ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday 22 April 2018

ইত্যু : মৌমিতা মিত্র

ছবি : Henry Asencio
ইত্যুর সংগে আমার অনেকদিনের আশনাই, যাদু কি ঝপ্পি, ঝপ্পি কি যাদু, 'ইচ্ছামৃত্যু' বড্ড মহাভারতীয়, রাজকীয় হোমরা চোমরা - নিজেকে কেমন ভীষ্মের মতো মহামতি মনে হয়। আমার মতো মতিচ্ছন্ন মেয়ে(মানুষ?) নরম নরম পালক পালক - যেটুকু ধারালো মাড়ালো দ্যাখো, জানবে গলাটা বঁটিতে কুঁচ হওয়ার আগে এবং অব্যবহিত পরে মাংসের যে উষ্ণতা, উগ্র গোলাপি গলগল, শুধু সেইটুকু, তাকে আর যাই হোক, প্রতিস্পর্ধা বলে না - বড়জোর ইত্যুর জন্য হাহা হুহু হতাশ্বাস বলা যেতে পারে।

না মিতুলদি, ওকে 'ইচ্ছামৃত্যু' বলে ডাকতে বোলো না। ওর নাম মুখে নেওয়া বারণ আমার - কতবার ওর চওড়া লোমশ কালিয়া বুকে মাথা রেখে কেঁদেছি, বলেছি- "এবার সেই বিলীয়মান কেসটা হয়ে যাক, নীলাচলে মহাপ্রভু'র মতো তোতে বেশ মিশেটিশে গেলাম। দেখিস, তখন সবাই কত কাঁদবে, মাথা চাপড়ে বুক চাপড়ে,  ঘোমটা পরে, ঘোমটা খুলে, পুংকেশররা বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কল খুলে দেবে, ছড়ছড় করে চোখ আর পুংলিংগে কাঁদবে। কেউ ছাদে গিয়ে দু:খ ফুঁকে আর একটু বাতাস দুষিত করবে। সবাই বুঝে যাবে সব, কাঁচাসর্দির মতো গলগল করে বেরিয়ে আসবে আমার প্রতি সকলের টান, অনুতাপ, অপরাধবোধ, থরথর  থরহরি, হরিহর, বল হরি হরিবোল, বল হরি হরি বোল, কেউ গান শিখুক না শিখুক রে ইত্যু, এই সুরটা কেউ কখনো ভুল করে না। আমি সুরে সুরে সুর মেলাতে মেলাতে কাঁধে কাঁধে এলাটিং বেলাটিং করতে করতে সাঁঝবেলায় ঢলে যেতে চাই রে ইত্যু, ও ইত্যু আমার, আমার মুখখানা দ্যাখ, দেখেছিস? সরস্বতী পুজোর কত চাঁদ মালা থেকে খসে ধুতি পাঞ্জাবি পরে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের তিরতির হাত অঞ্জলি দিয়েছে, অধীর চোখ জ্যোৎস্না দিয়ে গেছে আমাকে, একবার চোখ তুলে চোখ নামিয়ে নেবার সাহস হয় নি কারও আর তুই আমাকে...একটু 'ইসে' দিলি না, আমার সকল নিয়ে সকল খুলে বসে আছি তা-ও তুই নিবি না আমায়। আমার এহেন আত্যন্তিক গেছোসোনাল বৃত্তির পরও শালা খ্যাঁকখেঁকিয়ে হাসে, শালাতম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কপালে একটা টিপচুমু খায় অথচ ঠোঁটের দিকে যেতে গেলেই হাসি দিয়ে ব্লক করে, এমন আনফ্রেন্ড ইত্যু আমার - শালা মম, বলে 'কারোর কিস্যু যাবে না আসবে না ছিঁড়বে না ফাটবে না রে শালি(ইত্যু আমায় এই নামেই ডাকে), কেবল তোরই পরের ভোরটা দেখা হবে না। বাকিরা সবাই দেখবে, কেমন করে ছেনাল আকাশ রাতারাতি চাঁদ থেকে সূর্য খসম বদল করে, সবাই দাঁত মাজবে, বাথরুম যাবে, পটি করবে, তোর জন্য আড়াই দিনের বেশি কোনো কমোড কাঁদবে না, যে হ্যান্ড শাওয়ারে তুই ছুঁচু করতিস - সে শুধু কুমীরের মতো ফিচকি ফিচকি কাঁদবে - আর কেউ না, বিশেষ করে যারা তোকে পোড়াতে গিয়ে সারারাত জেগেছে আর মোবাইলে ঘনঘন ঘড়ি ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ দেখেছে, একটার পর একটা আদিরসাত্মক জোকস পড়ে হেসে ফেলতে গিয়েও টপ করে গিলে ফেলেছে আর ভি. আই. ফ্রেঞ্চি ঘামিয়ে টানটান করে ফেলছে, তার...