ছবি : Agnieszka Pilat |
[সাহিত্য, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
বৎস, আমি আসিয়াছি জীবন হইতে। স্মৃতি হইতে। স্মৃতিকথা হইতে। মানুষের যৌথ
জীবনের আনকোরা স্মরণ উৎসবই আসলে সাহিত্য নয় কি?
বেশ বেশ। জীবন থেকে যে উৎসারিত আলো, (অথবা অন্ধকার) তা নিয়ে আমরা সবাই
লিখিনা, কিন্তু কেউ কেউ তো লিখি। এই যে স্মৃতিলেখা, তা কখনো হয়ত বা প্রেম, কখনো
বাৎসল্য, কখনো শৈশব স্মৃতি বা কৈশোরের অভিজ্ঞতার তাড়না থেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
এবারে তেমনি কিছু লেখা খুঁজে খুঁজে এনে, সম্পাদনা করে প্রকাশ করার উদ্যোগ। আগের বারে পেয়েছেন
বাংলাদেশের গ্রামের নবান্ন-র স্মৃতিকথা।
দ্বিতীয় কিস্তিতে আপনাদের জন্য খুঁজে এনেছি শ্রী বিমোচন ভট্টাচার্যের লেখা।
কয়েকটি ছোট ছোট লেখায় সাজিয়ে দিলাম একটা
হারিয়ে যাওয়া সময়কে। এই লেখাগুলি এক অর্থে পুনর্মুদ্রণ। লেখা-ক’টির প্রথম প্রকাশ
ঘটেছে অন্তর্জাল দুনিয়ায়, ফেসবুকের পাতায়।
তবে, এ ধরনের লেখা বার বার পড়ার মতো। বিমোচন ভট্টাচার্য প্রখ্যাত নাট্যকার
বিধায়ক ভট্টাচার্যের পুত্র। নিজে আপাতত অবসৃত তাঁর সফল ব্যাঙ্ক আধিকারিকের জীবন
থেকে। স্মৃতিরোমন্থনের মধ্যে দিয়ে বাংলার এক লুপ্ত সময়কে ধরে রাখার চেষ্টা করেন।
নানা মানুষের কথা লেখেন।
অলমতি বিস্তরেণ।
-যশোধরা রায়চৌধুরী]
১
আমি যে হাউসিং এস্টেটে
থাকি তার নাম বেলগাছিয়া ভিলা। তার উল্টোদিকের পাড়ার নাম বীরেন্দ্রনগর। আমরা
বীরেন্দ্রনগরে আসি ১৯৬৭ সালে। সেখানে দুটি ভাড়া বাড়িতে ছিলাম। ১৯৭৮ সালে আমরা ভিলাতে আসি। ফলে দুটি পাড়াতেই আমার বন্ধুবান্ধব রয়েছে। দুটি পাড়াতেই প্রায় সব ব্যাপারেই
আমার ইনভলভমেন্টও রয়েছে। দুটি পাড়াতেই প্রতি বছর পুজোর সময় নাটক হয়। মাচার নাটক।
প্রতি বছরই কিছু না কিছু ক্যাচালও হয় নাটক নিয়ে। সেই রকম একটি ঘটনা।
শচীন সেনগুপ্তর জন্ম-শতবর্ষে ভিলাতে নাটক ঠিক হল 'সিরাজদৌল্লা'। আমাদের ডিরেক্টর হলেন অবনী
ভট্টাচার্য। সেই অবনীদা যাকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এসে মাঝরাতে হাঁক পাড়তেন প্রায়ই 'অবনী বাড়ী আছো?' তো অবনীদা কাস্টিং করলেন। মিঠু সিরাজ, আমাদের
চারতলার পিউ লুৎফা, আর আমি গোলাম হোসেন। আমি তৎক্ষণাৎ না বলে দিলাম কারণ
বীরেন্দ্রনগরে সেই বার হচ্ছে 'শেষ থেকে শুরু' আর তাতে আমি নীলমণি। মেন রোল।
অবনীদা কিছুতেই মানবেন না। শেষমেষ গোলাম হোসেন করতে রাজি হলেন সমরদা। সমর
পালচৌধুরী। খুব ভাল অভিনেতা ছিলেন সমরদা। আমি প্রম্পটার আর গ্রামবাসী। শেষ দৃশ্যে
সিরাজকে মারবে মীরন বোরখা পড়ে ঢুকে। আমাদের এলাকার বেশ বড় মস্তান মিন্টা হঠাৎ দাবী
করল যে সে মীরন করবে। প্রথম দিন রিহার্সালে মিন্টা এল একটা আসল 'ন্যাপালা' নিয়ে। গ্রামবাসীদের রোলও তখনই। সিরাজকে ঘিরে ধরে তার পায়ের
তলায় বসে সিরাজকে অনুরোধ করবে থেকে যাবার জন্যে। হা হা করে হাসতে হাসতে মীরনবেশী
মিন্টা ঢুকে সিরাজকে হত্যা করবে সেই ন্যাপালা দিয়ে। প্রথমদিন রিহার্সালের পরই আমি
বলে দিলাম আমি গ্রামবাসীও করবনা। মিন্টা যেখানে ন্যাপালাটা ধরছে তার থেকে আমার 'টাকের' দুরত্ব এক ইঞ্চিও নয়। এত বড় রিস্ক আমি নিতে পারব না। শেষ
পর্যন্ত মিন্টা মীরন করেনি। আমার 'টাক' রক্ষা পেয়েছিল।
যাই হোক। পিউ খুব
সুন্দর গান গাইত। রিহার্সাল এগোতে থাকল। সপ্তমীর দিন আমাদের শো। নবমীর দিন
বীরেন্দ্রনগরে। সেটা আবার আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়া। অবনীদা টেন্সড হয়ে আছেন। আমাকে
বললেন - "বাসু তুই একটা উইগ পরে নে। আমাদের মেকআপম্যান নিমাইদা বেঁকে বসলেন, বললেন - (একটু তোতলা ছিলেন) আহ্ অ-অবনীদা ছা-ছা ড়ুন না। বা-বাসুদাকে উ-উইগ পরানো
হে-হেব্বি ঝামেলার ব্যাপার। কি-কিলিপ ধরে না মাথায়"।
নাটক শুরু হল। অরিজিনাল
পেটো বানিয়েছিলেন অবনীদা 'কচিয়া' কে দিয়ে। আমরা সেটা জানতাম না। আকাই
ছিল পর্দা ফেলা ওঠার দায়িত্বে। আপনাদের মধ্যে যাদের পাড়ার নাটক করার অভিজ্ঞতা আছে
তারা জানবেন এটাই হল সবচেয়ে নড়বড়ে জায়গা পাড়ার থিয়েটারের। অবনীদা পই পই করে আকাই(তখন বেশ ছোট)কে বলে দিলেন - আকাই, তুই শুধু আমার দিকে
চেয়ে থাকবি, আমি টর্চ দেখালেই পর্দা ফেলে দিবি। ইংরেজরা আক্রমণ
করেছে। মঞ্চে সিরাজ, গোলাম হোশেন আর লুৎফা। অবনীদা নিজে হাতে পেটো ছুঁড়লেন
মঞ্চের পাশে স্কুল বাড়িতে। আমার হাত থেকে স্ক্রিপ্ট পড়ে গেল। স্পিন্টার এসে লাগল
আমার চেয়ারের নীচে। অভিনেতারা চমকে উঠলেন। সিরাজবেশী মিঠু সামলে নিয়ে চিৎকার করে
