ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday 22 April 2018

দেশের নাম কাশ্মীর : স্বর্ণেন্দু সরকার

ডন কিহোতের ঘোড়া নামিয়ে দিল আকাশের নীলে আর মানব-জ্বালা শুকিয়ে মালা হয়ে লুটিয়ে পড়ল তীর্থগামীর পায়ে পায়ে। এমন মলিন-মোচন নীল বাতাসের হাহাকারের ভিতর দেখা হল অমরনাথের সাথে। ঘোড়া নিয়ে যে সহিস পার হয় তুহিন দিগন্ত, কাঁধে পালকি নিয়ে চারবেহারা, পথের দুপ্রান্তে ভিক্ষু, মন্দিরে পূজারী, লঙ্গরে পাচক, প্রসাদের দোকানি মায় খাবারের উপর মক্ষী সবকিছুই যেন ঘুমিয়ে পড়ল নিমেষে।

দক্ষিণের দেশ থেকে এসেছে আম্মা, পশ্চিমের থেকে আয়ী...তোমার কথা মনে পড়ে গেল মা। তুমি কোনোদিন ডুয়ার্সের চা-বাগান আর জঙ্গল-জগতের বাইরে উঁকি দিয়েও দেখলে না। আমি এসেছি এই দুর্গম গিরি খঞ্জের মতো লঙ্ঘন করে, তোমাকে ছেড়ে এতদূরে। চোখ আমার ভিজে যায়, জল ঝরে পড়ে সন্ধ্যা ফুলের মতো শুকনো চোখ থেকে। কয়লার বস্তা সোনা হয়ে উঠুক আমি চাই না। আমি চাই মানবধর্মের মুকুট পড়ুক সকলে। যারা ঘুমন্ত ওই মহান্ত ব্যাতিত ওরা সকলেই সেই বুটার অনুচর। কঠিন সিঁড়ি যে পার করে দিচ্ছে, আরতির ভিতর নিয়ে যাচ্ছে যে, যে কাঁধে নিয়ে উঠে যাচ্ছে দুর্গম পথ, যে প্রসাদী বিক্রেতা, লাল নীল তাঁবুতে যে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিচ্ছে, আনাড়ি বোকা যাত্রীর ভারী সামান পিঠে চড়িয়ে নিচ্ছে শুধুমাত্র কি দুটো অচল পয়সার লোভে? এই সরল সুন্দর মানুষগুলো আমাদের শহরে এলে জঙ্গি মনে কোরো না, তেষ্টা পেলে এক গেলাস জল আর দুটো বাতাসা দিও বরং, মুসলমান বলে দূরে সরিয়ে রেখো না, মিডিয়ার তৈরী গল্পে আস্থা রেখো না, যদি পারো এই উপত্যকা ভ্রমণে এসে প্রাণ ভরে উপভোগ করো এই মানুষদের উষ্ণতা, আমি হলফ করে বলছি ভূ-ভারতে এমন নজির তুমি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো।

আর কী আশ্চর্য, অমনি জেগে উঠতে থাকল সবকিছুই, ঘোড়া নিয়ে সহিস পার হয়ে গেল তুহিন দিগন্ত 'জয় ভোলে জয় ভোলে' শব্দ করে। কাঁধে পালকি নিয়ে বেহারা দৌড়ে পার হল কঠিন পাহাড়ের বাঁক। পথের প্রান্তে ভিক্ষু লুকিয়ে রাখতে লাগল জমে যাওয়া খুচরো পয়সা। লঙ্গরে পাচক যত্ন করে নামিয়ে আনল গরম ভাতের হাঁড়ি। দোকানি তুলে দিল ভক্তের হাতে প্রসাদের ডালি। খাবারে বসা মাছি উড়ে বসল অন্য খাবারে। ডানায় মুখ ঢেকে যে পায়রা ঘুমিয়ে ছিল, ডানা মেলে ভাসিয়ে দিল বাতাসে। মন্দিরের ঘন্টা দুলে, বেজে উঠল। শুধু পূজারীর উগ্র সাজ মলিন হল না, যে অহং তার চোখে চোখ রেখে দেখে এলাম, একদিন যে তিনি তাতেই পুড়ে মরবেন, কানে ফিসফিস করে কে যেন বলে গেল। 

সন্ধ্যার আরতি শেষ হলে দেখি কথা না-বলা এক সাধু একা বসে আছে। শান্তির বরফ গলে জল হয়ে যাচ্ছে তার সারা শরীর জুড়ে।

1 comment:

  1. কী যে বলি। তোমার প্রতিটি শব্দে অনুরণিত ভারতের আত্মা!

    ReplyDelete