তার...তারওপর...তাদের দাঁড়িয়ে থাকারা এক এক করে ঢুলতে ঢুলতে অবাঞ্ছিত মেসেজ,  ভিডিয়ো, অ্যানিমেশন ডিলিট করতে করতে হাই চেপে বা তুলে হিসেব করতে বসেছে, আগে আরও দুটো, তারপর পুড়তে চল্লিশ মিনিট, ছাই ফেলতে ভাঙা নর্দমা অর্থাৎ গঙ্গার কাজ সারতে আরও কিছুক্ষণ - তারা  বাড়িতে ফিরেই রক্তজবা চোখে দাঁতে লোহাসন্দেশ কেটেই দু'মগ উপুড় করে বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়েছে যেন আর কোনোদিন উঠবে না কিন্তু উঠবে। তারা সবাই উঠবে, শুধু তুই উঠবি না রে শালি, তোর নাইটা শেয়ালে খাবে, তোর ছাই সমুদ্রে যাবে, তোর চকচকে ছবি ঝাপসা হবে, ধুসর হবে, দুর্বোধ্য থেকে অবোধ্য হবে, তারপর একটা জং ধরা পেরেক হয়ে অযাচিত গেঁথে থাকবি কালের দেয়ালে। তারপর একদিন দেখবি, যাদের মজা দেখাবি ভেবেছিলি, তারা সবাই ব্যাপারটাকে মজা হিসেবেই নিয়েছে আর উল বুনতে শুরু করেছে আর অফিসের নেক্সট প্রোজেক্টটা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে, যারা ঝিনুকে করে দুধ খেত তারা হরলিক্স কমপ্ল্যান পিডিয়াশিয়োর থেকে বিয়ার হুইস্কির পথে বহুদিন...শালি রে, হয়তো ওই হুইস্কিতেই তুই একটু, হ্যাং ওভারে পৌনেমতো, মাঝরাতের বিনিদ্র আধশোয়ায় সোয়াটাক, সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা চাঁদে সিকিটুকু, ডায়রির দোক্তায় লালছোপ, কোনো বিয়েবাড়ি বা অন্নপ্রাশনের এক দুজোড়া ছলোছলো চোখের 'আজ যদি...'তে,  রবিবারের মাংসভাত দুপুরের পর পুরনো হার্ড ডিস্কে পুরী বা নৈনিতালে তোর হঠাৎ ঝিলিকজনিত বুকের মোচড়ে, আর একছটাক অভিমানী প্রশ্নে - কেন? কেন? এতটা বাড়াবাড়ির কি দরকার ছিল? এতটা বাড়াবাড়িরই যে দরকার ছিল, আসলে এটা যে বাড়াবাড়ি নয়, থমথমের পর কালবৈশাখীর মতোই অনিবার্য আর নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল সেই মুহুর্তে তোর রুদ্রবৈশাখি সত্ত্বার কাছে, কেউ বুঝবে না রে শালি, কেউ বুঝবে না, বরং যত সময় যাবে, লোকে ঘটনাটার ভাবসম্প্রসারণকে সময় নষ্ট করা ভেবে স্রেফ 'দুর্ঘটনা' বলে প্রেসি করে দেবে। খবরের কাগজের একটা ধুসর কাটিং হয়ে আলমারির লকারে রাখা থাকবি তুই, কেউ কোনোদিন খুলে দেখার সাহস করবে না। কাশেমের মতো পাসওয়ার্ড ভুলে কাতরাতে কাতরাতে নিথর হয়ে যাবি, কোন আলিবাবা তোকে উদ্ধার করবে না আর শেয়ারের কাগজ, ব্যাংক, ইনশিয়োরেন্সের কাগজের যত ঐশ্বর্য, তার সংগে রাই হয়ে জুড়ে থাকবি, যেমন শ্যামের সংগে রাই, জুড়ে তবু দূরে দূরে...

