ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday, 22 April 2018

জন্মতারিখ : রাণা রায়চৌধুরী

ছবি : David Kiraly
আগে আমার একটা স্বভাব ছিল যে কোনো বাড়িতে গেলে লক্ষ করা যে, সে বাড়িতে সিলিঙে ফ্যান ঝুলছে কি না তা দেখা। চেয়ারে বসার আগে দেখে নিতাম ওপরে ফ্যান ও ফ্যানের ওপরে সিলিঙে আঙটা লাগানো আছে কিনা।

মনে সবসময় ঘুরত, কবিতার মতো একটা দড়ি ঝুলে আছে কিনা, সিলিং থেকে বা আকাশ থেকে। দড়িটা দুলছে। দুলছে। দড়ির ডগায় একটা বড় মাথা ঢুকে যাওয়ার মতো ফাঁস। আমার ক্ষুদিরামের কথা মনে পড়ে। আমার ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় নাম্নি এক সামান্য যুবকের কথা মনে পড়ে। আর মনে পড়ে নাটা মল্লিকের কথা।
নাটা মল্লিক-এর নিশ্চয় ভিতরে গান ছিল। নাটা মল্লিকেরও ভিতরে নিশ্চয় একটা মায়ামমতাময় ফুলের বাগান ছিল। কিন্তু তাকে ধনঞ্জয় নামক ওই নিরীহ দুবলা ছেলেটার গলায় ফাঁসের দড়ি পরাতে হয়েছিল চাকরির তাগিদে। হায় চাকরি! এক্ষেত্রে ধনঞ্জয়ের মৃত্যুটা ইচ্ছামৃত্যু নয়। বেচারা ফাঁসে ফেঁসে গেছিল। আমার ধারণা, ধনঞ্জয়ের ফাঁসির দিনের আগে তার গ্রামের বাড়িতে তার বউকে নির্ঘাত তাবিজ-কবজ পরানো হয়েছিল, যাতে স্বামীর ওই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ওই নিরীহ মেয়েটির জীবনে না আসে। কিন্তু মহামান্য আদালত বলে আমাদের দেশে একটা কথা আছে।

আমি সেই ফাঁসির দিনে বাড়িতে বসে ভাবছিলাম, গলায় দড়ি পরানো হল, নাটা মল্লিক মা কালীকে প্রণাম করে দড়ি টেনে দিল। ধনঞ্জয়ের গলায় অমায়িক দড়ি এঁটে বসছে, ধনঞ্জয় ধনঞ্জয়, আমি আর ভাবতে পারিনা। অথচ ছেলেটিকে তার মা ছোটবেলায় বুকের দুধ দিয়েছিল পরম মমতায়। ধনঞ্জয় ছোটবেলায় সাঁতার কেটেছিল পুকুরে ঐ পাড়ে যাবে বলে। ঐ ওই পাড়ে তার আর যাওয়া হল না। গেল, কিন্তু গানের মতো নয়, দখিনা বাতাসের মতো নয়।
ধনঞ্জয়ের জিভ বেরিয়ে এসেছিল। আমি মনে মনে ভাবি।

আমার ভয় করে। তবু আমি এখনও সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাই, দেখি ফ্যানের স্পিড আছে কিনা। আর ছাদ দেওয়ার সময় রাজমিস্ত্রি একটা আংটা রেখেছিল কি না ফ্যান ঝোলানোর জন্য, কারণ রাজমিস্ত্রি জানে যে, বাবুর খুব গরম।

আর ক্ষুদিরামেরটা? ইচ্ছামৃত্যু? বোধহয় না। ক্ষুদিরামেরও বাঁচার ইচ্ছা ছিল। সেও ফেঁসে গেছিল। তফাত একটাই, ধনঞ্জয়ের দড়িটা ছিল দেশি, আর ক্ষুদিরামের দড়িটা ছিল বিদেশি। কিন্তু দুজনেরই বাঁচার ইচ্ছা ছিল। বাঁচা, বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকতে সবাই চায়। এই সুন্দর পৃথিবীর আলোবাতাস, মায়ের দীর্ঘ স্নেহ, প্রেমিকার অন্ত্যমিল দেওয়া চুম্বন, এই এই সবই মানুষের বাঁচার ইচ্ছাকে তীব্র করে।