বলে উঠল "ওই, ওই আবার কামান গর্জন"। এই সময় দূতবেশী অধীরদার
ঢোকার কথা। অধীরদা তার পাঁচ মিনিট আগে থেকে উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু
স্টেজে আর ঢুকছেন না। কেউ বলছে "অধীর ঢোকো", আমি বলছি "অধীরদা
ঢুকুন"। আকাই এতক্ষন নাটক দেখছিল না। একদৃষ্টে অবনীদার দিকে তাকিয়ে ছিল। ও
পর্যন্ত ও পাশ থেকে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। অধীরদা কিন্তু উইংসের ধারে 'স্থানুবৎ' দাঁড়িয়ে আছেন। নট নড়নচড়ন। আমাদের কারো কথা ওঁর কানেই যাচ্ছে
না। অবনীদা আর থাকতে পারলেন না। শেষ পেটোটা একজনের হাতে দিয়ে তিনটে সিঁড়ি উঠে
মারলেন অধীরদাকে এক ধাক্কা। অধীরদা স্টেজের ভেতর কিন্তু আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম
আকাই হাসিমুখে পর্দা ফেলে দিচ্ছে। অধীরদাকে স্টেজে ঢোকাতে গিয়ে অবনীদার হাতের জ্বলন্ত
টর্চ আকাইএর দিকে উঠে গেছে আর আকাই, ওকে যা বলেছিলেন অবনীদা
তাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। সে এক 'প্যান্ডামোনিয়াম' চারধারে। মাচায়
প্রচুর মাইক থাকে ফলে আমাদের সব কথাই দর্শকেরা শুনতে পাচ্ছিলেন। অবনীদা মাথা নিচু
করে বসে। আস্তে আস্তে আমায় বললেন - অ্যানাউন্স করে দে এটা জরুরী বিরতি। গোলাম
হোসেনবেশী সমরদা বলেছিলেন - "বাসু, এই হচ্ছে মাচার নাটক এর
পরেও নাটক হবে, কাল সকলে ভুলে যাবে যে মাঝে এই রকম ব্যাপার হয়েছিল, বলবে
বাহ, বেশ ভাল করেছেন আপনারা দাদা"। সত্যিই তাই
হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আবার নাটক শুরু হয়েছিল। শেষও, তবে
অবনীদা আর কোনোদিন ডিরেকশন দেন নি।
আজ হঠাৎ কেন এই কথা
লিখলাম। ভিলার পুজোর এবার পঞ্চাশ বছর। নাটকের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। অবনীদা নেই
সমরদাও নেই, আর পৃথিবীতে। মিঠু এখানে থাকেনা। পিউ পাকাপাকিভাবে চলে
গেছে ব্যাংগালোরে।
নিমাইদাও মারা গেছেন।
এদের
ছাড়া কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগে বেলগাছিয়া ভিলা......।
২
সদ্য সত্যিকারের প্রেমে পড়েছি
তখন। আমার প্রেমিকা ক্লাস এইটে পড়ে। আমি গ্রাজুয়েট হয়েছি চার বছর। বেকার। নকশাল
আন্দোলন শেষ হয়ে আসছে। পাড়ায়ও শান্তি ফিরে আসছে একটু একটু করে। আমাদের মধ্যে
অনেকেই চাকরি পেয়ে গেছে। সেই কিশোরীর বাড়ির নীচেই আমাদের আড্ডা। স্কুল থেকে ফিরত
সেই মেয়ে। মেরুন রঙের শাড়ি পড়ে। কালেভদ্রে কথা বলার সুযোগ হত। তখনই শুনেছিলাম ওর
বাড়িতে জ্যেঠিমাই সব। ওরা বলে মেজমা। আজকের লেখা সেই মেজমাকে নিয়ে।
শুনলাম মেজমা
হেমন্তবাবুর অন্ধ ভক্ত। বিশেষ করে হেমন্তবাবুর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানের। একদিন সন্ধেবেলায় ওদের বাড়ির ঠিক
উল্টো দিকে একটা বেঞ্চে বসে আছি আমরা। আমাদের পাড়াটা বেশ অন্ধকার ছিল সেই সময়।
দেখলাম মেজমা এসে বসলেন ওদের বিশাল বারান্দায়। অন্ধকারের ভেতর দিকে আমরা বসে
ছিলাম। ফলে আমরা ওঁকে দেখতে পেলেও উনি খুব ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলেন না। আমি
হেমন্তবাবুর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান শুরু করলাম। মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে, মন মোর মেঘের সংগী, তুই ফেলে এসেছিস কারে, এ পারে মুখর হল কেকা ওই,। ভোলা ছিল
বেঞ্চবাদক। দেখলাম উনি উঠে গেলেন না। ওই সন্ধেবেলা যারা বাড়ি ফিরছিলেন অনেকেই
দাঁড়িয়ে শুনছিলেন
গানগুলি।
পরের দিন শম্পা একটা
চিঠি পাঠাল আমার বোনের হাত দিয়ে (অকালপ্রয়াত সেই বোনই ছিল আমাদের পিওন)। চিঠিতে
লেখা - "কাল মেজোমা আমায় জিজ্ঞেস করলেন
গানগুলো কে গাইছিল রে? বেশ
ভাল গায় তো। আমি বললাম, অন্ধকার
ছিল তো আমি কী করে জানব কে গাইছিল। তবে মেজমাকে বেশ খুশি খুশি লাগছিল"।
এরপর পঁচাত্তরে ও স্কুল
ফাইনাল পাস করল আর আমিও চাকরি পেলাম ব্যাঙ্কে। দেখা হওয়াটা বাড়ল একটু। আঠাত্তরে
ভিলায় ফ্ল্যাট পেলাম আমরা। বিয়ের ঠিক হল আর বিয়েও হয়ে গেল উনআশির ২৮শে ফেব্রুয়ারি।
দে বাড়ির জামাই হয়ে গেলাম আমি আর মেজমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
মেজমা নবদ্বীপের মেয়ে।
কলকাতায় বেথুন কলেজ থেকে সেই সময়কার অনার্স গ্রাজুয়েট। সংস্কৃতে। বিয়ে হল দে বাড়ির
সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটির সঙ্গে। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই ব্যবসা করতেন। সকলেই সফল
ব্যবসায়ী। শুধু প্রথম দুজন চাকরি করতেন। প্রথমজন এয়ার ইন্ডিয়া দ্বিতীয়জন এক্সাইড ইন্ডিয়ার
জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। মেজমা এঁরই স্ত্রী।
মেজমা আমার মায়ের বয়েসি
ছিলেন না কিন্তু ছিলেন আমার মাতৃসমা। তখন প্রায় রোজই যেতাম শ্বশুরবাড়ি। মেজমার
ঘরেই বসতাম। বিভিন্ন বিষয়ে মেজমার সঙ্গে আলোচনা হত আমার। বিশেষ করে দেশ পত্রিকায়
প্রকাশিত গল্প কবিতা নিয়ে। গান শোনাতাম। এবার সামনাসামনি। আমায় ইন ফ্যাক্ট প্রথম
লেখালিখির ব্যাপারে উৎসাহিত করেন মেজ মা।
মেজমার এক ছেলে। সেই
ছেলে বুবাই আমেরিকা চলে গেল আশি সালে। মেজমার একমাত্র ছেলেকে ছাড়তে আমরাও গেলাম
এয়ারপোর্টে। আশি সালে আমেরিকা যাওয়া এমন জলভাতের মতো ছিল না। মেজমা কিন্তু হাসিমুখেই
বিদায় দিলেন বুবাইকে।
তিরাশিতে বুবাই বিয়ে
করতে এল। খুব ধুমধাম করে বিয়ে হল বিরাটির রুমার সাথে। খুব খুশি মেজমা। বিয়ে করে বৌ
নিয়ে বুবাই ফিরে গেল আমেরিকায়। এইবার মেজমাকে একটু বিমর্ষ দেখলাম কি?
সময় চলতে লাগল তার
নিজস্ব নিয়মে। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরতেন বেশির ভাগ সময়। এক অদ্ভুত ব্যাপার হল আমি
মেজমাকে মাথায় ঘোমটা ছাড়া কখনো দেখি নি। অথচ ওই বাড়িতে ওঁর চেয়ে বয়েসে বড় ছিলেন
মাত্র দুজন। বাকি ওঁর দেওরেরা বয়েসে বড় হলেও সম্পর্কে ছোট ছিলেন। তাঁরা সবাই তাদের
মেজবৌদিকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন।
পঁচাশির দোলের সময় মেজমাকে আমি একটু অন্যরকম দেখলাম। ওদের বাড়িতে দোল খেলছিলাম আমরা সবাই। হঠাৎ মেজমা স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে খুব রেগে গেলেন। চেঁচামিচি শুরু করলেন। এমন অবস্থা হল যে আমরা দোল খেলা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি ফিরে বাথরুমে স্নান করছি শুনি বাইরে মেজমা ডাকছেন বাসু, বাসু বলে। বেরিয়ে দেখি দলবল নিয়ে মেজমা এসেছেন আমাকে আর মেয়ে সহ শম্পাকে নিয়ে যেতে। আবার দোল খেলা শুরু হল। মেজমাও দোল খেললেন এবার আমাদের সঙ্গে। আমি পাড়ার জামাই। মনের মধ্যে একটা খটকা লেগেই থাকল। কী হল মেজমার?
রাত্রে খেতে বলেছিলেন মেজমা। গিয়ে পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম - কী হল মেজমা? রেগে গেলেন কেন? আপনাকে রাগতে আমি আজ প্রথম দেখলাম। একটুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে মেজমা বলেছিলেন - শরীরটা ভাল নেই বাবা।
শুরু হয়তো হয়েছিল আগেই কিন্তু আমি সেই প্রথম শুনেছিলাম মেজমার শরীর খারাপের কথা। তারপর থেকেই আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মেজমা। রোজ সন্ধের পর জ্বর আসত। কলকাতার সব বড় ডাক্তার দেখানো হল। শেষে ধরা পড়ল কোলনে ক্যান্সার হয়েছে মেজমার। মেডিকেল কলেজে অপারেশন হল। রিপোর্ট খুব খারাপ। সবাই চলে এল। আমি থেকে গেলাম মেজজ্যাঠার সঙ্গে। অনেক রাত্রে শেষ ট্রামে ফিরছি দুজনে। আমি বললাম - বুবাইকে খবর দেবেন নাকি জ্যাঠাবাবু(এই নামেই ওঁকে ডাকত সবাই, আমিও)। বললেন - এক্ষুনি নয়। বুবুর গ্রীনকার্ড পাবার কথা এই মাসেই। সেটা আটকে যেতে পারে।
দিন দিন খারাপ হতে থাকল মেজমার শরীর। ছিয়াশির জুন মাসে ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হসপিটালে ভর্তি হলেন মেজমা। রোজ যাই একবার করে অফিস শেষে। আমরা যে-ই ঘরে ঢুকি একবার দেখেন শুধু আমাদের দিকে চেয়ে তারপরেই দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়েন। কারো সংগে কথা বলেন না। তখন ফুটবলের ওয়ার্ল্ড কাপ চলছিল। ষোলই জুন ঠাকুরপুকুর থেকে ফিরে আসার সময় ওরা বললেন দুটো টেলিফোন নম্বর দিয়ে যান। দেওয়ালের দিকে মুখ করেই দুটো টেলিফোন নম্বর বলে দিলেন মেজমা।
সেদিন ব্রাজিলের খেলা ছিল। আমাদের পাড়ায় কোনদিন লোডশেডিং হত না / হয় না। সেদিনই হঠাৎ আমাদের এদিকটা লোডশেডিং হয়ে গেল। আমি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মেজমার ঘরে বসেই খেলা দেখে ভোর চারটে নাগাদ বাড়ি ফিরে এলাম ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শম্পা ডেকে তুলল সাড়ে ছটা নাগাদ। চোখে জল। বলল - মেজমা মারা গেছেন একটু আগে।
চলে গেলাম ঠাকুরপুকুর। দেখলাম শান্ত হয়ে শুয়ে আছেন মেজমা। আজ আর দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারলেন না। একটা ছোট লরিতে করে পাড়ায় নিয়ে এলাম মেজমাকে। মানিকতলার কাছে তুমুল বৃষ্টি নামল। প্লাস্টিকের একটা শেড দেওয়া ছিল। মাথার কাছে বসে ছিলাম আমি। মাথাটা ঢুকিয়ে দিলাম সেই প্লাস্টিকে। আমার ঠিক পাশেই তখন মেজমা চিরনিদ্রায়। মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়েস তখম মেজমার!!
