ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday 22 April 2018

শ্রীখোল ও আতরের শিশি, তবু : ইন্দ্রজিৎ রায়

ছবি : Paulo Guimaraes
ড্রাগন ড্রাগন খেলা সেবার নতুন, কে ড্রাগন হবে, তার পিঠে অন্যেরা উঠবে, তখন তো ছেলেমেয়ে একইসাথে খেলতাম, গিল্লি ডান্ডা, কিতকিত, পরে তেঁতুলবিচি নিয়ে খেলতে গিয়ে প্রদীপ তো জাগলিং শিখে রীতিমত প্রোগ্রাম করতে লাগল, পুকুরটার ওপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে সাইকেল নিয়ে আসতে আসতেই আমার সহপাঠি, মুরারকা গ্রামের ছেলে গজেন, কাজলের প্রেমে কাৎ হয়ে পড়ল, কাজল এদিকে আমাদের অধ্যাপকের মেয়ে, তাঁর কাছে আবার আমরা টিউশন পড়তেও যেতাম, কাজল কখনওবা আসত বাবাকে চা দিতে, গজেন আমার পাশে বসে উদ্বেল, আমি মন দিয়ে অতনুবাবুর পড়া শুনছি, পাশ দিয়ে রাতকাহানির মতো ভেসে যাচ্ছে গ্রামজীবনের এঁচোড় কষা, তার চাপা রসুনের ঝাঁঝ, তোমার লাল রঙের বাড়ি, যাতে পরে তুমি ঠান্ডামেশিন লাগিয়েছিলে, সেটা নিয়েও বিবাদ হয়েছিল, আসলে কিছু বিবাদ একধরনের বিষক্রিয়ার মতো, আস্তে যা ক্ষয় করে যা করার নয় তাকেই, চিঠি লিখে আত্মহত্যার সুযোগ সকলে পায় কি, এটা নিয়ে একটা কবিতা ছিল হিরণ্যর, তরুণ কবি থাকতেই সে একটি বড় কাগজের সম্পাদকের নেকনজরে পড়ে, কিন্তু কপাল, ওঁর চাহিদা মতো মাল ও সাপ্লাই করতে না পারায় সে চাকরি চলে যায়, তবু সেই বড় কাগজের নাম ভেজে ও একটা কবিতা সেন্টার খুলে নেয়, স্টেশনের কাছে, সেখানে কবিতা লেখা থেকে আবৃত্তি, সবকিছু শেখানো হয়, অডিও ভিশুয়াল পদ্ধতিতে, কিন্তু মাঝখান থেকে ডায়বেটিস যে হিরণ্যকে নিয়ে যেতে পারে এক অন্য ছাপাখানায় একথাটা হয়ত তেমন ভাবে নি কেউ, 
ঘন, কালো মেঘ আর হাওয়াতে ভরে আছে এই শহর যখন, জৈষ্ঠের শেষ, এই শহরতলি আমি বাইরে থেকেই দেখে এসেছি, এখানকার সবজান্তা, চালাক চালাক সব মানুষ, তাদের মুখচোখের অসার সেয়ানা ভাব, অনিঃশেষ মাল মেটিরিয়াল কেনার বাসনা, এসবই যে কোনো সংবেদনশীল রোগে আক্রান্ত মানুষের মরে যাওয়া, সে কিছুতেই মেলাতে পারে না সুস্থ, সফল মানুষের এই উদ্ভাস, তারাও এই বেদনকে নিয়ে শ্লেষ করতে ছাড়ে না, তার সম্পাদকের চিঠি আসে বিদেশ থেকে, তিনি সাবধান করেন, হাঁদু, এসব করিস না, খেতে পাবি না, কী দরকার তোর লোকের সঙ্গে লাগতে যাবার, কিন্তু সেই কুকুরটা, যাকে গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কারণ সে ২৭ জনকে কামড়ে দিয়েছে, তার মুখের যে অভিব্যক্তি, ভোউ ভোউ, আমি পাগল নই, তার মধ্যে সে ক্রমশ নিজেকে দেখতে পেতে থাকে

পাড়ায় পাড়ায় লালপার্টি করা ছেলেরা রাতারাতি জার্সি বদল করেছিল, হিরণ্যর সামনেই, ওর কাকাকে দেখেছিল এক পুলিশ বুট দিয়ে পাঁজরগুলো ভেঙে দিতে, না এর পরেও হিরণ্য তেমন কিছু করেনি, কবিতা লিখেছিল কটা, আর হ্যাঁ মাঝেমাঝে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে, রাস্তার শব্দে ওর এই খিস্তিগুলো চাপা পড়ে যায়, না হিরণ্যের কথা বলতে আসিনি, ওর কথা বলার জন্য অনেক লেখক কবি কাগজ আছেন, যারা নিয়ম করে স্মরণসংখ্যা প্রকাশ করে এই মনে রাখা ভুলে যাওয়ার খেলাটাকে বাঁচিয়ে রাখে, আমি কি ভালো হব? মেয়েদের মা বোন ভাবব, ভিড় বাসে কোনো নধর শরীর দেখলেও গা ঘেঁষে দাঁড়াব কি, সবাই বলার পরেও কেন বুঝতে পারছি না যে আমাকে ঠিকঠাক হয়ে উঠতে হবে...