এসব শুনলে কার মাথার ঠিক থাকে বলতো মিতুল দি, (কিছু মনে করিস না, তোকে তুই বললাম বলে, আসলে ইত্যুর ভাল নাম আর মিতুল দুটোতেই 'ম' আর 'ত' আছে তো; খানিকটা মওত আছে তো।), থাবড়াতে ইচ্ছে করে না বল? খুব খানিকটা থাবড়ে চাবকে, আঁশবঁটি দিয়ে ফালা ফালা করে এবং হতে হতে গলা ফাটিয়ে বলি, "আর যদি কোনওদিনও তোকে ত্রিসীমানায় দেখি..."

তবু রাত আসে। রাতের পেটে মাঝরাত আসে। মাঝরাতের বুকে শেষরাত আসে। নির্ঘুম আসে, নিষ্পলক চোখে নির্জলা আসে। চোখের পাতা ভারি...ও ভারী হয়ে ওঠে, তখন, ঠিক তখনই একটা চওড়া কালিয়া লোমশ বুকের ভার টের পাই এই জ্বালাপোড়াতীত বার্নল সত্ত্বায়। চোখ বন্ধ করেই বলি, 'ইত্যু, সেই কেসটা এবার হয়ে যাক, মিশন বিলীয়মান।" ইত্যু আমার বন্ধ চোখের পাতায় আঙুল বোলাতে বোলাতে বলে, "শোন রে শালি, ইত্যু তো তোর রইলই, যখন খুশি, যেখানে খুশি, যেমন খুশি কিন্তু 'ইজী' কে উপেক্ষা করা অত ইজি নয়, যতটা তুই ভাবছিস। একবার চোখ খুলে পর্দা সরিয়ে দ্যাখ।"
সরালাম।
সরে গেল।
ইত্যু।

পূবালী কচিকুঁচি আলো আমার ছোটনাগকপালপুরে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে মসৃণ করে দিল। তারপর আমার মুখের খুব কাছে মুখ আর হাসি নিয়ে এসে, চোখে চোখ রেখে বলল, "টেক ইট, ইজী"।

3 comments:

  1. বাহহহ! লেখাটির মধ্যে সৌন্দর্য এক অন্যমাত্রা পেয়েছে। ভালোবাসা এবং মৃত্যু ফ্যাণ্টাসির সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই দুই তেজস্ক্রিয়তা যেন অমলিন দুইচোখ। তাই এমন ক্যাজুয়াল ইতি দীর্ঘ এক রিনিঝিনি রেখে যায়

    ReplyDelete
  2. Obviously nothing like i have read so far. Absolutely a new flavour. Despondent but delightful.

    ReplyDelete
  3. এ মৃৃৃত্যুর অন্য দর্শন ৷ কর্ষণের মাত্রা গাঢ় থেকে ক্ষত-য় নামলে এমন লেখা প্রস্তুত করা যায়....হ্যাাটস অফ্ দিদিভাই....

    ReplyDelete