“অভিমানে মানুষ কিংবা মানুষের মতো আর যা-কিছুর
বুক চিরে দেখা
আত্মহনন…”
আত্মহননের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ শুরু সুনীল গাঙ্গুলী পড়তে গিয়ে। সেই সাক্ষাতে তুলি ছিটোনো লাল ছোপ যদিও বা থেকে থাকে, সে লাল যুবা বয়েসের রঙ। সেখানে কালো রঙের ঠাঁই নেই। নেই, তার কারণ নিশ্চয়ই এ কবিতার উচ্চারণে ফুটে ওঠা এক যৌবন ছবি। যার চলনে জেগে ওঠে - মৃত্যু নয়, বরং “শহরের পিঠ তোলপাড় করা অহংকারের দ্রুত পদপাত, একখানা নদী, দু’তিনটে দেশ, কয়েকটি নারী” — আত্মহনন এখানে জীবনেরই অন্যপিঠ, উচ্ছ্বল ও রোমান্টিক। আর, অন্যপিঠে আছে লাশকাটা ঘর। পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে গেলে সেই ঘরের টেবিলে চিত হয়ে শুয়ে থাকার সাধ হয় কারও। যদিও মশা। যদিও তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থাকা। যদিও মাছি। রক্তক্লেদ ছেড়ে রোদে উড়ে যাওয়া জীবন। তবুও জীবনানন্দীয় জীবন একগাছা দড়ি হাতে অশ্বত্থের দিকে হেঁটে যায় কেন বার বার? উত্তর নেই।
শুধু...
"নিঝুম দৈত্যের মতো রাত্রি নেমে এলে তুমি
লাফ দিয়ে পড়লে নীচে, হাইওয়ের মর্মমূলে
শূন্যতার সমাধির দেশে” (মিতুল দত্ত)
আত্মহনন, নাকি ইচ্ছামৃত্যু? কাকে ধরব বুঝে উঠতে পারিনা। কতখানি তফাত এ দুটি শব্দে? ইচ্ছামৃত্যু যদি হয় mercy killing, আত্মহনন যদি suicide, এই দুই মৃত্যুর মধ্যেই নিহিত আছে জীবন-বিযুক্ত হবার ইচ্ছে। এই ইচ্ছে জীবনের সমস্ত বায়োলজিক্যাল যুক্তির বিপরীত! মানুষ ছাড়া জীবনের আর কোনো ফর্ম আত্মহননের রাস্তায় হাঁটে কি? রহস্যময় যদিও জাটিঙ্গা গ্রামের পাখিদের অকালমৃত্যু। ঝাঁক ঝাঁক জাটিঙ্গা পাখির মৃত্যুবরণকে আত্মহননের চশমা দিয়ে দেখেছে মানুষ অনেককাল। কিন্তু পক্ষীবিদরা বলেন, এ মৃত্যু তাদের স্বেচ্ছামৃত্যু নয়, বরং এর কারণ এক নির্মম পথভ্রান্তি। মানুষই কি তবে একক, একমাত্র স্পিসিস এই জীব-বিশ্বে, যে বার বার জীবনের স্বাভাবিক যুক্তির বিরুদ্ধে হেঁটেছে? কেন? জীবন যখন আর আনন্দ নয়, শুধুই ভার ও যন্ত্রণা, সেই যন্ত্রণা যখন বহনসীমা পেরিয়ে যাচ্ছে কোনও মানুষের কাছে, যখন তার জীবনের মানে আর লজিক মিলিয়ে যাচ্ছে মহাশূন্যের মধ্যে, তখন হনন-ইচ্ছের উপান্তে এসে দাঁড়ায় সে। ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই ইচ্ছে হয়ত সাহায্য চায় অপর জীবনের কাছে, স্বীকৃতির কাছে, কিন্তু আত্মহননের রূপায়ণ নিজেরই হাতে। তার অপরের স্বীকৃতির অপেক্ষা নেই, প্রয়োজনও নেই। এ এক এমনই হননকাল, যার মধ্যে জীবনের যুক্তি ও কালপর্বের শেষ।
তাই হননকাল আসে জীবনে। আর জীবন থেকে কবিতায়, সিনেমায় কেবলই তার ছায়া ফেলে যায়।
বুক চিরে দেখা
আত্মহনন…”
আত্মহননের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ শুরু সুনীল গাঙ্গুলী পড়তে গিয়ে। সেই সাক্ষাতে তুলি ছিটোনো লাল ছোপ যদিও বা থেকে থাকে, সে লাল যুবা বয়েসের রঙ। সেখানে কালো রঙের ঠাঁই নেই। নেই, তার কারণ নিশ্চয়ই এ কবিতার উচ্চারণে ফুটে ওঠা এক যৌবন ছবি। যার চলনে জেগে ওঠে - মৃত্যু নয়, বরং “শহরের পিঠ তোলপাড় করা অহংকারের দ্রুত পদপাত, একখানা নদী, দু’তিনটে দেশ, কয়েকটি নারী” — আত্মহনন এখানে জীবনেরই অন্যপিঠ, উচ্ছ্বল ও রোমান্টিক। আর, অন্যপিঠে আছে লাশকাটা ঘর। পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে গেলে সেই ঘরের টেবিলে চিত হয়ে শুয়ে থাকার সাধ হয় কারও। যদিও মশা। যদিও তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থাকা। যদিও মাছি। রক্তক্লেদ ছেড়ে রোদে উড়ে যাওয়া জীবন। তবুও জীবনানন্দীয় জীবন একগাছা দড়ি হাতে অশ্বত্থের দিকে হেঁটে যায় কেন বার বার? উত্তর নেই।
শুধু...