বাড়ি ফিরছি, গতকাল বিকট ঝড়জল গেছে, খুব ভালো হয়েছে, দু'চারটে তৈরি হচ্ছে এমন পোমোটারি যদি পড়ে যেত, খুব ভালো হোত, পোমোটিং বলে যে পেশাটা তৈরি করা হয়েছে, সারা শরীরের ভেতর যেন একটা গা ছমছমে চুপ, যেন ভেতরের যন্ত্র সব ঘুমিয়ে, গাড়ি ছুটছে ৩২ নম্বর হাইরোড দিয়ে, ভেতরে বিড়ি সিগারেট, গাঁজা ও মাথার শ্যাম্পুর এক অদ্ভুত মিশ্রণ, গান চলছে গাড়ির পেছনে, ভালো হতে হবে, বড় এবং সুস্থ, কামাতে হবে, এটা শুনলেই রামবাবা খেপে বলত আরামের মধ্যেই কেউটে সাপ বসে আছে, ভক্ত বিছুটি, ছুঁলেই কারেন্ট মারবে...

যখন পায়ের পেশীগুলো খুলে যাবার মতো হয়ে আসত আমি আর বিশু সিংমুড়া বাড়ির সামনে নিমগাছটার নীচে, এই বিশু আমাকে কলেজ বিড়ি চেনায়, এবং ফিল্টারহীন পানামা সিগারেটগুলো চেনায়, সমস্ত লেখাই কেউ কেউ পড়বে ভেবে যখন লেখা হতে থাকে, বৃষ্টির দিন এবং চৈত্রশেষের পাতাপড়ার যে রসায়ন শহরতলি দিয়েছে, তেমন আর হয়নি এবং যেটা হয়েছে তা হল যে মৃত জেনেও প্রতিদিন সকালে চুল আঁচড়ে, দাড়ি কেটে আমি ওখানেই ফিরে যাই, ওখানেই, আজ হঠাৎ সাগ্নিক ইউথ্যানাসিয়া শব্দটা বলল, সিঁড়িতে দেখা, বাকি সিঁড়িটা একা নামতে নামতে মনে পড়ল বিশ বাইশটা বছর, চিঠি আসা এবং না আসা, হাওড়ার অচেনা গলিতে তোমাদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে কবিতাপাঠরত আমার ছেলেবেলার প্রায় অবলুপ্ত গাদাবন্দুক ঝোলানো বাড়ি, মিথ বলে যে ব্যাপারটা আছে, সেটা আমার গায়ে সাবানের, ছোবড়ার মতো আমার মাতামহী ঘষতেন গায়ে পিঠে, ভুল কি ঠিক আমি তো জানি না, বোতাম টেপা যে দিন ও পাল্টে যাওয়া কন্ঠ মানুষের, একবার যেতে দেওয়ার পর আর না ফিরে আসা, অবসাদ খুঁজে পাওয়া দিন, জ্যামিতি মন দিয়ে না শেখার ক্ষয়, সামনে আরও একটা দিন, তারপর হয়ত আরও, আতরওয়ালা, তার দমচাপা গলি ফলে কোনো সময় নেই আর, শহুরে বিষাদ থেকে দূরে যেতে হবে, প্রকৃত দুঃখ ও শব্দের কাছে, মরে যাওয়া যায় এমন সব বিকেলগুলো কি ডাকেন আজও, ডাকেন? কমিক্স কিনতে যাব, আজকে, জামাটা হাতে নিয়ে মাথাটা একটু টাল খেলো, অকস্মাৎ 

সুইসাইড নোট লিখে ক্ষান্ত হন উনি, যদিও ওটা আর শেষে করা হয়নি, তাহলে এটা কী? মনোবিদের চেম্বারের পেছনে মাঠ, সেখানে ততক্ষণে চক্র বসে গেছে, সাধন ভজনের, উল্লাসের সেই করাল চাপা ডায়রির গায়ে গতকালের চা রক্তের মতো, ঝলমলে, উত্তরবঙ্গর সেই ঝল্লমল্ল নাচের মতো, হিরণ্যকে মনে পড়ল এসময়ে, অকারণে, সারল্য কি মানুষকে ঠেলে দিতে পারে? অন্যদিকে? প্রশ্নহীন, রোগবালাই মুখর একটি জীবন অভিমুখে পুনরায় নিজের ঝোলা কাঁধে বাঁকাশ্যামদার বাড়িঘরের দিকে, গেছিলে? 

