ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday, 22 April 2018

ভীষ্মমৃত্যু : ঈশানী বসাক

সূর্যের উত্তরায়ণের পূর্বে আমি দেহত্যাগ করব না, বলেছিলেন মহামতী ভীষ্ম। নিজের শরীরের অধিকার ছাড়েননি। শত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে নির্দিষ্ট করেছিলেন আসা যাওয়ার পালা। আমাদের মৃত্যু বড় আকস্মিক, অস্থির। যেন খরস্রোতা নদী। অর্গলহীন ভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের নুড়ি পাথরের মতো।
"ফাড্ডিল পাথর বিচুরিল বজ্রনাঁদে
মুকল ণই বাহী তহি কলঅল সাঁদে"

ইচ্ছামৃত্যু মানে আত্মহত্যা নয়। নিজের শরীরকে বিদায় জানাবার সঠিক প্রস্তুতি। তার অপভ্রংশ আত্মহত্যা। শত পুত্রের মৃত্যুকে মেনে নিতে না পেরে মহামহিম বশিষ্ঠ মৃত্যুর কাছে যেতে চেয়েছিলেন। বুঝতে পারেননি যে ইচ্ছামৃত্যুর কিছু নিয়ম আছে। আবেগ নয় তা ঠিক করতে হয় মস্তিষ্ক দ্বারা। যেমন ভীষ্ম নিজের মৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন যেদিন তিনি অনুধাবন করেছিলেন তার কাজ শেষ হয়ে এসছে। শোক ছিল অবশ্যই তাঁর। তবে সে তো বহু আগে থেকেই। যেদিন দুর্যোধন রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে পাশা-নির্বাচন করেছিলেন সেদিন। যেদিন কৃষ্ণের শান্তিচুক্তির প্রত্যুত্তরে দুর্যোধন বলেছিলেন এক সূচাগ্র মাটি তিনি ছাড়বেন না, তা সে যতই প্রাপ্তি হোক। অসাধারণ মতিভ্রংশ ধৃতরাষ্ট্রের, কুরুবংশের শেষ প্রদীপের প্রণিপাত কিছুই পারেনি তাকে টলাতে। তিনি ঠিক সেই লগ্নকে বেছে নিয়েছিলেন যেদিন যুদ্ধশেষে কেউ ন্যায় পেয়েছিলেন। ক্লেশজনিত কারণে আত্মহত্যা পাপ তা শাস্ত্রমতে লেখা। দাবানলে যখন ধৃতরাষ্ট্র আত্মাহুতি দেন তখন গান্ধারী এবং কুন্তী তাকে অনুসরণ করেন। সহমরণ নয়, জীবনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে সত্যই তাই শরীরের অধিকার প্রকৃতিকে দেওয়া উচিত তাঁরা মনে করেছিলেন। 

জীবনে আত্মহত্যার কথা ভাবিনি, ইচ্ছামৃত্যু ভেবেছি। তবে কেমন হত তুমি বলো তো? এ প্রশ্ন ভীষ্মকে পড়ে এসছে। আমি তাই ইচ্ছামৃত্যু বলিনা। বলি ভীষ্মমৃত্যু। অধিকারবোধ স্থানান্তরের আরেক নাম শরীর। সত্যি করে বলুন তো কেউ কখনো কি ভাবেননি আমি ছাড়া এ পৃথিবী কেমন। জানি অস্বীকার করবেন তবু বলছি। পাগলের প্রলাপ ভেবে সহ্য করে নেবেন। বড় অসহ্য লাগবে তাই ক্ষমা চাইলাম। আমরা সবথেকে বেশি নিজের মৃত্যুর কথায় পুলকিত হই নিজের প্রিয়জনের সঙ্গে থাকাকালীন। কল্পনা করি আমি না থাকলে ও কী করবে। চোখ দিয়ে জল বয়ে গেলে এক বিষাদাচ্ছন্ন পাহাড় নেমে আসে। তখন নিজেই নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করি, করুণভাবে প্রশ্ন করি, "মথুরা নগরপতি কাহে তুম গোকুল যাও।" বৈধ কে জানি না। তবে আমাদের চেতনার রঙ অবৈধ বৈধ এসব মানেনা। বড় অবাধ্য সে। এই দুঃখবিলাসের পর আমরা ভাবি নাহ্ সে বড় কষ্ট পাবে। তাই এহেন যেন না ঘটে। ব্রহ্মার ক্রোধ থেকে মৃত্যুর জন্ম। তার কত রূপ। এই দেবীকে নিয়ে আমাদের পাপ পুণ্যের হিসেব মেলাই। ভীষ্মমৃত্যু পাওয়ার আবেগে পড়ে থাকি ভেন্টিলেশনে। নিজের হৃদয় চেপে ধরে তাকে বলি ছেড়ে দেব না। উত্তরায়ণের লগ্ন পেরোয়। আমাদের চলে যাওয়া হয় না। শরীরের উপর অধিকার নিতে গিয়ে আমরা আত্মহত্যাকে জেতাই। সব কিছু মৃত্যুর মতো শেষ নাকি শুরু? উদ্বেগ জমাচ্ছি না। চলে যাওয়ার ভারসাম্য রেখে ছুটি। আজ হয়তো শেষ দিন। আরেকবার খালি সূর্যোদয় দেখে নিই।

No comments:

Post a Comment