"নিঝুম দৈত্যের মতো রাত্রি নেমে এলে তুমি
লাফ দিয়ে পড়লে নীচে, হাইওয়ের মর্মমূলে
শূন্যতার সমাধির দেশে” (মিতুল দত্ত)
আত্মহনন, নাকি ইচ্ছামৃত্যু? কাকে ধরব বুঝে উঠতে পারিনা। কতখানি তফাত এ দুটি শব্দে? ইচ্ছামৃত্যু যদি হয় mercy killing, আত্মহনন যদি suicide, এই দুই মৃত্যুর মধ্যেই নিহিত আছে জীবন-বিযুক্ত হবার ইচ্ছে। এই ইচ্ছে জীবনের সমস্ত বায়োলজিক্যাল যুক্তির বিপরীত! মানুষ ছাড়া জীবনের আর কোনো ফর্ম আত্মহননের রাস্তায় হাঁটে কি? রহস্যময় যদিও জাটিঙ্গা গ্রামের পাখিদের অকালমৃত্যু। ঝাঁক ঝাঁক জাটিঙ্গা পাখির মৃত্যুবরণকে আত্মহননের চশমা দিয়ে দেখেছে মানুষ অনেককাল। কিন্তু পক্ষীবিদরা বলেন, এ মৃত্যু তাদের স্বেচ্ছামৃত্যু নয়, বরং এর কারণ এক নির্মম পথভ্রান্তি। মানুষই কি তবে একক, একমাত্র স্পিসিস এই জীব-বিশ্বে, যে বার বার জীবনের স্বাভাবিক যুক্তির বিরুদ্ধে হেঁটেছে? কেন? জীবন যখন আর আনন্দ নয়, শুধুই ভার ও যন্ত্রণা, সেই যন্ত্রণা যখন বহনসীমা পেরিয়ে যাচ্ছে কোনও মানুষের কাছে, যখন তার জীবনের মানে আর লজিক মিলিয়ে যাচ্ছে মহাশূন্যের মধ্যে, তখন হনন-ইচ্ছের উপান্তে এসে দাঁড়ায় সে। ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই ইচ্ছে হয়ত সাহায্য চায় অপর জীবনের কাছে, স্বীকৃতির কাছে, কিন্তু আত্মহননের রূপায়ণ নিজেরই হাতে। তার অপরের স্বীকৃতির অপেক্ষা নেই, প্রয়োজনও নেই। এ এক এমনই হননকাল, যার মধ্যে জীবনের যুক্তি ও কালপর্বের শেষ।
তাই হননকাল আসে জীবনে। আর জীবন থেকে কবিতায়, সিনেমায় কেবলই তার ছায়া ফেলে যায়।
দিদিকে দিয়ে শুরু করে সারি সারি অকালমৃত্যু সহ্য করেছে অপু। সেই সহনীয়তা তার টুকরো হয়ে ভেঙে গেল অপর্ণার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে। মুরারি, অপর্ণার ভাই, মুখ কালো করে দাঁড়িয়েছিল দরজার পাশে। খুলনায় স্ত্রী অপর্ণাকে ছেড়ে আসার পর অপুর প্রতিটা দিন কেটে গেছে অপর্ণার সান্নিধ্যেই, তার কাঁচা হাতে লেখা চিঠির ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোরের মধ্যে সহসা ছেদ টেনে মুরারি যখন বয়ে আনল অপর্ণার মৃত্যুসংবাদ, অপু নিতে পারেনি। আঘাত ফিরিয়ে দিয়েছে মুরারিকে মুষ্ট্যাঘাত করে। তার পর শূন্যতা। শুধু অন্ধকারে জেগে থাকা অপুর আয়ত চোখ আর ঘড়ির টিক টিক। এই টিক টিক শব্দ বিরাট হয়ে পৃথিবীর সমস্ত শব্দকে ঢেকে ফেলে ক্রমশ, আর অপুর মন পর্দা থেকে ঠিকরে