এতদিন মেজজ্যাঠাকে আমি ভেঙে পড়তে দেখি নি। কিন্তু দাহ শেষ করে ফিরে আসার পর মানুষটিকে দেখে মনে হচ্ছিল এক নিঃসঙ্গ রাজা। ছেলেকে খবর না দেবার সিদ্ধান্ত ওঁরই ছিল। ফলে ছেলে জানতেই পারে নি তার মায়ের শারীরিক অবনতির কথা। একেবারে মৃত্যুসংবাদ পৌছোয় তার কাছে এবং সে তৎক্ষণাৎ চলে আসে বৌকে নিয়ে।
আমি পরে অনেক ভেবেছি মেজমাকে নিয়ে। ঠাকুরপুকুরে আমাদের দেখেও মেজমা কেন মুখ দেওয়ালের দিকে ফিরিয়ে নিতেন। আমার মনে হত উনি কেউ ঢুকলেই মনে করতেন ওঁর বুবু এসেছে। যখনই দেখতেন অন্য কেউ মুখ ফিরিয়ে নিতেন। মৃত্যু যে হাতের কাছেই এসে গেছে বুঝতে পেরেছিলেন সেই প্রখর বুদ্ধিমতী মহিলা। ছেলেকে একবার দেখতে চাইছিলেন দুচোখ ভরে নাহলে আমাদের দেখে বিরক্ত হতেন মেজমা! এ আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
মেজমা যেদিন পঞ্চভুতে লীন হয়েছিলেন সেদিন ছিল দশহরা। গঙ্গার ঘাটে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম। প্রায় তিরিশ বছর হয়ে এল মেজমার চলে যাবার। আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ মহিলা হলেন আমার মা। তারপরেই মেজমা। আমার ভায়রাভায়েরা সবাই আমার চেয়ে অনেক অনেক প্রতিষ্ঠিত জীবনে কিন্তু আমার সংগে মেজমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতন। আগেই লিখেছি, সম্ভবত পাড়ার ছেলে ছিলাম বলেই আমি বেশি যেতাম শ্বশুরবাড়ি। দুজন ছাড়া সব শালাদের আমি বাসুদা। তাদের ছেলেদেরও। শম্পার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ওর সঙ্গে বিয়ে হবার জন্যেই আমি ওই মহিলাকে ' মেজমা হিসেবে পেয়েছি। নাহলে উনি আরো অনেকের মতো বন্ধুর বৌদি হিসেবেই থেকে যেতেন (শম্পার ছোটকাকা আমার স্কুলের বন্ধু), আমার মেজমা হতেন না।
আমার শ্বশুরেরা আট ভাই। ছজন ওই বাড়িতেই থাকতেন আমি দেখেছি। বাকি দুজন পাড়াতেই বাড়ি করে আলাদা থাকতেন। মেজমা ছিলেন ওই বাড়ির লক্ষী। চলে যাবার পর ওই বিশাল বাড়ি আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে গেল। বড় জ্যাঠা মারা গেলেন এই বছর ১লা মে। এখন মাত্র দু ভাই থাকেন ওই বাড়িতে। বাকি ঘরগুলো বন্ধ পড়ে থাকে।
বড়জ্যাঠার কাজে শ্বশুরবাড়ি গেলাম অনেক দিন পর। কাজের জায়গাটা ফুলে ফুলে ঢাকা ছিল। বড়জ্যাঠার সঙ্গেই ছবি হয়ে সেখানে ছিলেন মেজমাও।
৩
আমার পিতৃদেব তখন যুবক। নাটক লিখেছেন একখানা। দেহযমুনা। অভিনীত হল বাগবাজারের 'শিশির কুমার ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরি'তে একদিন এবং রংমহলে একদিন। নিজেরাই অভিনয় করেছিলেন তাতে। আমার পিতৃদেব মহিলা চরিত্রে। রংমহলে সেই নাটক দেখেন সেই সময়কার বিখ্যাত নট ও নাটককার যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী। তিনিই নতুন নাট্যার্থী বিধায়ককে নিয়ে গেলেন রংমহলের তৎকালীন মালিক গদাধর মল্লিকের কাছে। 'মেঘমুক্তি' নামে সেই নাটক মঞ্চস্থ হল রংমহলে। নিজে হাতে নাটকটি "পরিবর্জ্জন, পরিবর্তন ও পরিবর্দ্ধন”(বাবার কথাতেই) করে দিলেন যোগেশ চন্দ্র। বাবার নিজের কথাতেই "যোগেশদার স্নেহস্পর্শ না পেলে মেঘমুক্তি ত্রুটিবহুল হবার সম্ভাবনা ছিল।" সেই নাটকেই প্রথম বাবার নাটকে অভিনয় করেন বাবার 'দুগগা দা'। দূর্গাদাস ছাড়াও এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন যোগেশচন্দ্র স্বয়ং, জহর গাঙ্গুলি, সন্তোষ সিংহ, রতীন বন্দোপাধ্যায়, রাণীবালা, পদ্মাদেবী। আর বাবার লেখা গানগুলিতে সুর দিয়েছিলেন বাবার আর এক চিরপ্রণম্য অভিনেতা ও গায়ক/সুরকার, নাট্যকার তুলসী লাহিড়ী।।
এতকথা আজ বাবাকে নিয়ে কেন? কোনো কারণ নেই। সকালে একটি তথ্য খোঁজার জন্যে বইপত্তর ঘাঁটছিলাম। সেই সুত্রেই পড়লাম পরম শ্রদ্ধেয় যোগেশ চৌধুরীর বাবাকে বলা এক অমুল্য উক্তি। যুবক বিধায়ক যাঁর হাত ধরে পেশাদার মঞ্চে প্রবেশ করেছিলেন তাঁর সেই যোগেশদাকে প্রশ্ন করেছিলেন একদিন। রংমহল থেকে বাগবাজারে আসতেন দুজনে টানা রিকশায়। "আচ্ছা, নাটক শেখার কি কোনো ফরমুলা আছে?"