কিন্তু হঠাৎ ঝড় উঠল। নিরীহ পথিকের ঘাড়ে, নিরীহ প্রাচীন গাছ ভেঙে পড়ল। প্রাচীন গাছ তার দেহ দিয়ে পিষে দিল ঐ অজানা পথচারীকে। বাড়ির লোক কাঁদল। শ্মশানযাত্রীর দল গামছা কাঁধে এল সৎকারের জন্য। কিন্তু যে মানুষটি, প্রবীণ বৃক্ষের নীচে চাপা পড়ে মরল, সে তো এই মৃত্যু চায়নি! অর্থাৎ ইচ্ছার বিরুদ্ধে মৃত্যু। বা যে তরুণ জওয়ান কাশ্মীর সীমান্তে জঙ্গীর রকেট হানায় প্রাণ দিল, সেও তো চায়নি এই আচমকা মৃত্যু। কারণ বাড়িতে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে সে রেখে এসেছে, এই তো গতমাসে। স্ত্রী নামক রমণীটির ওষ্ঠও সে তখনও ভালো করে স্পর্শ করেনি। বলেছিল, পরের ছুটিতে এসে সে স্ত্রীর সব গান, সব সুরকে ছোঁবে, স্পর্শ করবে, হানিমুনে যাবে চাঁদে। এই তো সামান্য পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মেজরের নির্দেশে সে প্রায় নীল আকাশের কাছাকাছি যে পাহাড়, সেখানে সে যায় আধুনিক অস্ত্র হাতে এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই সীমান্তের ওপার থেকে আসা আগ্নেয়াস্ত্রে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, এটা কী ইচ্ছামৃত্যু? তা তো নয়! কিন্তু জওয়ানের, দেশের কবিরা তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিল। কেউ অন্ত্যমিলে, কেউ ইনিয়েবিনিয়ে, কেউ পয়ারে, আবার কেউ বা ‘বলো বীর, বলো উন্নত মম শির’ এই ঢঙে সাদা পৃষ্ঠার সর্বনাশ করে, বউকে বলেছিল, “নিজে বাঁচলে বাপের নাম, কী বলো?”
কিন্তু সেই তরুণ জওয়ান বিউগিলে, আবেগমাখা জাতীয় সঙ্গীতের সুরে চিরবিদায় নিয়েছিল তো?
কিন্তু তা কখনোই নিজের ইচ্ছায় ছিল না।

কিন্তু আমি ভীতুর ডিম, সব ব্যাপারেই মনে হয় হেরে যাচ্ছি, আর বারবার তাকাচ্ছি ঐ সিলিং ফ্যানের দিকে।
ইচ্ছামৃত্যু বা সুইসাইড কারোর কারোর কাছে বিলসিতা। হয়ত আমার কাছেও। আমি বরাবর স্যুইসাইডকে মনের মধ্যে নিয়ে খেলেছি, আত্মহত্যার সঙ্গে মৈথুন করেছি, যৌনতাও করেছি। স্যুইসাইড বা ইচ্ছামৃত্যু যেন আমার কেনা জীবন বা মনের অর্ধাঙ্গিনী। খুব দুঃখ বা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যখন যেতাম তখনও আমি সিলিং ফ্যানের দিকেই তাকাতাম। কেন তাকাতাম জানি না। হয়তো সিলিং ফ্যানে আমার অধরা শান্তি আছে, বা আমার না পাওয়া সেই কবিতার পঙক্তিটি। কিন্তু তাকাতাম। এখনও চিৎ হয়ে শুয়ে তাকাই, হয়ত চিৎ বা চিদানন্দের সন্ধান করি। তবে আত্মহত্যার মধ্য কোনো চিদানন্দের চিহ্ন নেই, নেই কোনো ফুলের বাগানও।

বিবেকানন্দ দেবী কালীর কাছে অর্থ, চাকরি, এইসব চাইতে গিয়ে, সংসারের অনটনের কথা বলতে গিয়ে, বলে বসলেন, ‘জ্ঞান দাও, বৈরাগ্য দাও, ভক্তি দাও আর ত্যাগ দাও’।
আমার এ-সবের কোনোটাই নেই। পুরোটাই, আমি আমিতে ভরা। অহংবোধ, লোভ, ক্রোধ, চাওয়াপাওয়ার ইচ্ছা, যৌনখিদে, লালসা এইসব আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফলত, যখন রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ আমাকে বললেন, ‘এত বয়স হল বিয়ে-থা যখন করেননি, মাঝে মাঝে কথামৃতও পড়েন, তাহলে আর দেরি কেন? চলে আসুন মিশনে’।
মানে মিশনের শ্যামল মহারাজ আমাকে গেরুয়া পরতে বলছেন। সন্ন্যাসী।
আমি উত্তরে বললাম, ‘মহারাজ, আপনাদের এত ডিসিপ্লিন যা প্রায় সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার মতো মানতে হয়, এ আমি পারব না। আর তাছাড়া আমার বাড়িতে বিবাহবিচ্ছিন্না তরুণী বোন, তার দুটি শিশু, বৃদ্ধ পিতা, ওদের দেখবে কে?’
শ্যামল মহারাজ অন্য মঠ-মিশনের সন্ন্যাসীদের মতোই কিছু দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক কথা বলেছিলেন। মানে দলে এসো, সেবা করো। আমার মনে তখন পুরোমাত্রায় যৌন-অন্ত্যমিল খেলা করছে। সঙ্গে মায়া। প্রেম। বাবা বোন আর ঐ শিশুদুটির নিরীহ চাহনি। রোববারের মাংস। পানু ছবি। জীবনানন্দের কবিতা। অলস দুপুরে কোকিলের ডাক।