এসে আমাদের সকলের মন হয়ে ওঠে ঐ শব্দ–ছবি দিয়ে। এর পর, হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় সেই টিক টিক। নিকষ অন্ধকার আর নিরেট শব্দশূন্যতা। পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে, পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন। আবার ট্রেনের কাছে গেল অপু। বাল্যকালে দিদির সঙ্গে নিশ্চিন্তিপুরের যে প্রথম ট্রেন দর্শন অপুকে বিরাট পৃথিবীর দিকে ঠেলে দিয়েছিল, সেই ট্রেনের কাছে অপু গেল আবার। কেন? জীবনের ডাকে নয়, জীবনের ইতি টেনে দিতে। ঘড়ির থেমে যাওয়া শব্দ মুছে গেল ট্রেনের ঘর্ঘর শব্দে। না, আর ট্রেন দেখিনা। অপুকেও না। ক্যামেরা উঠে গেল আকাশে, শূন্য আকাশে! একটি শুকরের আর্তনাদ ভেসে এল।
অপু আত্মহননের ইভেন্ট হরাইজন ছুঁয়ে ফিরে এসেছিল। ব্ল্যাকহোলে ঝাঁপ দেওয়া বাকি ছিল শুধু। কিন্তু অপুর এই যাত্রার মধ্যে সত্যজিৎ আত্মহননের যে তীব্র ছবি এঁকে দিয়েছিলেন, তা আর কোনো ছবিতে দ্বিতীয়বার করেননি তিনি। না, জলসাঘরে বিশ্বম্ভরের মৃত্যুর মধ্যেও না।
অপু হননকালের রাস্তায় হেঁটে ফিরে এসেছিল জীবনের কাছে আবার। কিন্তু মৃণাল সেনের মালতী আর ফিরে আসেনি। আশ্চর্য সমাপতন মনে হয় যখন ভাবি, মৃণাল বাইশে শ্রাবণ নির্মাণ করেন প্রায় অপুর সংসারের নির্মাণকালের মধ্যেই। অপুর সংসার রিলিজ করে ১৯৫৯ সালে, আর বাইশে শ্রাবণ ১৯৬০। দুটি ছবিতেই আত্মহননের চিত্র পাই! অপু ও অপর্ণার মতো, প্রিয়নাথ ও মালতীও সুখ-সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল। আর্থিক অনটন, অনাহার দুটি ছবিতেই তার কালো ছায়া নিয়ে হাজির। কিন্তু তবু, স্পিরিটে এই দুটি ছবির রাস্তা ভিন্ন। বাইশে শ্রাবণে প্রিয়নাথের সংসার আরও বেশি ডার্ক, কঠিন, লড়াই ও তার বিশ্লেষণ চিহ্নে বিশদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সদ্য পূর্বের সময়কালে, ডিপ্রেশনের করাল গ্রাস আর তার মধ্যে প্রিয়নাথের বেঁচে থাকার প্রয়াস যখন ব্যর্থ হতে হতে তলানিতে ঠেকে, সে ক্রমশ স্বার্থপর হয়ে ওঠে। এক জান্তব ক্ষুধায় আক্রান্ত হতে হতে, প্রিয়নাথ ক্রমশ ভুলে যায় তার স্ত্রীর কথা। খেয়াল রাখেনা, তার স্ত্রীরও খাদ্যের প্রয়োজন ছিল! বাইশে শ্রাবণ ছবিটি আমাদের কাছে প্রিয়নাথের এই ক্রমিক ইভল্যুশনের এক দারুণ নিষ্ঠুর ছবি, যা পরতে পরতে খোলে। মালতী হতদারিদ্র্য সহ্য করেছে, কিন্তু মেনে নিতে পারেনি প্রিয়নাথের স্বার্থপর