যোগেশ চন্দ্র উত্তরে তাঁর স্নেহের বিধায়ককে বলেছিলেন "নাঃ। কেবল মানুষ দেখো। ট্রামে-বাসে-পথে-ঘাটে, রাজদ্বারে-শ্মশানে, - যেখানে যত মানুষ চলাফেরা করছে, হাসছে-কাঁদছে-গান গাইছে - সব্বাইকে দেখো। মনে রেখো - পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে নাটক রয়েছে - শুধু তোমার দেখতে পাওয়া চাই। যেখানে যা ঘটছে - সবই নাটকীয়। কোনো কেরামতি না করে সহজভাবে তাকে নাটকে ধরার চেষ্টা করো। দেখবে ভাল নাটক হয়েছে।"
বিধায়ক সারাজীবন চেষ্টা করে গেছেন তাঁর গুরু যোগেশ চন্দ্রের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার। বলতেন - দেখবি, এমনিতে খুব কঠিন বা বাস্তববাদী মানুষ বাড়িতে কোনো অঘটন ঘটলে বা মৃত্যু হলে এমন ব্যবহার করতে পারেন যা স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি করবেন না। তুই সেই হাউহাউ করে কান্না বা প্রলাপ বকাকে তোর নাটকে রাখ। দু রকম প্রতিক্রিয়া পাবি। এক, সাধারণ মানুষ, যারা প্রতিনিয়ত এই রকম ঘটনা দেখছেন, বলবেন - অসাধারণ আর দুই সমালোচক, বলবেন - মেলোড্রামা। দুটোই মেনে নিবি।
আমার লেখক হবার বাসনা, না ছিল না আছে। ইচ্ছে করে তাই লিখি। হাতে এখন অফুরন্ত সময় তাই লিখি। কিন্তু যুবক বিধায়ককে বলা পরম শ্রদ্ধেয় যোগেশ চন্দ্রের কথাগুলি না জেনেই মেনে এসেছি চিরকাল।
মানুষ দেখছি আমি। সারাজীবন দেখেও যাব মানুষ। শুধুই মানুষ।
সে আমি লিখি বা নাই লিখি।
৪
পাঁচই জুন উনিশশো আঠাশ। মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জের তরুণ বগলারঞ্জন-এর সাথে বাগবাজারের কিশোরী মৃণালিনীর বিয়ে হয়। বগলারঞ্জনই পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া বিধায়ক নাম নিয়ে নাট্যকার হন। আমি সেই দম্পতির কনিষ্ঠ সন্তান। আটটি ছেলেমেয়ে হয়েছিল তাঁদের। পাঁচটি ছেলে আর তিনটি মেয়ে।
আমাদের বাড়িতে জন্মদিনের রেওয়াজ ছিল/আছে। কিন্তু বিবাহবার্ষিকীর চল ছিল না কোনোদিন। কাজেই বাবা-মায়ের বিয়ের দিন কবে চলে যেত কেউ খেয়ালই করতাম না আমরা।
১৯৭৮ সাল ব্যতিক্রম। ওই সালের এই দিনে আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি প্রথম ভাঙে। আমরা ছোট দুই ভাই, বাবা মা, দুই দিদি, ছোট বোনকে নিয়ে চলে আসি বেলগাছিয়া ভিলায়। সেই থেকে আছি এখানে। এই ফ্ল্যাটেই আমার বিয়ে হয়েছে। প্রথমে মা গেছেন আমাদের ছেড়ে অন্যলোকে, তারপর বাবা, মেজদি। কিন্তু না, আজ দুঃখের কথা নয়। ওই আটাত্তর সালেরই একটা স্মরণীয় ঘটনা শুনুন আজ।
এই ফ্ল্যাটে আসার তিনমাস বাদে, সেপ্টেম্বর মাসে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল কদিন ধরে। একদিন সকালে খাট(চৌকি ছিল তখন) থেকে নামতে যাব, পা ডুবে গেল জলে। ছলাৎ করে শব্দ হল। উঠে দেখি সারা ফ্ল্যাটে জল! গোড়ালি ডুবে যাচ্ছে। আটাত্তরের সেই ভয়াবহ বন্যা। ক্রমশ জল বাড়তে লাগল। বৃষ্টি কমার লক্ষণ নেই। চারটে ঘর আমাদের। চারটে ঘরই ময়লায় ভর্তি। কচুরিপানা, ছোট মাছ, অন্যের বাড়ির মলমুত্র। ভেসে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন কালারের সেই সব মল মনে হল আমাকে বলছে "তুমি খুশি থাকো, আমা(দে)র পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো। তোমার আঙ্গিনাতে বেড়াই যখন বেড়াই, ভেসে ভেসে(মার্জনা করবেন রবি ঠাকুর) বেড়াই যখন, খুশি থাকো।"
সকালে মা তোলা উনুন জানলায় বসিয়ে খিচুড়ি রান্না করে দিলেন। সকালটা কাটল। রাত্রে সেই জল ভেঙে বাবা-মা, ছোটবোনকে রিকশা ডেকে ও বাড়িতে দিয়ে এলাম। সারা পাড়ার আলো নিভে গেল। কী কারণে শুধু আমাদের একতলার দুটি ফ্ল্যাটে আলো ছিল। সকাল থেকে দোতলা, তিনতলার প্রতিবেশীরা বলছিলেন ওপরে উঠে যাবার জন্যে। কিন্তু আমরা চার ভাইবোন ওপরে গেলাম না। দিদির এক সহকর্মী কল্পনাদি(এখন আর নেই) রাতের খাবার দিয়ে গেলেন জল ভেঙে। মশারি টানিয়ে নিলাম সবাই। অন্তত সাপখোপের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে। তখন