাখতে তাঁকে রাবণহাতথায় তুলতে হয় বলিউডের চটুল সব গানের সুর। তিনি আক্ষেপ করছিলেন কিছুদিন বাদে তিনি হয়তো ভুলে যাবেন দাদামশায়ের কাছে শেখা মেঠোসুর। "সবই নসীব বাবুমশাই। ছেলেটা আইসক্রিম বিক্রি করে শহরে। নাতিটাকে নিয়ে আসি এখানে। সে ব্যাটার মন নেই। আজকালকার ছেলেরা গাঁও কি ধুন শুনতে চায় না।"
গাইড দশরথ শেখাওয়াত নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। দেখলে বোঝা যায় না, স্থানীয় ইতিহাস আর কিংবদন্তীতে তাঁর ঝুলি বোঝাই হয়ে আছে। আমের কেল্লায় 'যোধা-আকবর'-এর আর নাহারগড়ে 'শুদ্ধ দেশি রোমান্স'-এর শুটিং স্পট ট্যুরিস্টদের দেখিয়ে তাঁর দিন চলে। আমেরের জোতদার ভারমল ছেলেপুলের রানা আর সিং হয়ে ওঠার গল্প যেই শুনতে চাইলাম, খুশিতে দশরথজীর চোখ ঝকঝক করে উঠল। সামান্য উত্তেজিত সুরে বলতে শুরু করলেন— "কী বলি স্যার, আকবরকে মেয়ে দিয়ে আমেরের জোতদার আমেরের রানা হয়ে গেল। সোয়াই জয়সিং ঔরংজেবের পা চেটে আর সোয়াই মাধোসিং ব্রিটিশকে তেল দিয়ে ইতনা বড়া রাজা বন্ গয়া। সোয়াই রামসিং প্রিন্স আলবার্টকে স্বাগত জানাতে পুরা জয়পুরকে গুলাবি রঙে রাঙিয়ে দিল।" একটানা
কথা বলে একটু হাঁফ ধরে গেছিল বোধহয়। সামান্য দম নিয়ে ফের বললেন, "এই যে নাহারগড় কিলার প্রাচীর থেকে নীচে দেখছেন, ওখান থেকে পাথর নিয়ে আসত হুকুমবরদাররা, ঠেলে ঠেলে পাত্থর তুলতে গিয়ে কত লোকের বেবক্ত মৌত হয়েছে তার কোনও হিসেবে নেই বাবু। তব যাকে ইয়েহ কিলা বনা।" গোটা জয়পুর দেখিয়ে এনে দশরথ শেখাওয়াত বিদায় নিলেন রাজপূত গৌরব আর রাজপুতানার মাটির ছেলেদের দ্বন্দ্ববিদীর্ণ দোলাচলে। এই দোলাচলে সারা জীবন কেটে যাবে তাঁর। দশরথ আবার ফিরে যাবেন আমের কিলার চত্ত্বরে। আঙুল দিয়ে দেখাবেন নীচের বাগিচা— "দেখিয়ে
বাবুসাব, ওহি পর হুয়া থা যোধা-আকবর কি শুটিং। বহত ফেমাস প্লেস হ্যায় ইয়েহ তো, সিন্স ১৫৪৯।"
গোকুলদাস নারকা লোকটি হাসিখুশি। কেল্লার এক্সিটের একধারে বসে পুতুলনাচের সাথে রাজস্থানি ঢোলক বাজান। মুখে হাসি রেখেই বলছিলেন, "পুতলার
নাচ আজকাল কেউ দেখেনা বাবু, ওহ আপলোগ ক্যা খিঁচতে হো, হাঁ সেলফি, সব সেলফি তোলে। আচ্ছা হি হ্যায়। আসলে জানেন সাব, এই ঢোল-করতাল বড়ি আসান নেহি ঠিকসে বাজানা। এক উম্মর নিকল জাতি হ্যায় উস্তাদ বননে কে লিয়ে।" কথা বলতে বলতেই হঠাৎ ঢোলে বোল তুললেন গোকুলদাস। একদল বিদেশী এসে খচখচ ছবি তুলতে শুরু করেদিল। তাদের যাওয়ার পর দেখি, পুতুলনাচের ছৈ-এর সামনেটায় অনেকগুলো একশোটাকার নোট জড়ো হয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ টিপলেন গোকুলদাস। তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সময় কোথায় টুরিস্ট সিজনে?
আরাবল্লীর বুকের উপরদিয়ে ফিরতে ফিরতে রাজস্থানকে যখন বিদায় জানালাম, তখন অবন ঠাকুর আর কর্নেল টড আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছেন, রাজকাহিনীর পাতায় পাতায় জায়গা নিচ্ছে নতুন গল্প। সেইসব গল্পে নায়করা কেউ রানা নন, রাজা নন, তাঁরা রাজপুতানার মাটির সন্তান। তাঁরাই রাজস্থান।
No comments:
Post a Comment