ক্লোরোfeel-এর পাতা

Saturday 31 December 2016

রবের ব্রেসঁ ও আব্বাস কিয়ারোস্তামি : স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত

রবের ব্রেসঁ
লিয়াকত আলি সরকারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ২০০৭ সালেপি. জি. হসপিটালে। নিকট আত্মীয়ের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম, প্রায় একমাস থাকতে হয়েছিল সেখানেলিয়াকত আলি এসেছিলেন নিজের চিকিৎসার জন্য মুর্শিদাবাদ থেকেচিকিৎসা হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি থেকে গিয়েছিলেন, সে সব অনেক বিস্ময়কর গল্প, আমার সঙ্গে যখন দেখা হয়  হসপিটালে বসবাসের দুবছর পূর্ণ করেছেন তিনিসাধারণত পেশেন্টের বাড়ির লোকজন যেখানে ঘুমোয়, উনিও রাত্রে সেখানে ঘুমোতেন, সারাদিন রবীন্দ্রসদন, নন্দন, একাডেমি ঘুরে ঘুরে ফিল্ম, ছবির প্রদর্শনী বা এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলি দেখে বেড়াতেন মানুষটির বিভিন্ন বিষয়ে জানাশোনা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। উনি যখন বলতেন, আমি চুপ করে শুনতাম। পোলিশ চলচ্চিত্রকার ক্রিস্তফ কিয়েসলোভস্কির কথা আমি প্রথম এই মানুষটির কাছেই শুনেছিলাম, জেনেছিলাম এই পরিচালকের বহু আলোচিত দুটি  ছবি, ‘আ শর্টফিল্ম এবাউট লভ’ এবং ‘আ শর্ট ফিল্ম এবাউট কিলিং’-এর কথাও। লিয়াকত আলি সরকার কোনও বইপত্র পড়তেন না। বইপত্র রাখারও তো তেমন কোনও জায়গা ছিলনা তারনিত্যনৈমিত্তিক জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর তার নিজস্ব একটি মতামত ছিল। প্রতিটি হ্যাঁ এবং না-এর পেছনে তার নিজস্ব একটি যুক্তি ছিল। বই না পড়ার পেছনে, লিয়াকত আলি সরকারের নিজস্ব যুক্তিটি আমার ভাল লেগেছিল। উনি বলতেন একটি একশ পৃষ্ঠার বইয়ে কাজের কথা লেখা থাকে খুব জোর কুড়ি থেকে পঁচিশ পৃষ্ঠা বা তারও কম, আর বাকি সব পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা কথাগুলি আসলে ঐ ‘কাজের কথা’টিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই লেখা হয়, সেগুলি ততটা কাজের নয়। উনি বরং একজন ভাল পাঠকের সঙ্গে গল্প করতে ভালোবাসতেন, যিনি কথা বলার সময় ঐ কাজের কথাগুলিই বলবেন, অ-কাজের কথাগুলি নিজের থেকেই বাদ দিয়ে দেবেন।
 
সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি বই পড়তে গিয়ে লিয়াকত আলি সরকারের কথা আবার মনে এল। দুটি বইয়েরই অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে সাক্ষাৎকার। আমার কাছে, সাক্ষাৎকার মানে ঐ ‘কাজের কথা’-র সংকলন, যা আসলে এমন এক স্পষ্ট ধারাবিবরণ যেখান থেকে একজন ব্যক্তি, তাঁর জীবনদর্শন, তাঁর কাজ সবকিছুর সম্পর্কে যথাযথ একটি ধারণা গড়ে নেওয়া যায়, অ-কাজের কথাগুলি খুব একটা উঠে আসে না সেখানে। ফলত, বইদুটিও হয়ে উঠেছে ঐ কাজের কথার সংকলন, পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় উঠে এসেছে এমন কিছু তথ্য, তত্ত্ব, চিন্তা-ভাবনার কথা যা একজন পাঠকের সম্পূর্ণ মনোনিবেশ দাবি করে। বই দুটি হল, ‘রবের ব্রেসঁ / চলচ্চিত্র : চিন্তাবীজ’ এবং  ‘চেরির স্বাদ’। ‘চলচ্চিত্র : চিন্তাবীজ’ ফরাসি পরিচালক রবের ব্রেসঁ-র (১৯০৭-১৯৯৯) একমাত্র বই ‘নোটস অন সিনেমাটোগ্রাফি’-র বাংলা অনুবাদ, এবং তার সঙ্গে সংযোজন করা হয়েছে চার্লস টমাস স্যামুয়েলস এর নেওয়া ব্রেসঁ-র একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের বাংলা অনুবাদ। অপর বইটি ইরানিয় পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামির(১৯৪০-২০১৬) পনেরোটি ছোট-বড় সাক্ষাৎকার ও দুটি কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ সংকলন। বইগুলি অনুবাদ ও সংকলন করেছেন সন্দীপন ভট্টাচার্য। প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের প্রকাশন সংস্থা ‘নোকতা’ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন ভৌগলিক পরিমণ্ডলের দুই পরিচালককে নিয়ে নির্মিত হলেও, বইদুটি পাশাপাশি রেখে পড়া যায়, একটিকে বোঝার জন্য অপরটিকে ব্যবহার করা যায়। এই বিশেষ কারণটির জন্যই কি, অনুবাদক বইদুটি পাশাপাশি রাখলেন, প্রকাশক ছাপলেন?

