ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday, 22 April 2018

দিল্লি ডায়রি : রিমি মুৎসুদ্দি



ডাগলাস্ ডাবল ইঞ্জিন সাতঘন্টা আকাশচারণের পর উইলিংডন এয়ারপোর্টের ভূমি স্পর্শ করত। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে অতিসন্তর্পণে আকাশপথযাত্রীরা মাটিতে নামতেন। যে সময়ের কথা লিখছি তা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের কথা। কলকাতা থেকে দিল্লি তখন সাতঘণ্টার বিমান যাত্রা। আর আপনি যদি লৌহশকটপথে যাত্রা করেন তাহলে দিল্লি এসে পৌঁছাবেন ৭২ ঘন্টায়। শ্রীরাধিকার অভিসার চিহ্নের মতো আপনার সর্বাঙ্গে লেগে থাকা কয়লার গুঁড়ো এই তিনদিনের শকটযাত্রার সুখস্মৃতির পরিচয় বহন করবে। 

দিল্লির দীর্ঘস্থায়ী বিকেলের গায়ে তখনও নরম ডিমের মতো আশ্চর্য হলুদ লেগে রয়েছে। তুফান এক্সপ্রেস থেকে নামলেন তিনজন সাহিত্যিক। সঙ্গে তাঁদের পরিবারবর্গও রয়েছেন। তাঁদের গন্তব্য টেগোর পার্ক নিউ দিল্লি।
পথের পাঁচালি-র লেখক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় দিল্লি এসেছেন তাঁর বন্ধু ও পরম ভক্ত অপূর্ব মণিদত্তের আমন্ত্রণে। সঙ্গে রয়েছেন কলকাতার সাহিত্যজগতের আরও দুই দিকপাল। মিত্রঘোষের সুমথনাথ ঘোষ ও ‘কলকাতার কাছেই’ উপন্যাসের বিখ্যাত লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্র। বিভূতিভূষণ ঠিকানাটা লিখে আনেন নি। শুধু মনে ছিল ৩৯ নং টেগোরপার্ক। 

সন্ধে নামার আগেই ঝুপ করে রাতের অন্ধকার ঢেকে ফেলে এই শহরকে। টিমটিম করে জ্বলা টেমির আলোর নীচে জমে থাকে আর ঘন অন্ধকার। বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে রাত ক্রমশ বাড়তে থাকল। পরিবারের মেয়েরা ও সহযাত্রীরা প্রত্যেকেই বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যেই এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোক ওনাদের দেখে এগিয়ে আসেন। কলকাতা থেকে এসেছেন শুনে বাঙালি বাড়িতে খোঁজ নেন। বলাবাহুল্য সেই সময়ে মানুষ বড় জড়িয়েমড়িয়ে থাকতেন। শুধু পাশের বাড়ির মানুষকেই নয়, গোটা অঞ্চলের সবাই একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাই খুব সহজেই বিভূতিভূষণের ভুল ধরা পড়ে। বাড়ির নম্বর ৩৯ নয়, ১৩৯। শেষপর্যন্ত আমাদের প্রিয় কথাসাহিত্যিক সবান্ধবে ও সপরিবারে পৌঁছে যান তাঁর বন্ধুর বাড়িতে। তার আগে অবশ্য সেই অপরিচিত পাঞ্জাবি ভদ্রলোক পথের পাঁচালির বিভূতিভূষণকে না চিনতে পারলেও তাঁদের নিজের বাড়ি নিয়ে যান। তাঁর স্ত্রী লস্যি, মক্কি দি রোটি আর সর্ষো শাক সহযোগে কিঞ্চিৎ গুরু জলখাবার খাইয়ে অতিথিদের রওনা করেন। এইভাবেই কলকাতার সাহিত্যেকের সঙ্গে সেদিন মিলন ঘটেছিল দিল্লির হৃদয়ের। যে দিল্লিতে আজ অ্যাক্সিডেন্টে বিপর্যস্ত মানুষ রাস্তায় পড়ে ছটফট করলেও চলন্ত শহরের একমুহূর্ত ফুরসৎ নেই, মুমূর্ষুকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাঁচার সুযোগ করে দেয়। সেই দিল্লিতে আজ ভুল ঠিকানা থেকে সঠিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া শুধু অসম্ভবই নয় অবাস্তব। 


ঋণস্বীকার - দৃষ্টিপাত, যাযাবর
         দিল্লির বাঙালি, চিত্তরঞ্জন পাকড়াশী

No comments:

Post a Comment