আমি মিশনের মহারাজকে ‘না’ করে দিলাম।

যদি ‘হ্যাঁ’ বলতাম, আজ মনে হয় তবে আমার ইচ্ছামৃত্যু হতো।

রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, কামিনীকাঞ্চনে মন না দিতে। আমার আবার কামিনীকাঞ্চনের প্রতি প্রবল টান থেকেই ভিতরে মায়া জন্মায়। ভালবাসা জন্মায়। আদর জন্মায়। বাড়ি ফেরার টান জন্মায়। আমাদের বাড়িতে কত পাখি আসে, কত ছোট ছোট ফুলগাছ। এদের ছেড়ে আমি সারা বিশ্বের পাখিদের গাছেদের ভালবাসতে পারব না। আমি ছোট, ছোটই থাকতে চাই। বৃহৎ, সে মহামানবের কাজ। সন্ন্যাসী হলে, বা বাড়ি থেকে পলাতক বিপ্লবী হলে, এঁরা দশের। আমি একার, আমি ছয়-সাত জনের। ফলত, নিজের গণ্ডিকে ভালবাসি। নিজের গণ্ডিকে অভিমান করি। নিজের গণ্ডির মধ্যে দুঃখ জমাই। চোখের জল ফেলি। আত্মহত্যার কথা মাথায় আসে। বন্ধুর পুরনো লেখা পোস্টকার্ডের চিঠি পড়ে, ইচ্ছামৃত্যুর চিন্তা মাথা থেকে চলে যায়। গুনগুন করে গান গেয়ে উঠি। বড়ো ভালবাসতে ইচ্ছে করে সবাইকে। সব্বাইকে। নিজেকে জড়িয়ে আদর করি। নিজেকে ভাল না বাসলে আর সবাইকে ভালবাসব কী করে?

আমি আরও জোরে গান গেয়ে উঠি। চিৎকার করে গাই। বিশ্ব-ভুবনকে শুনিয়ে শুনিয়ে হেঁড়ে গলায় গাই।

সিলিঙে অদৃশ্য দড়ি ঝোলে। আমি পাত্তা দিই না। আমি করতাল বাজিয়ে কীর্তন শুরু করি। বলি, আজ খিচুড়ি হোক। সঙ্গে ডিমভাজা। সঙ্গে আনন্দ। সঙ্গে আমার এই নিজস্ব অ্যাড্রেস।

ছেড়ে যেতে পারব না। বিছানায় কোমায় চলে গিয়েও পারব না বলতে, ‘ডাক্তারবাবু ইঞ্জেকশন দিয়ে ইতি টেনে দিন’। আমি পারব না। বড্ড বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে।

পুজোর জামাকাপড় কেনা এখনও যে বাকি। কত লোক টাকা পাবে সেগুলো শোধ করতে হবে না? এখনও রবীন্দ্রনাথ পড়া, পুরোটা হয়নি। এখনো বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’ বাকি। এখনো কত তরুণ কবির, কত কবিতা বাকি।

আর বাকি আনন্দ। আমি এখনও জীবনের সব আনন্দকে পাইনি। আনন্দ আসে, ধরতে গেলে দূরে চলে যায়। পুনরাধুনিক কবিতার দিকে সে চলে যায়।

আমি অপেক্ষা করি। অপেক্ষা। তিতির তুই কোথায়? শিয়ালদায়? ট্রেনের গণ্ডগোল? দুশ্চিন্তা করতে ভালো লাগে। এই দুশ্চিন্তা নতুন সুরের মতন।

তবু অদৃশ্য দড়ি ঝোলে সিলিঙে। আমি তারে পারিনা এড়াতে। 

4 comments:

  1. ওই সেদিন থেকে লেখাটার অপেক্ষায় ছিলাম রানাদা। খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  2. ক্ষুদিরামের সাথে ধনঞ্জয়বাবুর কার্যকারণ সম্পর্ক না থাকলেও দড়িটা এঁটে বসে গেছে গলায় দুজনেরই, ভুল বললাম নাটা মল্লিকের মতো লোকেদেরও।
    খুব ভালো লাগল লেখাখানি।

    ReplyDelete
  3. ক্ষুদিরামের সাথে ধনঞ্জয়বাবুর কার্যকারণ সম্পর্ক না থাকলেও দড়িটা এঁটে বসে গেছে গলায় দুজনেরই, ভুল বললাম নাটা মল্লিকের মতো লোকেদেরও।
    খুব ভালো লাগল লেখাখানি।

    ReplyDelete
  4. বড্ড বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে দাদা, আমারও। বড় মায়া।

    ReplyDelete