আমাদের ফ্ল্যাটে তিনটে বাথরুম/পায়খানা ছিল, উপচে পড়েছে সেগুলো। রাতে ঘুমোলাম না। সকালে খবরের কাগজে দেখি ভাসছে গোটা পশ্চিমবাংলা। শ্রদ্ধেয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'হ্যালো দমদম'। জল ভেঙে প্রচুর বন্ধু, প্রতিবেশী আসছেন দেখা করতে। জল আর বাড়ে নি। যারাই আসছেন সঙ্গে খাবার। এরই মধ্যে শম্পাও এল, সঙ্গে আমার মা। বিয়ের প্রায় ঠিক হয়ে গেছিল তখন তাই আর সংকোচ ছিল না। দিনে প্রায় দশবার আসছেন মা ছুটে ছুটে। দাদারা আসছেন। তখনও আমরা কেউ জানি না মার শরীরে বাসা বেঁধেছে মারণ রোগ।
তিনদিন পর নেমেছিল সেই জল। বাবা এলেন তিনদিন পর। তখন বাড়ি পুরো সাফ। বললেন - নিজেরাই পরিষ্কার করে নিলি। আরে আমাকে ডেকে নিলে আমি একাই করে দিতাম পরিষ্কার। বলেই মার দিকে চোখ টিপলেন। আমি বলেছিলাম - জল আবার ঢুকবে বাবা। তোমাকে আর কোথাও পাঠাব না।
ছিয়াশিতে আর একবার এই রকম বন্যা হয়। বাবার তখন ফিমার বোন ভাঙা। সরাতে পারি নি বাবাকে। নিউমোনিয়া হয়ে গেল বাবার। ওই ছিয়াশিতেই বরাবরের জন্যে এই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেলেন বাবা মায়ের কাছে।
এখন আর জল জমে না আমাদের পাড়ায়। চমৎকার নিকাশি ব্যবস্থা। শুধু মা বাবাই আর নেই কোথাও।
৫ই জুন অনেক কথা মনে করিয়ে দিল।
আটত্রিশ বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতে......।
রাত্রে খেতে বলেছিলেন মেজমা। গিয়ে পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম - কী হল মেজমা? রেগে গেলেন কেন? আপনাকে রাগতে আমি আজ প্রথম দেখলাম। একটুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে মেজমা বলেছিলেন - শরীরটা ভাল নেই বাবা।
শুরু হয়তো হয়েছিল আগেই কিন্তু আমি সেই প্রথম শুনেছিলাম মেজমার শরীর খারাপের কথা। তারপর থেকেই আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মেজমা। রোজ সন্ধের পর জ্বর আসত। কলকাতার সব বড় ডাক্তার দেখানো হল। শেষে ধরা পড়ল কোলনে ক্যান্সার হয়েছে মেজমার। মেডিকেল কলেজে অপারেশন হল। রিপোর্ট খুব খারাপ। সবাই চলে এল। আমি থেকে গেলাম মেজজ্যাঠার সঙ্গে। অনেক রাত্রে শেষ ট্রামে ফিরছি দুজনে। আমি বললাম - বুবাইকে খবর দেবেন নাকি জ্যাঠাবাবু(এই নামেই ওঁকে ডাকত সবাই, আমিও)। বললেন - এক্ষুনি নয়। বুবুর গ্রীনকার্ড পাবার কথা এই মাসেই। সেটা আটকে যেতে পারে।
দিন দিন খারাপ হতে থাকল মেজমার শরীর। ছিয়াশির জুন মাসে ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হসপিটালে ভর্তি হলেন মেজমা। রোজ যাই একবার করে অফিস শেষে। আমরা যে-ই ঘরে ঢুকি একবার দেখেন শুধু আমাদের দিকে চেয়ে তারপরেই দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়েন। কারো সংগে কথা বলেন না। তখন ফুটবলের ওয়ার্ল্ড কাপ চলছিল। ষোলই জুন ঠাকুরপুকুর থেকে ফিরে আসার সময় ওরা বললেন দুটো টেলিফোন নম্বর দিয়ে যান। দেওয়ালের দিকে মুখ করেই দুটো টেলিফোন নম্বর বলে দিলেন মেজমা।
সেদিন ব্রাজিলের খেলা ছিল। আমাদের পাড়ায় কোনদিন লোডশেডিং হত না / হয় না। সেদিনই হঠাৎ আমাদের এদিকটা লোডশেডিং হয়ে গেল। আমি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মেজমার ঘরে বসেই খেলা দেখে ভোর চারটে নাগাদ বাড়ি ফিরে এলাম ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শম্পা ডেকে তুলল সাড়ে ছটা নাগাদ। চোখে জল। বলল - মেজমা মারা গেছেন একটু আগে।
চলে গেলাম ঠাকুরপুকুর। দেখলাম শান্ত হয়ে শুয়ে আছেন মেজমা। আজ আর দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারলেন না। একটা ছোট লরিতে করে পাড়ায় নিয়ে এলাম মেজমাকে। মানিকতলার কাছে তুমুল বৃষ্টি নামল। প্লাস্টিকের একটা শেড দেওয়া ছিল। মাথার কাছে বসে ছিলাম আমি। মাথাটা ঢুকিয়ে দিলাম সেই প্লাস্টিকে। আমার ঠিক পাশেই তখন মেজমা চিরনিদ্রায়। মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়েস তখম মেজমার!!