আব্বাস কিয়ারোস্তামি
ফরাসি কবিতা ও চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের আগ্রহের পরিমাণটা কম নয়, তাহলেও ইরানের কবিতা ও চলচ্চিত্র নিয়েও আমাদের আগ্রহ রয়েছে! আব্বাস কিয়ারোস্তামি শুধু একজন চলচ্চিত্র পরিচালক নন, তিনি কবি, তিনি ফটোগ্রাফিরও চর্চা করতেন। কিয়ারোস্তামির দুটি কবিতা বইয়ের অনুবাদ এখানে রয়েছেতাঁর কাজের সম্পর্কে সামান্য হলেও ধারণা আগের থেকে ছিলকিয়ারোস্তামি একজায়গায় বলেছেন, ‘চলচ্চিত্রে যা ঘটতে পারে তা-ই সত্য। বাস্তবের সঙ্গে তার মিল না থাকলেও চলে, সত্যি-সত্যি তা না ঘটলেও চলে।’ আত্মজীবনী লেখার আগে কবি আলোক সরকারকে (১৯৩১-২০১৬) জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কেমন হবে সে রচনার অভিমুখ, আলোক সরকার বলেছিলেন তাঁর জীবনে যা যা ঘটেছে সবই সত্য। যে ঘটনাগুলি ঘটল না, কিন্তু ঘটলে ভালো হত বলে ভেবেছিলেন, সেগুলিও তাঁর জীবনে কম সত্য নয়। তাঁর আত্মজীবনী আসলে সেই না ঘটা ঘটনার বিবরণ! এইখানে আলোক সরকার যেভাবে জীবনকে দেখছেন তার সঙ্গে মিলে যায় আব্বাস কিয়ারোস্তামির সিনেমাকে দেখার ধরনটিও। একই সময়খণ্ডের মধ্যে সৃজনশীল দুজনই যেহেতু কবি, এখান থেকে ধরে নেওয়া যায়, কিয়ারোস্তামির কাছে সিনেমা আসলে জীবনেরই এক বিবর্ধিত রূপ। শিল্প ও জীবন কীভাবে মিলেমিশে যেতে পারে, মিলেমিশে যায়, কিয়ারোস্তামিকে দেখে এটি আরও স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যাবেরবের ব্রেসঁ-কে এই বইটির মাধ্যমে প্রথম চিনলাম, জানলাম তাঁর কাজ, কাজের ধরনকিন্তু কেন এই বইটির মাধ্যমেই তাকে প্রথম জানলাম, চিনলাম? এই প্রশ্নটি নিজেকেই নিজে করে ফেলি। বাংলায় চলচ্চিত্র বিষয়ক কয়েকটি লেখালিখি, এবং কিছু বিশিষ্ট পরিচালকের সাক্ষাৎকার থেকে দেখা গেল বিশ্বচলচ্চিত্র প্রসঙ্গে রবের ব্রেসঁ-র নাম উল্লেখ মাত্রই হয়েছে কোথাও কোথাও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁর নাম অনুল্লেখিত। এখানে গোদার, রেনোয়া, ফেলিনি, আইজেনস্টাইন, ত্রুফো, বার্গম্যান প্রমুখ নিয়ে আলোচনার যে পরিসর রয়েছে, ব্রেসঁ-র প্রসঙ্গ সেখানে নীরবতায় নিমজ্জিত। অতীতে দু-একটি কাজের খোঁজ পাওয়া গেলেও, বাংলায় ব্রেসঁ-র রচনা বই আকারে প্রকাশ সম্ভবত এই প্রথম। আর একটি কথা এখানে স্বীকার করে নেওয়া উচিত, বইদুটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হলেও, এ বাংলায় প্রকাশিত কিছু পত্রিকা, ব্রেসঁ ও কিয়ারোস্তামি চর্চার অভিমুখের ওপর ভিত্তি করেই এই আলোচনাটি করা হয়েছে।

ব্রেসঁ সিনেমা বানানোর প্রচলিত পথগুলিকে পরিত্যাগ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, যা কিছু বানানো সেগুলি মিথ্যে, তেমন সব কিছুর থেকেই দূরে থাকা পছন্দ করতেন ব্রেসঁতিনি কখনওই সেট ব্যবহার করেননি, বানানো সেটগুলি তাঁর কাছে এক একটি অপরূপ মিথ্যে। অভিনেতাদের নিতেন না, অভিনেতা মিথ্যে। ‘নোটস অন সিনেমাটোগ্রাফি’ তে অভিনেতা সম্পর্কে ব্রেসঁ-র ধারণাটি মৌলিক ও চমকপ্রদ ‘পরিচালক তার অভিনেতাদের অবাস্তব বিবিধ বস্তুর মধ্যে কাল্পনিক কোনও মানুষ হয়ে ওঠার দিকে চালিত করে। যে-মিথ্যে সে বেছে নেয়, তা কখনও সত্যে বদলে যায় না।’ সাধারণ মানুষ, যাদের অভিনয়ের কোনও পূর্ব ধারণাই নেই, তাদের দিয়ে অভিনয় করাতেন। ব্রেসঁ তাঁর ‘নিজস্ব’ অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের অ্যাক্টর বা অ্যাক্ট্রেস নয়, বলতেন ‘মডেল’। সিনেমায় আবহসংগীতের ব্যবহার করতেন না, কারণ তা বানানো, তিনি অরিজিনাল সাউন্ডের ব্যবহার পছন্দ করতেন। আমাদের আলোচিত বইটিতে মুদ্রিত হয়েছে, ব্রেসঁ সম্পর্কে কয়েকজন পৃথিবী-খ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকের মন্তব্য। আন্দ্রেই তারকভস্কি বলেছেন, ‘ব্রেসঁ হলেন জিনিয়াস। এখানে একেবারে সোজাসুজি কথাটা বলতে চাই যে, তিনি জিনিয়াস। আর এ ক্ষেত্রে তিনি যদি থাকেন একেবারে প্রথমে, তবে তাঁর পরেরজনের স্থান হল দশ-এ। এই দূরত্ব খুবই বিষাদের।’

