কবি কবিতার ভাবনার মধ্যে বাঁচবেন না কবিতার পরিসর ও পরিবেশ রচনায় অধিকতর গুরুত্ব দেবেন এই নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে। তাই একজন কবি যখন ৭৪ বছর বয়সে এসে তাঁর ৪র্থ কাব্যগ্রন্থ এবং ৭ম গ্রন্থ প্রকাশ করেন তখন পাঠক তাঁর কাছে কি প্রত্যাশা করবে? দিকনির্দেশ নাকি অভিজ্ঞতার গল্প? ২০০৯ থেকে জুলাই ২০১৬, এই দীর্ঘ পরিসরের কবিতাবলী থাকার ফলে কবির কবিতার গতিপ্রকৃতি এবং রচনাশৈলীর পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ রয়েছে পাঠকের কাছে। অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় - "আজ তারা নক্ষত্রের প্রতিবেশী বলে / তাদের গলায় দোলে অনিবার্য মালা", তাই বইটি হাতে পাওয়া মাত্রই মনে হল যে কবি "পাকদন্ডী বেয়ে ঢুকেছে আগুনে", তাঁর কথা যত শীঘ্র বলা যায় ততই ভালো। বইটিতে ছন্দ কবিতা, গদ্য কবিতা, শ্লেষাত্মক কবিতা থাকলেও, অলোক সামন্ত দীর্ঘদিন নাটকে অভিনয় করেছেন, পরিচালনা করেছেন, তাই কবিতাতেও তার ছাপ, এনে দিয়েছে ভিন্ন স্বাদ। দীর্ঘদিন বর্ধমান শহরে যাঁরা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বজায় রাখার জন্য শ্রম দিয়েছেন, তিনি যদি লেখেন, "তপস্যার স্বাধীনতা পেলে আকাশেও ফোটে ফুল / স্বপ্নের গভীর থেকে বাতাসের তৃষ্ণা উঠে আসে", তখন এই ভেবে খুশি হতে হয় যে তাঁর লেখায় উঠে আসা অভিজ্ঞতা শ্রমের ফসল। যদিও তাঁর মধ্যে তৎসম শব্দপ্রয়োগের এক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পয়োধিমন্থন, অনশনক্লিষ্ট, প্রমোদপ্রিয়, হৃদয়প্রদেশে ইত্যাদি বড় শব্দের প্রয়োগ বর্তমান সময়ের নিরিখে কবিতাকে একটু শ্লথ করেছে ঠিকই কিন্তু প্রয়োজনের দিকেও কবির সজাগ দৃষ্টি। পেশায় শিক্ষক ছিলেন, বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকাও পরিলক্ষিত হয়। যখন ছাত্র, মহম্মদ জাফর এর অকালমৃত্যু নিয়ে তিনি লেখেন, বা লেখেন, "খুব ভালো করে টেরি বাগাই / সেজন্য আয়নার দরকার পড়ে না...প্রত্যেক কর্মীর দিকে তাকিয়ে দেখি / প্রত্যেকেরই চোখ আয়না হয়ে আছে / বহুদিন পর নিজেকে ভালো করে দেখলাম"। বর্তমান কম্পিউটারের ব্যবহারের মধ্যে ডুবে যাওয়া প্রজন্মের প্রতি তাই শ্লেষ আসে, "অনর্ঘ অর্ঘ দিলে চাঁদের লোভনীয় হাসি / কম্পিউটারে তার বাঁধ ভেঙে যায় / অনিচ্ছা থাকলেও ঢালো গন্ধের সুধা / উপচিয়ে পড়ে তার ফ্লাওয়ারের ভাস", আর তখন আসে ছন্দের প্রয়োগ। দাদা ঠাকুর 'বোতল পুরাণ' লিখেছিলেন ছন্দে। ছন্দে বা ছড়ায় শ্লেষ কি ভালো ফোটে? হয়তো বা। কিন্তু একাধারে নাট্যকারের কলমে শ্লেষ এবং সমাজভাবনা অন্যভাবেও আসে, "পথের একপাশে শুয়ে আছে তিন জীব যাদের প্রত্যেকেই হারিয়েছে জীবন অথচ কী ভীষণ জীবন্ত সবাই...তিনটি মৃতদেহ যথাক্রমে একটি সবুজ গাছ, একটি বাবুই পাখি / এবং এক কারখানার শ্রমিক"। 'অনাবাসী নাগরিক' কবিতাটি একটা ২৮ লাইনের নাটকই মনে হয় যেখানে মানুষ মেকআপ ছাড়াই বুঝিয়ে দেয় তারা কার চরিত্রে অভিনয় করছে এবং সে চরিত্ররা বুঝিবা "তবে অভিনয় ছাড়া আমি কিছুই করিনি" এমনই এক স্বীকারোক্তি দিয়ে বসে। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন সহধর্মিণী শ্রীমতী প্রভা সামন্ত, গ্রন্থের নামের সাথে সাযুজ্য রেখে। মুদ্রণপ্রমাদহীনতা হয়তো তাঁর শিক্ষকতা করার ফসল। আজীবন নিপাট ভদ্র অথচ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক মানুষের কাব্যগ্রন্থটি তাই শুধু অভিজ্ঞতা নয়, পরিশ্রমী যাপন ও বিশ্বাসের ফসল।
কবি : অলোক সামন্ত
কাব্যগ্রন্থ : কুয়াশার ছবি
বিনয় প্রকাশনী
১০০ টাকা
No comments:
Post a Comment