বদলে যাওয়া মানচিত্রে, চিত্রাবলি, শিশুদের অনুপস্থিতি যা ক্রমশ এক অসুখের মতো, কী করবে এখানে হিরণ্য বেঁচে থেকে, ভাতের হোটেল ও ভাঙা মেলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, নব্বইয়ের কবিতা যা এখন দূরাগত গানের কলি মাত্র, অন্য কাজ করতে গিয়ে যা কানে আসে অকস্মাৎ, ওগুলো আমি লিখেছিলাম, ওই অনুভূতিশূন্য, বাহারি শব্দমালা - মানুষ দৌড়ে যায়, প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে নেয় কাতর চোখ শিক্ষিকাকেও, যিনি সব হারানো শিশুগুলোর আলো, এগুলো কী? সুইসাইড নোট তো এমন হয় না দেখতে, মনোবিকলনশাস্ত্র বলেও কিছু আছে? কতটা হয়? *#@:ওহ আবারও ভুল টাইপ করছি, মাঝরাতে, কী লিখতে গিয়ে কী লিখে ফেলছি, মনোবিকলনশাস্ত্র, ইচ্ছামৃত্যু, নাকি ইচ্ছার মৃত্যু, কোনটা যে কী, বুঝতে গিয়ে ক্রমশ পাথর হয়ে যাচ্ছে চোয়াল, ঝুঁকে পড়ছি রঙিন মানচিত্রের দিকে, কলম হাতে, যেন মৃত্যুভয়, ভয়ের গলি থেকে ডাক আসছে রোজ

একটা পাখির কথা ভাবতে গিয়ে হিংস্রতার কথা ভুলে, কী পাখি ছিলিম ওটা, কিছুতেই মনে পড়ে না, সন্ধের মুখে যখন তিনমাথার মুখে দাঁড়ায়, তেলেভাজা সব ফিরতে থাকে, আরও কালো হয়ে হিরণ্য ও তার বন্ধুদের ধুলো সংলগ্ন সৃষ্টিনাশ দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম একদিন, ব্যাস ওই দাঁড়িয়ে থেকে যেতে পারে কেউ, তাদের জন্য সমস্ত উত্তাপ অপেক্ষা করে কোথাও, জালি মনোবিদ আমার মাতামহের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলছেন, সেশনের পর সেশন চলে যাচ্ছে, দাদুর মনোবিকলনশাস্ত্র আড়া ঝাঁপতাল যেন, দাদু ভুলে যাচ্ছে সব, গভীর একটা মাঝরাতে হঠাৎ দাদু, আচ্ছা, আমার গুরুদেবের নাম কী, বলো তো, না, আমারও কী হল, বললাম, কাঠিয়া বাবা মনে হয়, রামদাসজী, দাদু একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে শুনে যে গেলেন, আর ফেরেন নি, হোম ডেলিভারিতে খেয়ে খেয়ে, শুন্য বৃষ্টির দুপুরগুলোতে বিনয় মজুমদারের কবিতা অজস্রবার পড়ে, মাঠের আড়াআড়ি আলোটাকে অনুসরণ করে বাড়ি ফিরতে থাকে বিয়েবাড়ির হাসি, দুধসাদা, থকথকে ভয়, আরও জোরে হাসি আড় ও বোহাইল ধানের খেত দেখে, কী করে কাঠিয়া বাবার নামটা মনে এল, আমি পরিচিত ছিলাম না এই নামটির সঙ্গে, হলাম একটু, দাদু আর কিছু বলেন নি বিশেষ, কাপড়ও ত্যাগ করলেন, শেষের দিকে, মনোবিদ কোনো পেপারওয়েট আমাকে দেন নি সেদিন স্মৃতি হিসেবে, প্রতিবার দেন, তবু মাতামহের ওই আস্তে মিটে যাওয়া, যেন ইচ্ছামৃত্যুর একটা টানেল খুলে যায় মাথার বালিশের পাশে, মাথা ঘোরাতে একটা ফাঁকা তন্তুক্ষয়, একে একে পানদোকান, ঝটাপট শব্দে খুলতে থাকে, এইসব মনোবিদ, তারা কি এটা বোঝে? তারা কি তারা বোঝে? মাতামহের ফাঁকা বাসা, রাতপাহারা, আমন চাষের, পোকা মারার সব গল্পের মাঝেই মাতামহের ইচ্ছামৃত্যু খেলাটা, শেষ ঝিমুনির মতো, মাথাটা একবার তুললাম, শেয়ালদা ঢুকবে গাড়ি

No comments:

Post a Comment