চলচ্চিত্র সম্পর্কে যাবতীয় চিন্তাভাবনা ছোট ছোট নোটস-এর আকারে ব্রেসঁ লিখে রেখেছিলেন। তাঁর সেই ‘Notes sur le cinématographe’-র অনুবাদ নিয়েই এ বইটির প্রথম অংশ। মূলে ফরাসিতে রচিত, যে ইংরেজি অনুবাদ থেকে তা এখানে অনূদিত হয়েছে তার অনুবাদকের নাম যদিও অনুল্লেখিত রয়েছে। মনে হয় না, এই অংশ পাঠ করে একজন নবীন পরিচালক চলচ্চিত্র নির্মাণের খুঁটিনাটি ব্যাপারে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা গড়ে নিতে পারবেনবরং এখান থেকে জেনে নিতে পারবেন ব্রেসঁ-র চলচ্চিত্র দর্শনটিকে, হয়তো চিনে নেওয়া যাবে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন ও মৌলিক ধারার একজন পরিচালককে তাঁর ‘নোটস অন সিনেমাটোগ্রাফি’ সোজাসুজি একজন পরিচালককে গড়ে উঠতে সাহায্য করে না ঠিকই, কিন্তু কিয়ারোস্তামির সিনেমা নির্মাণের পদ্ধতি এবং চলচ্চিত্র বিষয়ক চিন্তাভাবনা থেকে  এটা বোঝা যাবে, ব্রেসঁ তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ওপর কতটা অবশ্যম্ভাবী প্রভাব রেখে গিয়েছিলেন, এবং যে প্রভাব নিজ দেশ বা জনপদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নাএকজন পরিচালক কতটা দেখাবেন কতটা দেখাবেন না, এ বিষয়ে ব্রেসঁ তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “একদা আমি বলেছিলাম, ‘চলচ্চিত্র হল কোনও কিছু না-দেখানোর শিল্প’। আমি যা প্রকাশ করার, ন্যূনতম উপায়েই তা করতে চাই। ভীষণ ভাবে প্রয়োজনীয় না-হলে আমি তা দেখাই না।” আবার ডেভিড স্টেরিট-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, ইরানের ‘নিউ ওয়েভ’ সিনেমার পুরোধাপুরুষ কিয়ারোস্তামি বলছেন, “আমি এই ধরনের ছবিই তৈরি করতে চাই, যা না-দেখিয়ে দেখায়। ... এখনকার অধিকাংশ ছবি হয়তো আক্ষরিক অর্থে পর্নোগ্রাফিক নয়, কিন্তু আদতে তা-ই। কেননা তা এত বেশি দেখায় যে কোনওকিছু কল্পনা করে নেওয়ার সম্ভাবনাটুকুও তারা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়।” দুজনেই পেশাদার অভিনেতাদের বাদ দিয়েছেনসাধারণ মানুষজন, যাদের অভিনয় সম্পর্কে পূর্ব ধারণা নেই, এমন অপেশাদার লোকজন দিয়েই অভিনয় করিয়ে নিতে পছন্দ করতেন ব্রেসঁ এবং কিয়ারোস্তামিব্রেসঁ অভিনয় চলাকালীন রাসপ্রিন্ট পর্যন্ত দেখতে দিতেন না তাঁর মডেলদের, কারণ ভুল-ত্রুটিগুলি দেখে তারা নিজেদের অভিনয় সম্পর্কে সচেতন হবে, এবং তা ব্রেসঁ-র জন্য হয়ে উঠবে প্রভূত সমস্যার কারণ। এজন্য একই মডেলকে ব্রেসঁ  দুটি সিনেমায় ব্যবহার করতে চাননি, সবসময় খুঁজে ফিরেছেন নতুন নতুন মডেল, প্রয়োজনমাফিক অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন তাদের দিয়েকিয়ারোস্তামির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি একই। কিয়ারোস্তামি যদিও পেশাদার অভিনেতাদের গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি, কিন্তু নিজের ছবির ক্ষেত্রে অপেশাদার লোকজনের ওপরেই আস্থা রেখেছেন বেশি ‘টেস্ট অফ চেরি’-র প্রধান অভিনেতা মিস্টার বাদির সম্পর্কে কিয়ারোস্তামির বাস্তব উপলব্ধি আসলে অপেশাদার অভিনেতা বিষয়ে ব্রেসঁ-র অবস্থানটিকেই মান্যতা দেয়, এবং কিয়ারোস্তামির তাদের প্রতি আস্থার কারণটিকেও আমাদের কাছে পরিষ্কার করে দেয়কিয়ারোস্তামি বলেছেন “মিস্টার বাদি আমার ছবিতে কাজ করার পর আরও দুটো ছবিতে কাজ করেছে, কিন্তু কোনওটাতেই খুব সফল হতে পারেনি, অন্তত আমার ছবির মতো সফল হয়নি। তার কারণ আমার ছবিতে কাজ করার সময় সে কিছুই জানত না, কিন্তু পরের দুটো ছবি করার সময় সে কিছুটা জেনে ফেলেছে, আর সেটাই তাকে সমস্যায় ফেলে!”

