জীবনে
দু'বার 'অস্বীকার' থেকে 'নতিস্বীকার'-এর অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।
প্রথমটি
গান
সম্বন্ধীয়। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত। ছোটবেলা থেকেই ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল মিউজিক আমার অসহ্য লাগত। অন্য অনেকের মতো আমিও ভ্যাঙাতাম। কী যে সব 'আআআআআ' করে গলা কাঁপিয়ে পাগলের মতো গান করেন লোকজন...এমনটাই ভাবতাম। বিরক্ত লাগত। আমার এই কথা শুনে আমার ছোটমেসো একদিন বলল – "কখনও শান্ত হয়ে মন দিয়ে শুনেছিস?"... দু'দিকে মাথা নাড়লাম। মেসো আবার বলল – "একদিন চুপ করে বসে মনকে কনসেন্ট্রেড করে শোন। প্রথমে বিরক্ত লাগবে, কিছুক্ষণ পরে দেখবি কোথা দিয়ে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারবি না।" নেহাতই এক্সপেরিমেন্ট
করার
জন্য
আমি
রাজি
হয়ে
গেলাম। মেসো চালিয়ে দিল শ্যামকল্যাণ রাগ। আমি চুপ করে বসলাম। প্রথমে হাসি পেল। তারপর মাথাটা ভার হয়ে এল। তারপর...মাথাটা ছেড়ে গেল...যাবতীয় জাগতিক বাস্তবতা থেকে, না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে, ছুঁতে না পারা স্বপ্নগুলো থেকে দূরে আমার ভাবনা ভ্রমণ করতে শুরু করল তার নিজস্ব জগতে, যেখানে নিজেকে গোটা ব্রহ্মাণ্ডের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মনে হতে লাগল, মনে হল আমার মনের দরজাগুলো খুলে যাচ্ছে, হাওয়া ঢুকছে, আলো ঢুকছে...নিজেকে ফিরে পাওয়ার আলো। শুনতে শুনতে ঘোরে চলে গিয়েছিলাম। এক অপূর্ব ঘোর। সেই ঘোর যখন ভাঙল, তখন দেখলাম অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে আর আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে জল পড়ছে...
দ্বিতীয়
অভিজ্ঞতা
রবীন্দ্রনাথের
লেখা
নিয়ে। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা এবং অন্যান্য বই পড়ার সুবাদে রবীন্দ্রনাথের
লেখার
সঙ্গে
আমার
ভালোই
পরিচয়
ছিল। তবে আশেপাশের কিছু টিপিক্যাল 'রবীন্দ্র-অনুরাগী'দের রাবীন্দ্রিক ন্যাকামির কারণে হোক বা অল্পবয়সের অস্বীকার-প্রবণতা...রবীন্দ্রনাথ আমার খুব একটা পছন্দের লেখক ছিলেন না। তখন আমি জীবনানন্দ, শক্তি, বিনয়, সন্দীপন-এ মগ্ন। বিপদে পড়লাম এমএ পড়তে এসে। সিলেবাসে আবার একগাদা রবীন্দ্রনাথ। একদিন দুপুরে বাড়িতে বসে সিলেবাসে থাকা 'অচলায়তন' নাটকটি পড়লাম... এখনও মনে আছে নাটকটি পড়া শেষ করে জানলা দিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে বসে ছিলাম। নিজেকে কেমন শূন্য লাগছিল, বিরাট প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের যেমন নিজেকে শূন্য মনে হয়, ঠিক তেমন...তারপরের দিন পড়লাম 'রাজা', তারপরের দিন 'লিপিকা'...রবীন্দ্রনাথ যেন আমার হাত ধরে আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর রচনার গভীর তলদেশে। আমি, যে কিনা আগে ওপর ওপর পড়ে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখে এসেছি সেই আমি এবার বাধ্য হলাম ঢুকে পড়তে তাঁর সাহিত্যভাবনায়। আবিষ্কার করলাম রবীন্দ্রনাথকে,
এমনকী
নিজেকেও। এইরকম একই অভিজ্ঞতা আমার বন্ধু বিশ্বদীপেরও হয়েছে এমএ পড়তে গিয়ে। মনে আছে বইমেলায় একদিন আমি আর বিশ্বদীপ একসঙ্গে 'রক্তকরবী' কিনেছিলাম। যেদিন কিনেছিলাম, সেদিনই বাড়িতে এসে পড়ে ফেলেছিলাম এক নিশ্বাসে। নন্দিনী, রঞ্জন, রাজা, বিশুপাগলা, প্রফেসর, কিশোর যেন আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছিলাম। আমরা দুজন সারাদিন শুধু রক্তকরবী নিয়েই আলোচনা করতাম। সেই থেকে আমি আর আমার বিশ্বদীপ নিশ্চিত যে একটা 'রক্তকরবী' লিখলে সারা জীবনে আর কিছু না লিখলেও চলে। সেই মানুষটিকে অস্বীকার করে দূরে সরিয়ে রাখা এক চরম চালাকি। আমি বলছি না, তিনি যা লিখেছেন সব মাথায় তুলে নেচে অন্য সবাইকে দুচ্ছাই করতে, কিন্তু এটাও ঠিক তাঁর লেখার এবং ভাবনার ব্যাপ্তির ধারেকাছেও আমরা কেউ পৌঁছতে পারিনি। তা এমন মানুষের নাম ব্যবহার করে কিছু মানুষ প্রচার পেতে চাইবেন এটাই তো স্বাভাবিক! এটাই তো সহজ পদ্ধতি। কিন্তু যারা মন দিয়ে না-পড়ে রবীন্দ্রনাথকে
দূরে
সরিয়ে
রাখছেন,
তাঁদের
বলি,
পড়ে
দেখুন,
পড়া
মানে
কিন্তু
পরীক্ষায়
পাশ
করার
জন্য
পড়া
নয়। একটু গভীরে ঢুকতে চেষ্টা করুন। দেখবেন কী কী সব মণিমুক্ত রাখা!
রবীন্দ্রনাথ
আসলে
ইন্ডিয়ান
ক্লাসিকাল
মিউজিকের
মতো। ওপর ওপর পড়লে মাথার ওপর দিয়ে যাবে... আর ভিতরে নেমে পড়লে সমস্ত মানসিক অশান্তি নেমে যাবে...আপনি ভেসে পড়বেন এক অনাবিল আনন্দে। সেই আনন্দ বিরাট প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চিনতে পারার আনন্দ।
No comments:
Post a Comment