ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday 22 April 2018

কেন এই অাত্মহত্যা : সমরজিৎ সিংহ

ছবি : Vadim Filimonov
আত্মহত্যা একটা প্রক্রিয়া, যা আত্মহত্যাকারীকে সকল গ্লানি থেকে মুক্তি দিতে পারে। আত্মহত্যা এক নীরব প্রতিবাদও। যে প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়নি নানা কারণে, আত্মহত্যা করে, সে প্রতিবাদ করা যায়।

এরকমই ভাবতাম আমি। এখনও যে ভাবি না, তা নয়, ভাবি। আমি, নিজেই, চার চারবার আত্মহত্যা করেছি। আমার এই জীবন মূলত এক আত্মহত্যাকারীর, যে আপোষ করতে পারেনি অনেক কিছুর সঙ্গে, অনেকের সঙ্গে।

আমার প্রথম আত্মহত্যা ছিল বাবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। আমার বাবা আমাকে, আমার মা-কে ভালোবাসতেন না। এখন বুঝি, উপলব্ধি করি, ভালো না বাসাও এক অধিকার। তখন বুঝতাম না। কতই বা বয়স হবে আমার? ক্লাস ফাইভ। পুজোর সময়। আমাদের বাড়িতে প্রতিবছর দুর্গাপুজো হত। সে ঠাকুরদা, তস্য ঠাকুরদার আমল থেকে। পারিবারিক পুজোর মজা আলাদা। পরগণার লোক মান্যি করত। ঐ সমীহ আমার বাবার প্রচণ্ড দাপটের জন্য, না কি বংশসূত্রে, কোনো এক কালের রাজরক্ত বাবার শরীরে বইছে বলে, বুঝতে পারতাম না। মোদ্দা কথা, সবাই ভয় পেত বাবাকে। আমিও। 

মা, আমাকে নিয়ে, আলাদা থাকতেন। এখন যাকে সেপারেশন বলা হয়, সেটা মা তখনকার সময় করে দেখিয়েছিলেন। তিনি নিরক্ষর, কিন্তু স্বাধীনা। বাবাকে বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে, ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে, বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সব সম্পত্তি, স্থাবর-অস্থাবর, সব। 

বাবা প্রতারণা করেছিলেন মা-র সঙ্গে। রাজরক্ত যার শরীরে বইছে, তিনি বহুগামী হবেন, এতে কেউ কিছু মনে করত না। মা-কে বিয়ে করা, পরিত্যাগ করা, এসব, ফলে, তাকে মানে বাবাকে বিচলিত করেনি। তাছাড়া, মনিপুরী সমাজে তখন বহুবিবাহ জলভাত। 

তো বাবাকে পছন্দ করতাম না কখনও। তিনি আমার সৎ ভাইবোনদের আদর করতেন, আমাকে নয়। কষ্ট পেতাম খুব।
সেবার, পুজোর সময়, সকল ভাইবোনের জন্য বাবা আনলেন নতুন জামাকাপড়। আমার নেই। তিনি সকল ভাইদের হাতে তুলে দিলেন খেলনা পিস্তল। আমার হাতে নয়। 

রাগ হচ্ছিল খুব। মা-কে বললাম, এ কেমন বাবা আমাকে দিয়েছ তুমি? আমার জন্য কিছুই আনেননি? 

সারাদিন খেলাম না। সম্ভবত, পঞ্চমীর দিন। সন্ধেবেলা ঠিক করলাম, মরে যাব। মরে, ভূত হয়ে, বাবাকে শাস্তি দেব। শোধ নেব। 

কাকাদের গোয়ালঘর থেকে একটা দড়ি নিয়ে, অন্ধকারে, চলে গেলাম বাড়ির পেছনে, মহাদেবের থানের কাছে যে আমগাছ আছে, সেখানে। ঐ আমগাছটিই ছিল আমার বন্ধু, যার কাছে সব কথা বলতাম। যাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতাম দিনের পর দিন। 

শিবের থান পার হলেই মনু নদী। আমার আর এক সহচরী। আমগাছে উঠবার আগে, নদীর দিকে তাকালাম। মরে গেলে, তাকে আর দেখতে পারব না। খেলতে পারব না। ভাবতে ভাবতে, এগিয়ে গেলাম তার দিকে। এ সময় নদী পূর্ণযৌবনা, তার রূপ অবর্ণনীয়। কাছে গিয়ে বললাম, আর কোনোদিন দেখা হবে না আমাদের। 

কেন? কলকল তার ধ্বনি। বলল, কেন দেখা হবে না, শুনি?
আমি আজ মরে যাব। এই পৃথিবীতে আর থাকব না।
কেন? কী হয়েছে তোমার?

কতক্ষণ কথা বলেছি, জানি না। খেয়াল করিনি। হঠাৎ লক্ষ করলাম, পাড়ার সব লোক ছুটে আসছে আমার দিকে।
ঐ তো, ঐ যে...
সমরজিৎ...
কী করছ তুমি?
ঝাঁপ দেবে না, সমরজিৎ, তুমি সাঁতার জানো না, ডুবে যাবে। 

টর্চের আলো, হ্যাজাক লাইট, প্রচুর লোক। দেখলাম, মা আসছেন। বাবা আসছেন।
বললেন, ঝাঁপ দেবে না, আমি কালই, তোমাকে জামাকাপড় কিনে দেব। 

আমি কি ঝাঁপ দিচ্ছিলাম ভরা নদীতে? আমি তো, দড়ি হাতে, এসেছিলাম আমগাছের কাছে, তার ডাল থেকে ঝুলে পড়ব বলে। 

আমার প্রথম আত্মহত্যা এভাবেই বিফলে গেল। সত্যিই কি গেল? না হলে, বাবা ঐ রকম বললেন কেন? 

কিন্তু যে তরুণী বধূ, দুপুরবেলা, তার ঘরে ডেকে, আমি পৌঁছবার আগে, বাড়ির পেছনে, ছোট্ট কাঁঠাল গাছে, ঝুলে পড়েছিল, সে কী বলতে চেয়েছিল আমাকে? কী তার দুঃখ ছিল ?

No comments:

Post a Comment