সালটা ২০০৫। অবভাস পত্রিকা সম্পাদনা করি। সে সময় হাতে এল অজিত
চৌধুরীর লেখা এক দীর্ঘ প্রবন্ধ। বিষয় :উৎপলকুমার বসু এবং উৎপলোত্তর বাংলা
কবিতা। এ প্রবন্ধের এক জায়গায় শ্রীচৌধুরী লিখছেন : "উৎপলের ন্যূনতম কবিতা
আমাদের, নবীন কবিদের(বয়সে প্রবীণ, কবিতায় নবীন আমি) কবিতা লেখার এক
অনাবিষ্কৃত মহাদেশের সন্ধান দেয়। কৃত্তিবাস ও হাংরিদের হাততালি কুড়োনো
স্টেজ মাত করার পর ভাস্কর-রণজিৎ-পার্থপ্রতিম-মৃদুল-প্রসূনরা বাংলা
কবিতায় যে নিঃশব্দ রেভল্যুশন করেছেন, তার প্রেক্ষিতে একজন নতুন কবির কাছে
কবিতা লেখার কাজটা বড়ো কঠিন, বিশেষত, তার যদি বাংলা কবিতায় ছোটো মাপেরও
কোনো ইন্টারভেনশন করার ক্ষুদ্র বাসনা থাকে। সেখানে মাত্রাবৃত্ত এবং
অক্ষরবৃত্তে কথোপকথনের মাধ্যমে এক নতুন ধরনের আনএক্সপ্লোরড কবিতা-ক্ষেত্রের
দিশা দেয় উৎপলের এই("ন্যূনতম কবিতা")কবিতাটি।...... বস্তুত, মধুসূদনের পর
বাংলা কবিতার ছন্দে উৎপলের মতো এত বড়ো ব্রেক বোধহয় আর কোনো কবি আনেন নি।
আমি রবীন্দ্রনাথের কথা মাথায় রেখেই বলছি আমার রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ(যা
একেবারে কম নয়) এ কথাই আমাকে শিখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ অনন্যসাধারণ, তাঁর
প্রতিভা বুঝি। শুধু তাঁর গানই তাঁকে অমরত্ব দেয়। তিনি জয়দেব এবং চণ্ডীদাস
ভিতে বাংলা মাত্রাবৃত্ত ছন্দ তৈরি করেছেন, তাও বুঝি। এবং এটা একটা বাংলা
কবিতায় অবদান। বিরাট বড়ো অবদান। কার্যত তিনিই একটি ছন্দ --মাত্রাবৃত্তের
স্রষ্টা। কিন্তু সে ছন্দে তরুণ কবিরা লেখে না। বা, পঞ্চাশের কাছাকাছি
কবিরা। বোধ হয় এই ছন্দে শহুরে জীবন ধরা যায় না।.... উৎপল আভাগার্দ কবিতায়
অসাধারণ মুক্তমনা। সেখানে পদে পদে হোঁচট খাওয়া তরুণ কবিদেরও উৎসাহ দিয়ে কবি
তৈরি করে দেন তিনি। উৎপলের মতো একজন স্টলওয়ার্ট এতদিন ধরে ফোর্ট আগলে না
রাখলে রণজিৎ -ভাস্কর -পার্থপ্রতিমদের আমরা পেতাম কিনা সন্দেহ আছে...। "
পরম আগ্রহে ছাপলাম সে লেখা। সত্যি বলতে কি, উৎপলের কবিতা তখনও
বিশেষ পড়িনি, পড়তে ভালো লাগত না তাই। অথচ কবিকে ভালো লেগে গেল, উৎপলদার
সঙ্গে আড্ডা দেবার প্রসঙ্গ তৈরি হয়ে গেল। এ আড্ডা ছিল কবিতা-বহির্ভূত,
উৎপলদা তো আর কখনো জানতে চান নি তাঁর লেখা কবিতা পড়েছি কিনা। ব্যক্তি
উৎপলদাকে ভালো লেগে যাওয়ায় তাঁর কবিতা পড়া শুরু করলাম, সে তো "পুরী
সিরিজ","আবার পুরী সিরিজ" বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক দশক পরে। একদিন উৎপলদার
গাড়িতে চেপে (এরকম প্রায়ই ঘটত) গড়িয়াহাট ফিরছি, নানান কথা বলে যাচ্ছেন
তিনি, হঠাৎ তুললেন আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্তি প্রসঙ্গ। বললেন, পুরস্কার নেব
কি নেব না ভাবছি, কী মনে হল, চলে গেলাম শঙ্খদার বাড়ি। তাঁকে জিগ্যেস
করলাম, আমার কি পুরস্কার নেওয়া উচিত? শঙ্খদা বললেন, নিলেই কি, আর না নিলেই
বা কি, কদিন বাদে সেসব কথা লোকে ভুলে যাবে, তুমিও ভুলে যাবে। মনখোলা
কথাবার্তা বলতেন উৎপলদা। সমকালিক পত্রিকায় পারমিতা দাশের কবিতা ছেপেছি,
পড়ে বললেন, এ মেয়েটি কে, কোথায় থাকে, ফোন নম্বরটা দিও, কথা বলব, ভালো
লিখছে। আনকোরা, আনাড়িদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, দেখে অবাক হতাম। লাইফস্টাইলে
কিংবা কথাবার্তায় কোনো পণ্ডিতি মেজাজ ছিল না বলে উৎপলদার সঙ্গে নিশ্চিন্তে
মেলামেশা করা যেত। একবার যাদবপুর বইমেলায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। যাতায়াতের
ট্যাক্সিভাড়া বাবদ ২০০ টাকা দিয়েছিলাম। উৎপলদা অটোয় এলেন, ফিরলেনও
অটোতেই। পরে একদিন দেখা হতেই বললেন, অনেক পয়সা দিয়েছিলে, অত লাগেনি, কিছু
বেঁচেছে। ও পয়সায় একদিন কফি খাওয়া যাবে। নামী লেখক কবিরা বেশিরভাগই মেপে
মেলামেশা করেন, এটাই দস্তুর, কিন্তু উৎপলদার স্বভাব ছিল এক্কেবারে উল্টো।
মানুষ তো সম্মান পায় না সমাজে, নামডাক না থাকলে কেউ গণ্য করতে চায় না --তাই
কি লিখেছিলেন, "শুধু পাথর সম্মান পান এই দেশে -- / বাকি সব নীলামে
বিকোয়"...। এ সময়ের শহুরে মেয়েদের জানতে উৎপলদার কবিতার একটা লাইনই যথেষ্ট
বলে মনে হয় : "মেয়েরা সিগারেট টানছে অনেকের সামনে।" শহর কলকাতা নিয়ে আমরা
বড়াই করতে ভালোবাসি, গর্বপ্রিয় মানুষদের হুঁশ ফেরাতেই কি লিখেছিলেন, সেই
১৯৭৮-এ, "...আঁস্তাকুড়ে পচে ওঠা সার শুধু /জমেছে শহরে।" আবেগোদ্দীপক নয়
বলে প্রথম বেলায় উৎপলের কবিতা পড়িনি, এখন পড়তে গিয়ে বুঝি, উৎপল ছিলেন
মেধাবী মনের এক বিরল কবি।
এসব যত পড়ি, নিজের ক্ষুদ্রতা উপলদ্ধি করি। সমৃদ্ধ হই
ReplyDeleteঅসাধারণ!
ReplyDeletebhutattwik o sangrahok .. oi 1jon jibon diye dekhiyechen kobir jibon lekhar moddhey kothote tophath..
ReplyDelete