এতদিন মেজজ্যাঠাকে আমি ভেঙে পড়তে দেখি নি। কিন্তু দাহ শেষ করে ফিরে আসার পর মানুষটিকে দেখে মনে হচ্ছিল এক নিঃসঙ্গ রাজা। ছেলেকে খবর না দেবার সিদ্ধান্ত ওঁরই ছিল। ফলে ছেলে জানতেই পারে নি তার মায়ের শারীরিক অবনতির কথা। একেবারে মৃত্যুসংবাদ পৌছোয় তার কাছে এবং সে তৎক্ষণাৎ চলে আসে বৌকে নিয়ে।
আমি পরে অনেক ভেবেছি মেজমাকে নিয়ে। ঠাকুরপুকুরে আমাদের দেখেও মেজমা কেন মুখ দেওয়ালের দিকে ফিরিয়ে নিতেন। আমার মনে হত উনি কেউ ঢুকলেই মনে করতেন ওঁর বুবু এসেছে। যখনই দেখতেন অন্য কেউ মুখ ফিরিয়ে নিতেন। মৃত্যু যে হাতের কাছেই এসে গেছে বুঝতে পেরেছিলেন সেই প্রখর বুদ্ধিমতী মহিলা। ছেলেকে একবার দেখতে চাইছিলেন দুচোখ ভরে নাহলে আমাদের দেখে বিরক্ত হতেন মেজমা! এ আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
মেজমা যেদিন পঞ্চভুতে লীন হয়েছিলেন সেদিন ছিল দশহরা। গঙ্গার ঘাটে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম। প্রায় তিরিশ বছর হয়ে এল মেজমার চলে যাবার। আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ মহিলা হলেন আমার মা। তারপরেই মেজমা। আমার ভায়রাভায়েরা সবাই আমার চেয়ে অনেক অনেক প্রতিষ্ঠিত জীবনে কিন্তু আমার সংগে মেজমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতন। আগেই লিখেছি, সম্ভবত পাড়ার ছেলে ছিলাম বলেই আমি বেশি যেতাম শ্বশুরবাড়ি। দুজন ছাড়া সব শালাদের আমি বাসুদা। তাদের ছেলেদেরও। শম্পার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ওর সঙ্গে বিয়ে হবার জন্যেই আমি ওই মহিলাকে ' মেজমা হিসেবে পেয়েছি। নাহলে উনি আরো অনেকের মতো বন্ধুর বৌদি হিসেবেই থেকে যেতেন (শম্পার ছোটকাকা আমার স্কুলের বন্ধু), আমার মেজমা হতেন না।
আমার শ্বশুরেরা আট ভাই। ছজন ওই বাড়িতেই থাকতেন আমি দেখেছি। বাকি দুজন পাড়াতেই বাড়ি করে আলাদা থাকতেন। মেজমা ছিলেন ওই বাড়ির লক্ষী। চলে যাবার পর ওই বিশাল বাড়ি আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে গেল। বড় জ্যাঠা মারা গেলেন এই বছর ১লা মে। এখন মাত্র দু ভাই থাকেন ওই বাড়িতে। বাকি ঘরগুলো বন্ধ পড়ে থাকে।
বড়জ্যাঠার কাজে শ্বশুরবাড়ি গেলাম অনেক দিন পর। কাজের জায়গাটা ফুলে ফুলে ঢাকা ছিল। বড়জ্যাঠার সঙ্গেই ছবি হয়ে সেখানে ছিলেন মেজমাও।
৩
আমার পিতৃদেব তখন যুবক। নাটক লিখেছেন একখানা। দেহযমুনা। অভিনীত হল বাগবাজারের 'শিশির কুমার ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরি'তে একদিন এবং রংমহলে একদিন। নিজেরাই অভিনয় করেছিলেন তাতে। আমার পিতৃদেব মহিলা চরিত্রে। রংমহলে সেই নাটক দেখেন সেই সময়কার বিখ্যাত নট ও নাটককার যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী। তিনিই নতুন নাট্যার্থী বিধায়ককে নিয়ে গেলেন রংমহলের তৎকালীন মালিক গদাধর মল্লিকের কাছে। 'মেঘমুক্তি' নামে সেই নাটক মঞ্চস্থ হল রংমহলে। নিজে হাতে নাটকটি "পরিবর্জ্জন, পরিবর্তন ও পরিবর্দ্ধন”(বাবার কথাতেই) করে দিলেন যোগেশ চন্দ্র। বাবার নিজের কথাতেই "যোগেশদার স্নেহস্পর্শ না পেলে মেঘমুক্তি ত্রুটিবহুল হবার সম্ভাবনা ছিল।" সেই নাটকেই প্রথম বাবার নাটকে অভিনয় করেন বাবার 'দুগগা দা'। দূর্গাদাস ছাড়াও এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন যোগেশচন্দ্র স্বয়ং, জহর গাঙ্গুলি, সন্তোষ সিংহ, রতীন বন্দোপাধ্যায়, রাণীবালা, পদ্মাদেবী। আর বাবার লেখা গানগুলিতে সুর দিয়েছিলেন বাবার আর এক চিরপ্রণম্য অভিনেতা ও গায়ক/সুরকার, নাট্যকার তুলসী লাহিড়ী।।
এতকথা আজ বাবাকে নিয়ে কেন? কোনো কারণ নেই। সকালে একটি তথ্য খোঁজার জন্যে বইপত্তর ঘাঁটছিলাম। সেই সুত্রেই পড়লাম পরম শ্রদ্ধেয় যোগেশ চৌধুরীর বাবাকে বলা এক অমুল্য উক্তি। যুবক বিধায়ক যাঁর হাত ধরে পেশাদার মঞ্চে প্রবেশ করেছিলেন তাঁর সেই যোগেশদাকে প্রশ্ন করেছিলেন একদিন। রংমহল থেকে বাগবাজারে আসতেন দুজনে টানা রিকশায়। "আচ্ছা, নাটক শেখার কি কোনো ফরমুলা আছে?"