কিয়ারোস্তামি কবি, কবিতা লিখতেন, কবিতায় যে দ্ব্যর্থবোধকতা গৃহীত তার কাছাকাছি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের ভাষাটিকেও। ব্রেসঁ কবিতা লেখেননি, চলচ্চিত্রের চারপাশকে নিজের মতো করে দেখতে চাওয়া, নিজের মতো করে বুঝতে চাওয়ার তাগিদেই ‘নোটস অন সিনেমাটোগ্রাফি’। এই দেখার চোখটি, এই বোঝার মনটি যতটা একজন পরিচালকের, ততটাই একজন কবির যাঁর নিজস্ব একটি দর্শন রয়েছে। তিনি যখন লেখেন, ‘অপ্রত্যাশিতকে জাগাও। প্রত্যাশা করো তার।’ একজন কবিকেই খুঁজে পাওয়া যায় আসলেতাঁর চিন্তাবীজগুলি এরকম
        ...অদৃশ্য বাতাসকে জল দিয়ে অনুবাদ, যাওয়ার সময়ে যার ভাস্কর্য গড়ে দিয়ে যায় সে।
      
       ...মডেল। তাদের নিজেদেরই সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে যেতে পারে তারা, পারে অলৌকিকভাবে হয়ে উঠতে, যেমন তারা ‘নিজেরা’।
        
 ...মডেল। তার অযৌক্তিক, যুক্তিবিরহিত ‘আমি’, যা তোমার ক্যামেরা ধরে রাখে।

*       ...আমরা যে একই জায়গায় আছি তা একই কোলাহল, একই কণ্ঠধ্বনি দিয়ে জানিয়ে দাও।

*       ...মডেল। বাইরে থেকে যান্ত্রিক। ভেতরে অক্ষত, আদিম।
*       ...দুটি মানুষ পরস্পরের মুখোমুখি, চোখে চোখ। দুটি বিড়াল পরস্পরকে কাছে টানে...।