হয়ে ওঠা। বাইশে শ্রাবণ ছবিটির শেষে মালতীর আত্মহননের তির্যক আর করুণ ছবি আসে। তির্যক, কারণ এখানে মালতীকে দেখিনা একটিবারের জন্যেও। মালতীর আত্মহননকে দেখি প্রিয়নাথের মধ্যে দিয়ে, তার চোখ দিয়ে। মালতীর সাড়া না পেয়ে, প্রিয়নাথ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে, বিস্ফারিত চোখে তাকায় সিলিং-এর দিকে। পর্দার এপাশে আমরা শুধু দেখি, ঘরের ছাদ থেকে ঝোলা একটি ছাতার বাঁটের অবিরাম দুলে যাওয়াটুকু আর তার ঘর্ষণ শব্দ। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দোলে সেটি। সময় বয়ে যায়, হননকাল আসে, তার ইঙ্গিতময় করুণ নিষ্ঠুর ছবি দোলে, দুলতেই থাকে।
রায় ও সেন এর পরে, আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৬৫ অবধি। সুবর্ণরেখা ছবির অন্তিমে ঋত্বিক ঘটক বোধ করি বাংলা ছবির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর, কঠিন আর সবথেকে বেশি গ্রাফিকাল আত্মহনন চিত্রের মুখোমুখি দাঁড় করান আমাদের। সীতা আর অভিরাম, সীতার দাদা ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। ঈশ্বর চাননি এই বিয়ে কারণ, অভিরাম বাগদি সন্তান, নীচু জাত! সীতা ব্রাহ্মণ কন্যা। ঈশ্বরের এই জাতগর্ব আইরনি মনে হয়, যখন ভাবি পার্টিশন পরবর্তী সময়কালে তার আর সীতার প্রায় রিফুজি হয়ে পুব বাংলা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়াটুকু। অপু-অপর্ণা, প্রিয়নাথ-মালতীর মতো, অভিরাম আর সীতার সংসারও সুখময় বা স্থায়ী হয়নি। ভেঙে গেছে কঠিন সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে। সুবর্ণরেখার বাস্তবতা আরও নগ্ন। অভি আর সীতার জীবন, বস্তির প্রান্তিক জীবন। তবু তার মধ্যেই তাদের স্বপ্নও ছিল। সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল, যখন অভিরাম বাস ড্রাইভারের চাকরি নিয়ে একদিন মবড হল, এক অনিচ্ছাকৃত অ্যাক্সিডেন্টের জন্যে যখন তাকে প্রাণ দিতে হল জনগণের হাতে। না, সীতা তবু বাঁচতে চেয়েছিল। যৌনকর্মীর জীবিকা একমাত্র পাথেয় হলেও সে বাঁচতে ছেয়েছিল তার সন্তানের জন্যে। কিন্তু না, সীতা সব মেনে নিতে পেরেও, নিতে পারেনি সেই মুহূর্তকাল, যখন তার যৌন পেশার প্রথম খদ্দের হিসেবে সে ঈশ্বরকে আবিষ্কার করল! এত বছর পর, সমাপতন আর আইরনির মতো, ঈশ্বর এসেছিল সীতার কাছে আবার, তার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বোনের কাছে! কীভাবে?
