ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday 22 April 2018

মৃত্যু এবং পুরুষোত্তম : তপন কুমার পাল

জাতস্য হি ধ্রুবঃ মৃত্যুঃ

যে জন্মায় তার মৃত্যু নিশ্চিত। মৃত্যু নানা প্রকার। ১/ স্বাভাবিক ২/ অপমৃত্যু ৩/ আত্মহত্যা ৪/ স্বেচ্ছা মৃত্যু ৫/ ইচ্ছামৃত্যু। আত্মাহুতি, আত্মমদত ইত্যাদি সবগুলিই প্রকৃতিগত ভাবে আলাদা।

বিভিন্ন কারণে মানুষ প্রকৃতির নিয়মে আসা মৃত্যুর আগে জীবনের সাথে বন্ধন ছিন্ন করতে চায়, যেটি আত্মহত্যা নামে পরিচিত। যখন চাওয়া-পাওয়ার মেলবন্ধনে অসামঞ্জস্য আসে, বিচলিত মন তার গতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, তখনই কোন মানুষ আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়। এই মৃত্যু কোনোদিন কোনোভাবেই সামাজিক বা আইনগত ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য নয়। যতদিন নিজের চাহিদা আর প্রাপ্তির মধ্যে দূরত্ব ছিল না ততদিন তাদের জীবনের প্রতি কোনো অভিযোগ বা বিতৃষ্ণা ছিল না। জীবন ছিল স্বপনের মতো প্রিয়।

অথচ আত্মকেন্দ্রিক মনের দাবী পূরণ না হওয়ায় নিজের চারপাশের প্রিয় মানুষ যাদের সুস্থ জীবনকে প্রভাবিত বা বিধ্বস্ত করতে পারে তাদের কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতো নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব বা উদারতা নেই। থাকতে পারে না। চারপাশের বিষাদগ্রস্ত মানুষদেরও প্রভাবিত করে অন্যের আত্মহত্যা। সমাজজীবন বা মানবজীবন নিয়ে চিন্তাশীল মানুষদেরও অস্থির করে তোলে অন্যের আত্মহত্যা।

দীর্ঘ রোগভোগ বা জাগতিক মায়ার প্রতি মন নির্লিপ্ত হলে বা নিজস্ব যাবতীয় দায়িত্ব সমাধানের পর মৃত্যু ইচ্ছা আসে কারও কারও মনে। সেক্ষেত্রে তার ইষ্টের কাছে মৃত্যু প্রার্থনা করে সেই ব্যক্তি। যা ইচ্ছামৃত্যু নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দেহ মন আত্মায় সে ব্যক্তি মৃত্যুকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে। প্রচলিত মতবাদ, এই সময়ে ঈশ্বর তার প্রতিকূলতার প্রতিকার সম্ভব না হলে তার মৃত্যু ইচ্ছা পূরণ করে থাকেন। স্বেচ্ছামৃত্যু - হিন্দুধর্মে স্বেচ্ছামৃত্যু স্বীকৃত। কোনো ব্যক্তি যখন মৃত্যুভয় অতিক্রম করে, কখনও বা অন্য জীবনের আকাঙ্ক্ষা থেকে মৃত্যুকে আবাহন করে, সেক্ষেত্রে প্রচলিত মতবাদ অনুসারে সেই ব্যক্তি জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধান অতিক্রম করে যোগবলে সমস্ত ইন্দ্রিয় ইচ্ছাকে নিরুদ্ধ করে ভ্রুযুগলের মধ্যে প্রাণকে স্থাপন করে শরীর ত্যাগ করে, তাকেই স্বেচ্ছামৃত্যু বলে।

ননাবিধ প্রাণত্যাগের মধ্যে সহজতর পদ্ধতি আত্মহত্যা। কিন্তু কোনো ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ সাধারণত এইভাবে মৃত্যু গ্রহণের কথা চিন্তা করেন না। কারণ শাস্ত্রমতে তারা জেনে থাকেন ভোগের জন্যই জীবন। জোর করে তার ছেদ ঘটানো উচিত নয় বা সম্ভব নয়। যদি সক্রিয়ভাবে কেউ এজাতীয় চেষ্টা করে তা ধর্মমতে, সমাজের নিয়মে বা আইনগত ভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।

অন্যায়ভাবে কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত হওয়া বা অহেতুক দূর্ব্যবহার ইত্যাদি যে সব কারণ দুর্বল মনের মানুষের মনে আত্মহত্যার চিন্তা নিয়ে আসে, সেসব কারণের সম্মুখীন হলে তাদের এই সত্যকে মেনে নিতে হবে যে, জগতের সবকিছু পাবার জন্য নয়, সমস্ত কামনা বাসনা পূর্ণ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে পুরনো ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে সম্পর্ক বা আশা নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করার কথা মনকে বোঝাতে হবে।

যেভাবে গাছের পাতা জন্মায় সেভাবেই নির্দিষ্ট নিয়মে পূর্বনির্ধারিত সময়ে তা ঝরে পড়ে। সেভাবেই সময়ের আগে ভোগের এবং জীবনের ছেদ ঘটানো অনুচিত ও অসম্ভব।

আত্মাহুতি : পুরাকালে ক্ষত্রিয়, বিশেষত রাজপুত জনজাতির মধ্যে সম্মান রক্ষার্থে যে জহরব্রত পালনের মধ্যে দিয়ে প্রাণত্যাগের চল ছিল তা কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যু বা আত্মহত্যা কোনোটির মধ্যেই পড়ে না। এক্ষেত্রে তারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণে বাধ্য হত।

আত্মঘাতী : নিজেকে হত্যার মধ্য দিয়ে আরও কয়েকজনকে হত্যা করে যারা, তারা আত্মঘাতী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

মন্দিরে উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে কাঁসরঘন্টার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় ক্ষর(দেহ), অক্ষর(আত্মা) এবং পুরুষোত্তমের বার্তা।
"অজ নিত্যঃ শাশ্বত অহং পুরানো,
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।"

আত্মা অজ, নিত্য, শাশ্বত ও চির পুরাতন। দেহ হত হইলেও আত্মা হত হয় না।

No comments:

Post a Comment