ব্রেসঁ-র ছবি বানানোর  মূলে রয়েছে এ ধরনের ভাবনাগুলি। তাঁর কাজগুলি, তাদের পরিণতি নিয়ে স্পষ্ট কোনও ধারণা তিনি নিজেও পোষণ করেন না। কোনওকিছুর জন্যই কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই তাঁর কাছে। চার্লস টমাস স্যামুয়েলস যখন ব্রেসঁ-র কাজের বিভিন্ন অর্থ ও তাৎপর্য তুলে ধরেন, ব্রেসঁ নির্লিপ্ত থাকেন, কখনও উলটে বুঝে নিতে চান কোনও দৃশ্যের বিশেষ কোনও তাৎপর্য রয়েছে কী না যা তিনি নিজেও ধরতে পারেন নি। আর এ সকলের জন্য, তাঁর একমাত্র সহায়, কবি পল ভালেরির একটি উক্তি— ‘লোকে কাজ করে নিজেকে বিস্মিত করার জন্য’। একজন কবিও রচনা করেন নিজেকে বিস্মিত করার জন্য। পূর্ব ধারণা, পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা এ সবই মূল্যহীন একটি শাদা পৃষ্ঠার সামনে, এক একটি ছত্র রচিত হওয়ার আগে এবং পরে। বিস্ময়, এবং বিস্ময় ব্যতীত অন্যকিছু নয়, যা ব্রেসঁ নিজের জন্য, নিজের দর্শকের জন্য, চল্লিশ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে মাত্র তেরটি ছবি জুড়ে নির্মাণ করতে চেয়েছেন কিয়ারোস্তামির সঙ্গে কবিতার যোগ সুস্পষ্ট ও নিবিড়। পরিচালিত সিনেমাগুলির কয়েকটির নামকরণ থেকেই কিয়ারোস্তামির কবিসত্তাটিকে পরিষ্কার চিনে নেওয়া যায়যদিও, ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস’ এই অসামান্য নামকরণটি ইরানের কবি ফারুঘ ফারুকজাদ(১৯৩৫-১৯৬৭)-এর একটি কবিতা থেকে নেওয়া। শুধু নামটি-ই নয়, চিত্রনাট্যের একটা ছোট অংশ রচিত হয়েছে এ কবিতাটি থেকে। ব্রেসঁ-র তাত্ত্বিক অবস্থান যেখানে চলচ্চিত্রকে সবধরনের নাটকীয়তা থেকে মুক্ত করা, কিয়ারোস্তামি চেয়েছিলেন কাব্যিক চলচ্চিত্রের একটি ধারণা গড়ে তুলতে। এখানেই, প্রথমবারের জন্য, ব্রেসঁ ও কিয়ারোস্তামির নীতিগত অবস্থানের মধ্যে একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হলসব ধরনের নাটকীয়তার থেকে মুক্ত অর্থে ব্রেসঁ চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রকে, মঞ্চ(সেট), পেশাদার অভিনেতা, প্রক্ষেপিত আলো, আবহ সঙ্গীতের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করা, একটি স্বাধীন শিল্প মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলা। কারণ, আমরা সিনেমা বলতে সবদিন যা বুঝে এসেছি, সেটিকেই ব্রেসঁ বললেন ‘চলচ্চিত্রায়িত থিয়েটার’। মনে রাখতে হবে, কিয়ারোস্তামি কাব্যিকতার কথা বললেও, তাঁর ছবিও আসলে সবধরনের নাটকীয়তাকে বর্জন করেই হয়ে উঠতে চেয়েছিল কাব্যিক। অর্থাৎ কবিতার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে তিনি চলচ্চিত্র-কে মুক্ত করতে চাইলেন না। কিংবা, এটিকে আলাদা করে কোনও ‘নির্ভরশীলতা’ বলে ভাবতে চাইলেন না তিনিযে কোনও শিল্পের চরমতম অবস্থানটিই আসলে বিশুদ্ধতম অবস্থান, তখন তা কবিতার সঙ্গে তুল্য হয়ে ওঠে তাহলে কিয়ারোস্তামি কি এখানে চলচ্চিত্রের সেই চরমতম বিশুদ্ধ রূপটির কথাই বলতে চাইলেন? ‘নোটস অন সিনেমাটোগ্রাফি’-র ভাষা, ভাষা ব্যবহারের ধরন থেকে আমাদের মনে হতেই পারে, ব্রেসঁ আসলে একজন কবি যিনি এসে দাঁড়িয়েছিলেন ক্যামেরার পেছনে, ব্রেসঁ চাইলেও এই তুলনার ঊর্ধ্বে নিজেকে নিয়ে যেতে পারবেন না। আমরা  একটি কবিতার কাছে বারবার কেন ফিরে আসি? একটি গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্রে এ সুযোগ প্রায়শ থাকে না কেন? কবিতার সঙ্গে যে দ্ব্যর্থবোধকতা জুড়ে থাকে, সম্পূর্ণভাবে ধরা না দেওয়ার যে অভিপ্রায়টি লুকিয়ে থাকে, সেগুলোই আমাদের বারবার কবিতার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী, কিয়ারোস্তামি এটি অনুধাবন করেছিলেনএকটি সিনেমা প্রথম বা দ্বিতীয় দর্শনের পরই ফুরিয়ে যায়, কিয়ারোস্তামি এই সংখ্যাটি বাড়াতে চেয়েছিলেন নিজে একজন কবি হওয়ার ফলে, কবিতার একজন পাঠক হওয়ার ফলে, এবং একইসঙ্গে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার ফলে এ অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধিগুলোর জন্য তাঁকে অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হয়নিএখানে, কিয়ারোস্তামির দুটি কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ সংকলিত হয়েছে, মূল ফারসি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ থেকে এখানে কবিতাগুলি অনূদিত হয়েছে গ্রন্থদুটি হল ‘ওয়াকিং উইথ দ্য উইন্ড’(হাওয়ার সঙ্গে হাঁটছি) এবং, ‘আ উলফ লাইং ইন ওয়েট’(নেকড়ে রয়েছে প্রতীক্ষায়)। অনুবাদে, সবচে’ ছোট কবিতাটি দু’ লাইনের, এবং বড় কবিতাটি আট লাইনের, এভাবে বললে পুরোপুরি ঠিক বলা হয় না, বরং ছোটটি তিনটি শব্দে এবং সবচে’ বড় কবিতাটি ছাব্বিশটি শব্দে এভাবে বললে তবুও অনেকটাই ঠিক বলা হয়। হাইকু কবিতার ধরনে ছোট ছোট করে লেখা তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলা হয়, ফারসি কবিতার যে ঐতিহ্য সেখান থেকে বেরিয়ে এসে কিয়ারোস্তামি কবিতাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন, গীতিময়তাকে বাদ দিয়েছিলেন। অনুবাদ এই বিষয়গুলিকে যথাযথভাবে ধরতে পেরেছে, এবং কয়েকটি অ-ভারতীয় অনুষঙ্গের কথা বাদ দিলে, মনে হতে পারে কবিতাগুলি যেন বাংলাতেই রচিত হয়েছে কিয়ারোস্তামি যখন কবি, কবিতাকেও তিনি বাহুল্যবর্জিত করে তুলবেন, এটি খুব স্বাভাবিক। ‘নেকড়ে রয়েছে প্রতীক্ষায়’ কাব্যগ্রন্থটিতে সবচে’ বাহুল্যবর্জিত কবিতাটি হল তিন লাইনের একটি কবিতা ‘রাত / সাগর / শীত।’ আর সবচে বেশি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে একই কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটিতে ‘একটা ছায়া / আমায় বরাবর অনুসরণ করে / ছোটবেলায় সে ছিল / আমার খেলার সাথী; / আমার সঙ্গে বড় হয়েছে সে, / আমার সঙ্গে বুড়ো, / কবর পর্যন্ত / আমার সঙ্গে থাকবে সে।’ বাহুল্যবর্জনের ব্যাপারটি ছাড়া, একজন কবিতার পাঠককে এই কবিতাগুলি কিয়ারোস্তামির লেখা কবিতা হিসেবেই পড়তে হবে, কারণ তার কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতায় আরও আরও অনেক বিস্ময় আগে থেকেই সঞ্চিত রয়েছে, সেখানে নতুন করে কোনও বিস্ময় হয়তো আর যুক্ত হবে না। তারপরেও কিয়ারোস্তামির কবিতা নিয়ে বলার কথাটি এখানেই ফুরোল না, বরং শুরু হল বলা যায়ব্রেসঁ-র সময়ে আমাদের মনে হয়েছিল, একজন কবি আসলে ক্যামেরার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, আর এক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটি ভেবে নিতে পারলে কিয়ারোস্তামির কবিতার বিস্তৃততর একটি তাৎপর্য হয়তো খুঁজে পাওয়া যেতে পারে! একজন পরিচালক যিনি আসলে কবিতা লিখছেন। কবিতা নয়, প্রকৃতপ্রস্তাবে এক-একটি দৃশ্য, শর্ট বা ইমেজকে এভাবেই ধরে রাখতে চাইছেন তিনিএই দৃশ্যগুলিকে আমাদের পড়তে হবে, পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ করে দেখে নিতে হবেঅন্তর্নিহিত অপার সৌন্দর্যটিকেও
*       ...তুষার / এত দ্রুত গলছে / শিগগিরই ছোট-বড় / সব পায়ের ছাপ / মুছে যাবে।
*       ...শুকনো গাছে / বৃষ্টির ধারা / দূরে এক কাকের চিৎকার।
*       ...ট্রেনটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে / থামে / রেলপথে শুয়ে একটা প্রজাপতি।
*       ...হেমন্তের প্রথম দিনে / দু-হাত দিয়ে / আমার টুপিটা ধরে থাকি / বাতাস কি আমাদের নিয়ে যাবে?
*       ...ছাতাটা ফেলে এসেছি; / সামনে দীর্ঘ পথ, / আর কালো মেঘের স্তূপ।
*       ...অর্ধেক হলুদ / অর্ধেক লাল / চেরির স্বাদ / অনুমান করতে পারে কে?
কিয়ারোস্তামি মনে করেন ‘চলচ্চিত্রের সারকথা হল ইমেজ-এর উৎপাদন’। এমন সব দৃশ্যগুলিকেই তিনি হয়তো একে একে ক্যামেরায় ধরে ফেলতেন আগামীর কোনো ছবিতেকিংবা, কোনো কোনোটি ধরে রেখেছেন হয়তো তাঁর ক্যামেরার নিজস্ব ভাষায়, দেখার সময়ে আমরা যা মিলিয়ে দেখে নিতে পারি নি। এই সব প্রশ্ন, প্রশ্নের ভিতরে নিহিত সংশয়, আমাদের জন্য অমীমাংসিত রেখে, গত ৪ জুলাই, ২০১৬ কিয়ারোস্তামি চিরকালের জন্য ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে নিলেনফলত গোদার এর সামনে আর কোনো বাধাই থাকল না এমন দাবি করার পেছনে যে, ‘চলচ্চিত্রের শেষ কিয়ারোস্তামি-তে’!
গান, গল্প, ছবি সবকে একজায়গায় করে সিনেমা হল আমাদের অবসর দখলের এক ফন্দিসিনেমাওয়ালারা এই ফন্দি আঁটলেন, সফল হলেন, আমাদের অবসর নিয়ে ব্যবসা করলেন। সিনেমাকে বিদ্ধ করার জন্য, অনেকগুলির মধ্যে এটি-ই বোধহয় সবচে বিশিষ্ট অপবাদ। বিশ্বচলচ্চিত্রের মধ্যে যাঁরা যাঁরা এই শিল্পটিকে অপবাদ মুক্ত করতে চাইলেন, স্বাধীন একটি শিল্প মাধ্যম হিশেবে গড়ে তুলতে চাইলেন, নতুনভাবে ভাবার ও ভাবতে শেখার অনেক খোরাক যুগিয়ে গেলেন তাঁদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই ব্রেসঁ একজন, কিয়ারোস্তামি আর একজন। অতীতে বাংলায় দু-একটি কাজ বিচ্ছিন্নভাবে হলেও, ব্রেসঁ-কে নিয়ে এমন একটি গ্রন্থ আর হয়তো একটিও নেই। কিয়ারোস্তামি-কে নিয়েও কি আছে এমন কোনো বই? বইদুটির নিখুঁত পরিকল্পনা ব্রেসঁ ও কিয়ারোস্তামিকে অনেকটাই চিনতে সাহায্য করে যেমন, তাঁদের সিনেমাগুলি দেখার আগ্রহটিকেও অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। সবচে গুরুত্বপূর্ণ যেটি, নতুন করে ভাবার, ভাবতে চাওয়ার ইচ্ছেটিকেও উসকে দিতে পারে এই ধরনের কাজগুলি। সুন্দর করে বইদুটি প্রস্তুত করা হয়েছে, এই মানের গ্রন্থনির্মাণ বাংলা বইয়ের প্রকাশনার জগতে খুব বেশি হয় বলে মনে হয়না, ইংরেজি বইয়ের ক্ষেত্রে যা প্রায়শই হতে দেখা যায় বইগুলির বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, প্রচ্ছদ, অলংকরণ, বিষয়বিন্যাস সবক্ষেত্রেই নতুন ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে, একজন পাঠকের দৃষ্টি এগুলিকেও এড়িয়ে যাবে না বলেই মনে হয়