দরজা খোলে, তার আওয়াজ আসে আর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়া এক চিলতে আলোর সঙ্গে সঙ্গে সীতার অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়েন ঈশ্বর! বাইরের আলো ছেড়ে ঘরের অন্ধকারে এসে ঈশ্বরের চোখে ধরা পড়েনা সীতা। ক্যামেরায় ছেয়ে থাকে তার নেশাগ্রস্ত ঝাপসা দৃষ্টি। কিন্তু সীতার চিনতে দেরি হয়না দাদাকে! নেপথ্যে বেজে যাচ্ছে ওয়েস্টার্ন। বাহাদুর খানের সরোদ নয়, তার মেলোড্রামাটিক সিম্ফনি। সেই শব্দ ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে সীতার নিশ্বাসের শব্দে। পর্দা জুড়ে সীতার বাঁদিকের বিস্ফারিত চোখের বিগ ক্লোজ আপ। অন্ধকারে জ্বলে ওঠা সেই চোখ। তার হাতে উঠে আসে বঁটি। এর পর সীতা নয়, ঈশ্বরকে দেখি। দেখি তার চোখের বদল। তার পাঞ্জাবীতে এসে লাগে রক্তের ছিটে। শুনি, মুরগি কাটার মতো ধড়ফড় শব্দ। দেখি, খাটের তানপুরা আর তবলার দুলে দুলে ওঠা। শব্দ শেষ। ক্যামেরা প্যান করে এগিয়ে যায় সীতার হাত থেকে তার মৃত, স্থির চোখের উপরে।
বাংলা তথা ভারতীয় ছবির তিন শক্তিমান আদিপুরুষ ও দিকপালের হাতে আত্মহননের চলচ্চিত্রায়ণ যেন এক পরিক্রমা সেরে ফেলে এভাবেই।
ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র মনি কাউল, যার ছবি সম্পূর্ণ ভিন্ন আর একক পরাবাস্তব রাস্তায় হেঁটেছিল, ১৯৯১ সালে একটি ছবি করেন। ছবিটির নাম নজর। এ ছবির শুরুতে আর ভরবিন্দুতে আছে এক ষোড়শী স্ত্রীর আত্মহনন।
আরও অনেক বিশিষ্ট ভারতীয় ছবির নাম যোগ করা যাবে, যেখানে আত্মহননের চিত্ররূপ উঠে এসেছে বিবিধ মাত্রায়। হালফিলের ‘মাসান’ ছবির শুরুতে একটি নির্মম আত্মহননের চিত্র আছে। পুলিশি অত্যাচার আর নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে পীযুষ নামক একটি যুবককে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে দেখা যায় বাথরুমে। মনে পড়বে ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির ডিপ্রেসড ছাত্রটির আত্মহত্যার কথাও। ভারতের বাইরে, প্রবল ডিস্টার্বিং আত্মহনন দেখেছি, ‘The hour’ আর ‘The Piano Teacher’ ছবিতে। নিকোল কিডমান, The Hour ছবির অসামান্য ভার্জিনিয়া উলফ। এ ছবির শুরু ভার্জিনিয়ার আত্মহনন দিয়ে। মুখের সমস্ত কথা হারিয়ে যায় মিশেল হানেকে’র The Piano Teacher ছবির শেষ দৃশ্যে এসে। পিয়ানো শিক্ষক এরিকা, কন্সার্ট হলের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের কাঁধের একটু নীচে ছুরি চালিয়ে দেন। তারপর বেরিয়ে চলে চান অবিচল চিত্তে, কন্সার্ট হল থেকে বাইরে, খোলা রাস্তায়। ক্যামেরা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি তাহার পাশে দাঁড়াও। কেন কাঁদছে মানুষ? কেন ২৮শে মার্চের কাকভোরে বরফশীতল জলের অন্ধকারে চলে যেতে হয় একজন প্রতিভাবান ভার্জিনিয়াকে? কেন তাকে লিখতে হয় নীচের সেই মর্মান্তিক শেষ চিঠি স্বামী লেনার্ডকে?
“Dearest,
I feel certain I am going mad again. I feel we can’t go through another of those terrible times. And I shan’t recover this time. I begin to hear voices, and I can’t concentrate. So I am doing what seems the best thing to do.”
কান্না ও শূন্যবোধ অতলান্ত স্পর্শ করলে মানুষ বার বার যায় ইচ্ছামৃত্যুর দুয়ারে, লেখা হয় -
“মাঝরাতে তুমি ছুটে গিয়েছ নিজের কাছে
খুন করতে নিজেকে।
শুধু একজন মানুষ, আজ সমস্ত রাত, খোলা
ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে” (ভাস্কর চক্রবর্তী)
রাত কত? উত্তর মেলেনা। শুধু আত্মহত্যারা আর ইচ্ছামৃত্যুরা যাওয়া আসা করে জীবনে। জীবন থেকে শিল্পে, কবিতা থেকে সিনেমায় তার অন্তহীন প্রক্ষেপ।
নির্বাক! এ এক অন্তহীন বিষাদ !
ReplyDeleteOnekkhon chup kore boshe achhi. Protyekti chhobibe dekhechi.. poetic and sad . Opurbo lekha . Shadhubad janai .
ReplyDelete