যোগেশ চন্দ্র উত্তরে তাঁর স্নেহের বিধায়ককে বলেছিলেন "নাঃ। কেবল মানুষ দেখো। ট্রামে-বাসে-পথে-ঘাটে, রাজদ্বারে-শ্মশানে, - যেখানে যত মানুষ চলাফেরা করছে, হাসছে-কাঁদছে-গান গাইছে - সব্বাইকে দেখো। মনে রেখো - পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে নাটক রয়েছে - শুধু তোমার দেখতে পাওয়া চাই। যেখানে যা ঘটছে - সবই নাটকীয়। কোনো কেরামতি না করে সহজভাবে তাকে নাটকে ধরার চেষ্টা করো। দেখবে ভাল নাটক হয়েছে।"
বিধায়ক সারাজীবন চেষ্টা করে গেছেন তাঁর গুরু যোগেশ চন্দ্রের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার। বলতেন - দেখবি, এমনিতে খুব কঠিন বা বাস্তববাদী মানুষ বাড়িতে কোনো অঘটন ঘটলে বা মৃত্যু হলে এমন ব্যবহার করতে পারেন যা স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি করবেন না। তুই সেই হাউহাউ করে কান্না বা প্রলাপ বকাকে তোর নাটকে রাখ। দু রকম প্রতিক্রিয়া পাবি। এক, সাধারণ মানুষ, যারা প্রতিনিয়ত এই রকম ঘটনা দেখছেন, বলবেন - অসাধারণ আর দুই সমালোচক, বলবেন - মেলোড্রামা। দুটোই মেনে নিবি।
আমার লেখক হবার বাসনা, না ছিল না আছে। ইচ্ছে করে তাই লিখি। হাতে এখন অফুরন্ত সময় তাই লিখি। কিন্তু যুবক বিধায়ককে বলা পরম শ্রদ্ধেয় যোগেশ চন্দ্রের কথাগুলি না জেনেই মেনে এসেছি চিরকাল।
মানুষ দেখছি আমি। সারাজীবন দেখেও যাব মানুষ। শুধুই মানুষ।
সে আমি লিখি বা নাই লিখি।
৪
পাঁচই জুন উনিশশো আঠাশ। মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জের তরুণ বগলারঞ্জন-এর সাথে বাগবাজারের কিশোরী মৃণালিনীর বিয়ে হয়। বগলারঞ্জনই পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া বিধায়ক নাম নিয়ে নাট্যকার হন। আমি সেই দম্পতির কনিষ্ঠ সন্তান। আটটি ছেলেমেয়ে হয়েছিল তাঁদের। পাঁচটি ছেলে আর তিনটি মেয়ে।
আমাদের বাড়িতে জন্মদিনের রেওয়াজ ছিল/আছে। কিন্তু বিবাহবার্ষিকীর চল ছিল না কোনোদিন। কাজেই বাবা-মায়ের বিয়ের দিন কবে চলে যেত কেউ খেয়ালই করতাম না আমরা।
১৯৭৮ সাল ব্যতিক্রম। ওই সালের এই দিনে আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি প্রথম ভাঙে। আমরা ছোট দুই ভাই, বাবা মা, দুই দিদি, ছোট বোনকে নিয়ে চলে আসি বেলগাছিয়া ভিলায়। সেই থেকে আছি এখানে। এই ফ্ল্যাটেই আমার বিয়ে হয়েছে। প্রথমে মা গেছেন আমাদের ছেড়ে অন্যলোকে, তারপর বাবা, মেজদি। কিন্তু না, আজ দুঃখের কথা নয়। ওই আটাত্তর সালেরই একটা স্মরণীয় ঘটনা শুনুন আজ।
এই ফ্ল্যাটে আসার তিনমাস বাদে, সেপ্টেম্বর মাসে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল কদিন ধরে। একদিন সকালে খাট(চৌকি ছিল তখন) থেকে নামতে যাব, পা ডুবে গেল জলে। ছলাৎ করে শব্দ হল। উঠে দেখি সারা ফ্ল্যাটে জল! গোড়ালি ডুবে যাচ্ছে। আটাত্তরের সেই ভয়াবহ বন্যা। ক্রমশ জল বাড়তে লাগল। বৃষ্টি কমার লক্ষণ নেই। চারটে ঘর আমাদের। চারটে ঘরই ময়লায় ভর্তি। কচুরিপানা, ছোট মাছ, অন্যের বাড়ির মলমুত্র। ভেসে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন কালারের সেই সব মল মনে হল আমাকে বলছে "তুমি খুশি থাকো, আমা(দে)র পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো। তোমার আঙ্গিনাতে বেড়াই যখন বেড়াই, ভেসে ভেসে(মার্জনা করবেন রবি ঠাকুর) বেড়াই যখন, খুশি থাকো।"
সকালে মা তোলা উনুন জানলায় বসিয়ে খিচুড়ি রান্না করে দিলেন। সকালটা কাটল। রাত্রে সেই জল ভেঙে বাবা-মা, ছোটবোনকে রিকশা ডেকে ও বাড়িতে দিয়ে এলাম। সারা পাড়ার আলো নিভে গেল। কী কারণে শুধু আমাদের একতলার দুটি ফ্ল্যাটে আলো ছিল। সকাল থেকে দোতলা, তিনতলার প্রতিবেশীরা বলছিলেন ওপরে উঠে যাবার জন্যে। কিন্তু আমরা চার ভাইবোন ওপরে গেলাম না। দিদির এক সহকর্মী কল্পনাদি(এখন আর নেই) রাতের খাবার দিয়ে গেলেন জল ভেঙে। মশারি টানিয়ে নিলাম সবাই। অন্তত সাপখোপের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে। তখন আমাদের ফ্ল্যাটে তিনটে বাথরুম/পায়খানা ছিল, উপচে পড়েছে সেগুলো। রাতে ঘুমোলাম না। সকালে খবরের কাগজে দেখি ভাসছে গোটা পশ্চিমবাংলা। শ্রদ্ধেয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'হ্যালো দমদম'। জল ভেঙে প্রচুর বন্ধু, প্রতিবেশী আসছেন দেখা করতে। জল আর বাড়ে নি। যারাই আসছেন সঙ্গে খাবার। এরই মধ্যে শম্পাও এল, সঙ্গে আমার মা। বিয়ের প্রায় ঠিক হয়ে গেছিল তখন তাই আর সংকোচ ছিল না। দিনে প্রায় দশবার আসছেন মা ছুটে ছুটে। দাদারা আসছেন। তখনও আমরা কেউ জানি না মার শরীরে বাসা বেঁধেছে মারণ রোগ।
তিনদিন পর নেমেছিল সেই জল। বাবা এলেন তিনদিন পর। তখন বাড়ি পুরো সাফ। বললেন - নিজেরাই পরিষ্কার করে নিলি। আরে আমাকে ডেকে নিলে আমি একাই করে দিতাম পরিষ্কার। বলেই মার দিকে চোখ টিপলেন। আমি বলেছিলাম - জল আবার ঢুকবে বাবা। তোমাকে আর কোথাও পাঠাব না।
ছিয়াশিতে আর একবার এই রকম বন্যা হয়। বাবার তখন ফিমার বোন ভাঙা। সরাতে পারি নি বাবাকে। নিউমোনিয়া হয়ে গেল বাবার। ওই ছিয়াশিতেই বরাবরের জন্যে এই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেলেন বাবা মায়ের কাছে।
এখন আর জল জমে না আমাদের পাড়ায়। চমৎকার নিকাশি ব্যবস্থা। শুধু মা বাবাই আর নেই কোথাও।
৫ই জুন অনেক কথা মনে করিয়ে দিল।
আটত্রিশ বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতে......।
No comments:
Post a Comment