·      ***রবের ব্রেসঁ/চলচ্চিত্র : চিন্তাবীজ। ভাষান্তর : সন্দীপন ভট্টাচার্য। প্রকাশক : নোকতা (কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা ১২০৫, বাংলাদেশ)। পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশক : মনফকিরা। মূল্য : ৩৫০ টাকা ।

·     ***চেরির স্বাদ । সংকলন ও ভাষান্তর : সন্দীপন ভট্টাচার্য । প্রকাশক : নোকতা (কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা ১২০৫, বাংলাদেশ)। পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশক : মনফকিরা। মূল্য : ৩৪০ টাকা ।

Wednesday 28 December 2016

যখন 'সংসার পেতেছে অনটন' : সুকান্ত দে

কবি কবিতার ভাবনার মধ্যে বাঁচবেন না কবিতার পরিসর ও পরিবেশ রচনায় অধিকতর গুরুত্ব দেবেন এই নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে। তাই একজন কবি যখন ৭৪ বছর বয়সে এসে তাঁর ৪র্থ কাব্যগ্রন্থ এবং ৭ম গ্রন্থ প্রকাশ করেন তখন পাঠক তাঁর কাছে কি প্রত্যাশা করবে? দিকনির্দেশ নাকি অভিজ্ঞতার গল্প? ২০০৯ থেকে জুলাই ২০১৬, এই দীর্ঘ পরিসরের কবিতাবলী থাকার ফলে কবির কবিতার গতিপ্রকৃতি এবং রচনাশৈলীর পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ রয়েছে পাঠকের কাছে। অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় - "আজ তারা নক্ষত্রের প্রতিবেশী বলে / তাদের গলায় দোলে অনিবার্য মালা", তাই বইটি হাতে পাওয়া মাত্রই মনে হল যে কবি "পাকদন্ডী বেয়ে ঢুকেছে আগুনে", তাঁর কথা যত শীঘ্র বলা যায় ততই ভালো। বইটিতে ছন্দ কবিতা, গদ্য কবিতা, শ্লেষাত্মক কবিতা থাকলেও, অলোক সামন্ত দীর্ঘদিন নাটকে অভিনয় করেছেন, পরিচালনা করেছেন, তাই কবিতাতেও তার ছাপ, এনে দিয়েছে ভিন্ন স্বাদ। দীর্ঘদিন বর্ধমান শহরে যাঁরা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বজায় রাখার জন্য শ্রম দিয়েছেন, তিনি যদি লেখেন, "তপস্যার স্বাধীনতা পেলে আকাশেও ফোটে ফুল / স্বপ্নের গভীর থেকে বাতাসের তৃষ্ণা উঠে আসে", তখন এই ভেবে খুশি হতে হয় যে তাঁর লেখায় উঠে আসা অভিজ্ঞতা শ্রমের ফসল। যদিও তাঁর মধ্যে তৎসম শব্দপ্রয়োগের এক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পয়োধিমন্থন, অনশনক্লিষ্ট, প্রমোদপ্রিয়, হৃদয়প্রদেশে ইত্যাদি বড় শব্দের প্রয়োগ বর্তমান সময়ের নিরিখে কবিতাকে একটু শ্লথ করেছে ঠিকই কিন্তু প্রয়োজনের দিকেও কবির সজাগ দৃষ্টি। পেশায় শিক্ষক ছিলেন, বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকাও পরিলক্ষিত হয়। যখন ছাত্র, মহম্মদ জাফর এর অকালমৃত্যু নিয়ে তিনি লেখেন, বা লেখেন, "খুব ভালো করে টেরি বাগাই / সেজন্য আয়নার দরকার পড়ে না...প্রত্যেক কর্মীর দিকে তাকিয়ে দেখি / প্রত্যেকেরই চোখ আয়না হয়ে আছে / বহুদিন পর নিজেকে ভালো করে দেখলাম"। বর্তমান কম্পিউটারের ব্যবহারের মধ্যে ডুবে যাওয়া প্রজন্মের প্রতি তাই শ্লেষ আসে, "অনর্ঘ অর্ঘ দিলে চাঁদের লোভনীয় হাসি / কম্পিউটারে তার বাঁধ ভেঙে যায় / অনিচ্ছা থাকলেও ঢালো গন্ধের সুধা / উপচিয়ে পড়ে তার ফ্লাওয়ারের ভাস", আর তখন আসে ছন্দের প্রয়োগ। দাদা ঠাকুর 'বোতল পুরাণ' লিখেছিলেন ছন্দে। ছন্দে বা ছড়ায় শ্লেষ কি ভালো ফোটে? হয়তো বা। কিন্তু একাধারে নাট্যকারের কলমে শ্লেষ এবং সমাজভাবনা অন্যভাবেও আসে, "পথের একপাশে শুয়ে আছে তিন জীব যাদের প্রত্যেকেই হারিয়েছে জীবন অথচ কী ভীষণ জীবন্ত সবাই...তিনটি মৃতদেহ যথাক্রমে একটি সবুজ গাছ, একটি বাবুই পাখি / এবং এক কারখানার শ্রমিক"। 'অনাবাসী নাগরিক' কবিতাটি একটা ২৮ লাইনের নাটকই মনে হয় যেখানে মানুষ মেকআপ ছাড়াই বুঝিয়ে দেয় তারা কার চরিত্রে অভিনয় করছে এবং সে চরিত্ররা বুঝিবা "তবে অভিনয় ছাড়া আমি কিছুই করিনি" এমনই এক স্বীকারোক্তি দিয়ে বসে। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন সহধর্মিণী শ্রীমতী প্রভা সামন্ত, গ্রন্থের নামের সাথে সাযুজ্য রেখে। মুদ্রণপ্রমাদহীনতা হয়তো তাঁর শিক্ষকতা করার ফসল। আজীবন নিপাট ভদ্র অথচ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক মানুষের কাব্যগ্রন্থটি তাই শুধু অভিজ্ঞতা নয়, পরিশ্রমী যাপন ও বিশ্বাসের ফসল।


কবি : অলোক সামন্ত
কাব্যগ্রন্থ : কুয়াশার ছবি
বিনয় প্রকাশনী
১০০ টাকা

শিল্প : অস্বীকার থেকে নতিস্বীকার - দেবব্রত কর বিশ্বাস



জীবনে দু'বার 'অস্বীকার' থেকে 'নতিস্বীকার'-এর অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার

প্রথমটি গান সম্বন্ধীয় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ছোটবেলা থেকেই ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল মিউজিক আমার অসহ্য লাগত অন্য অনেকের মতো আমিও ভ্যাঙাতাম কী যে সব 'আআআআআ' করে গলা কাঁপিয়ে পাগলের মতো গান করেন লোকজন...এমনটাই ভাবতাম বিরক্ত লাগত আমার এই কথা শুনে আমার ছোটমেসো একদিন বলল  "কখনও শান্ত হয়ে মন দিয়ে শুনেছিস?"... দু'দিকে মাথা নাড়লাম মেসো আবার বলল – "একদিন চুপ করে বসে মনকে কনসেন্ট্রেড করে শোন প্রথমে বিরক্ত লাগবে, কিছুক্ষণ পরে দেখবি কোথা দিয়ে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারবি না" নেহাতই এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য আমি রাজি হয়ে গেলাম মেসো চালিয়ে দিল শ্যামকল্যাণ রাগ আমি চুপ করে বসলাম প্রথমে হাসি পেল তারপর মাথাটা ভার হয়ে এল তারপর...মাথাটা ছেড়ে গেল...যাবতীয় জাগতিক বাস্তবতা থেকে, না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে, ছুঁতে না পারা স্বপ্নগুলো থেকে দূরে আমার ভাবনা ভ্রমণ করতে শুরু করল তার নিজস্ব জগতে, যেখানে নিজেকে গোটা ব্রহ্মাণ্ডের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মনে হতে লাগল, মনে হল আমার মনের দরজাগুলো খুলে যাচ্ছে, হাওয়া ঢুকছে, আলো ঢুকছে...নিজেকে ফিরে পাওয়ার আলো শুনতে শুনতে ঘোরে চলে গিয়েছিলাম এক অপূর্ব ঘোর সেই ঘোর যখন ভাঙল, তখন দেখলাম অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে আর আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে জল পড়ছে...

দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা এবং অন্যান্য বই পড়ার সুবাদে রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে আমার ভালোই পরিচয় ছিল তবে আশেপাশের কিছু টিপিক্যাল 'রবীন্দ্র-অনুরাগী'দের রাবীন্দ্রিক ন্যাকামির কারণে হোক বা অল্পবয়সের অস্বীকার-প্রবণতা...রবীন্দ্রনাথ আমার খুব একটা পছন্দের লেখক ছিলেন না তখন আমি জীবনানন্দ, শক্তি, বিনয়, সন্দীপন- মগ্ন বিপদে পড়লাম এমএ পড়তে এসে সিলেবাসে আবার একগাদা রবীন্দ্রনাথ একদিন দুপুরে বাড়িতে বসে সিলেবাসে থাকা 'অচলায়তন' নাটকটি পড়লাম... এখনও মনে আছে নাটকটি পড়া শেষ করে জানলা দিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে বসে ছিলাম নিজেকে কেমন শূন্য লাগছিল, বিরাট প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের যেমন নিজেকে শূন্য মনে হয়, ঠিক তেমন...তারপরের দিন পড়লাম 'রাজা', তারপরের দিন 'লিপিকা'...রবীন্দ্রনাথ যেন আমার হাত ধরে আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর রচনার গভীর তলদেশে আমি, যে কিনা আগে ওপর ওপর পড়ে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখে এসেছি সেই আমি এবার বাধ্য হলাম ঢুকে পড়তে তাঁর সাহিত্যভাবনায় আবিষ্কার করলাম রবীন্দ্রনাথকে, এমনকী নিজেকেও এইরকম একই অভিজ্ঞতা আমার বন্ধু বিশ্বদীপেরও হয়েছে এমএ পড়তে গিয়ে মনে আছে বইমেলায় একদিন আমি আর বিশ্বদীপ একসঙ্গে 'রক্তকরবী' কিনেছিলাম যেদিন কিনেছিলাম, সেদিনই বাড়িতে এসে পড়ে ফেলেছিলাম এক নিশ্বাসে নন্দিনী, রঞ্জন, রাজা, বিশুপাগলা, প্রফেসর, কিশোর যেন আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছিলাম আমরা দুজন সারাদিন শুধু রক্তকরবী নিয়েই আলোচনা করতাম সেই থেকে আমি আর আমার বিশ্বদীপ নিশ্চিত যে একটা 'রক্তকরবী' লিখলে সারা জীবনে আর কিছু না লিখলেও চলে সেই মানুষটিকে অস্বীকার করে দূরে সরিয়ে রাখা এক চরম চালাকি আমি বলছি না, তিনি যা লিখেছেন সব মাথায় তুলে নেচে অন্য সবাইকে দুচ্ছাই করতে, কিন্তু এটাও ঠিক তাঁর লেখার এবং ভাবনার ব্যাপ্তির ধারেকাছেও আমরা কেউ পৌঁছতে পারিনি তা এমন মানুষের নাম ব্যবহার করে কিছু মানুষ প্রচার পেতে চাইবেন এটাই তো স্বাভাবিক! এটাই তো সহজ পদ্ধতি কিন্তু যারা মন দিয়ে না-পড়ে রবীন্দ্রনাথকে দূরে সরিয়ে রাখছেন, তাঁদের বলি, পড়ে দেখুন, পড়া মানে কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করার জন্য পড়া নয় একটু গভীরে ঢুকতে চেষ্টা করুন দেখবেন কী কী সব মণিমুক্ত রাখা!

রবীন্দ্রনাথ আসলে ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল মিউজিকের মতো ওপর ওপর পড়লে মাথার ওপর দিয়ে যাবে... আর ভিতরে নেমে পড়লে সমস্ত মানসিক অশান্তি নেমে যাবে...আপনি ভেসে পড়বেন এক অনাবিল আনন্দে সেই আনন্দ বিরাট প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চিনতে পারার আনন্দ