২
তবে লাভনি পড়ে বোঝার জিনিস নয়। একে মঞ্চে দেখতে হয়, এর
প্রতিটা শব্দের সঙ্গে কাছা দেওয়া পৈঠানী ন-হাতি কী বারো-হাতি শাড়ি পড়া নাচনির স্তন
কোমর চোখ পা ও হাতের যে ভঙ্গী, দ্রুত তালের ঢোলকের আর ধাতব ঘুঙুরের আওয়াজের সঙ্গে মিলেমিশে
মুহূর্তে মুহূর্তে নানা রঙ বদলায় ঢং বদলায় তাকে বোঝানো খুব দুষ্কর যেমন দুরূহ এর গানের
আত্মাকে বা দ্বিতীয় বিশেষণগুলোকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা।
সামাজিক পুলিশের আঙুল তোলা, আর্থিক সঙ্কট, আধুনিক সমাজের
মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, তারওপরে নারীবাদীদের কটাক্ষ, তামাশাও লাভনি নাচের শিল্পীদের অস্তিত্বকে
প্রশ্নচিহ্নের কাছে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। লাভনি নিয়ে তত্ত্ব ও তথ্য তালাশ করার আগে তাই
জগত দেবনাথ বাবুর বলা একটা গপ্প শোনাই।
১৯৯৮ সালের কথা। মুম্বাই শহরে বসেছে লাভনি উৎসব। এটা প্রতি
বছর এক একটা শহরে বসে। নানা প্রান্ত থেকে লাভনি দলগুলো আসে। তারা তাদের ক্ষমতা ও সামর্থ্য
অনুযায়ী অনুষ্ঠান পেশ করে। দর্শক ও বিচারকের রায়ে শ্রেষ্ঠ নাচিয়ে গাইয়ে নির্বাচিত হয়।
সুরেখা পুনেকরের নাম লাওনি জগতের অনুরাগীরা সে বছরই প্রথম শুনেছিল। পুনে শহরের স্বরগেট
অঞ্চলের লক্ষণ নগরে এক অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম হয় সুরেখা বাঈ-এর। সুরেখার বাবা ছিলেন
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। মা-ও কিছু কাজকর্ম করতেন। গানবাজনার তেমন পারিবারিক ঐতিহ্য
না থাকলেও সুরেখার বাবার কিন্তু সখ ছিল কিঞ্চিত গানবাজনার। ঘরে চালের খুঁটিতে টাঙানো
থাকত যে ঢোলকটি, সেটি নিয়ে সারাদিনের খাটুনির পর বাড়ি এসে বসতেন মানুষটি। সুরেখার মারও
গানের গলা ছিল। লাভনি গাইতে পারতেন। মেয়েও ছোটবেলা থেকে বাপ-মায়ের গানবাজনা শুনে বড়
হচ্ছিল। সুরেখার ছোটো বোন লতাও মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে লাভনি গাইতে শিখে গেল। দুইবোন
যৎকিঞ্চিত নাচের তালিম নিয়ে নিল। তাদের মতো দরিদ্র পরিবারে টাকা পয়সা খরচ করে মাস্টার
গুরুজির কাছে গিয়ে নাচগানের তালিম নেওয়া সম্ভব ছিল না। ওই টুকটাক একে ওকে ধরে যতটুকু
হয়। কিছুকাল পর লতা-সুরেখার বাবা সাহস করে বেরিয়ে পড়লেন শহর থেকে দূরে গ্রাম-গঞ্জের
দিকে। লাভনি নাচগানের পুচকে দল খোলা হল আর কী— একই পরিবারের বাজিয়ে গাইয়ে আর নাচিয়ে।
কী চমৎকার সংযোগ সম্মিলন। সুরেখা গাইয়ে নাচিয়ে হয়ে উঠেছিল একেবারে ন’বছর বয়েস থেকেই।
তা নাম যশ পরিচিতি অল্পবিস্তর জুটেছে। যদিও দারিদ্র দূর হয়নি। যা পায় তা খেতে পড়তেই
লেগে যায়। দু-বোনের লাওনি নাচগানের অনুষ্ঠান দেখে লোকেরা হৈ চৈ করে। ওরাও ক্রমে সিনেমার
ঢঙে নিজেদের পেশ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। এদিকে একটা দুঃসংবাদ এল...সেবার বেশ সাত আট
মাস যাবৎ দল নিয়ে ঘুরছিল ওদের বাবা-মা। ওদের সামান্য চালাঘরটি একজনকে ভাড়া দিয়ে এসেছিল।
সে ব্যাটা ঘরটি বিক্কিরি করে দিয়ে
চম্পট। ফলত, সুরেখারা সপরিবারে পথে বসল। বসতটি ফিরে
পাওয়ার কোনও উপায়ই রইল না। নিরুপায় হয়ে ওরা সঙ্গে আনা নিতান্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি বাসনপত্র
রেখে বাদবাকি সব বিক্কিরি করে বস্তি(চাল)তে একটি ঘর ভাড়া নিল। আরও কিছুকাল চলল পুনেকরের
লাওনি দল। মহারাষ্ট্রের গ্রামে গঞ্জে ও নানা দেবদেবীর পুজো উপলক্ষে ২-৩ দিনের মেলা
বসে। লাওনি দল সেই সব মেলায় মেলায় ঘুরে বেড়ায়। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে পুনেকরের দল মুম্বাই
শহরে এসেছিল। ওখানেই খোঁজ মিলল লাভনি উৎসবের। আমত্রণ পেয়েও যাবে কি যাবে না এমন দোটানায়
ছিলেন কান্ডিবা, ওদের বাবা। মুম্বাই শহরে প্রোগ্রাম...পারবে কি ওরা সামলাতে। আসরে আরও
কত লাভনি দল, শেষে ‘ল্যাজে-গোবোরে’ না হতে হয়। কিন্তু মেয়ে সুরেখার জিদ, যাবেই। এই
লাভনি কিংবা তামাশা দল ও তাদের ওই নাচগান অশ্লীল, অভদ্র মনোরঞ্জন মাত্র। শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা
যায় না ওসব দেখতে শুনতে। কিন্তু তারাও অবাক হল সুরেখার লাভনি দেখে...চর্চা আলোচনা চলল।
লেখালিখি হল। পুনেকরের লাভনি দলের নাম পরিচিতি খবরের কাগজের মারফত সমাজের নাকউঁচু মানুষদের
আলোচনা প্রশংসার বিষয় হয়ে গেল। এম সি পি-র ওই আনুষ্ঠানে সুরেখা বাঈ গাইলেন “ইয়া রাওজি
বসা ভাওজি...”, সঙ্গে মন মাতানো নাচ। প্রশংসা পাবার কারণে ডাক এল অন্য একটি দলের থেকে।
মায়া যাদব ওই দলের মালকিন। সুরেখা এ সুযোগ ছাড়লেন না। কারন ওই দলের সুনাম ছিল। ওই দলে
থাকলে শহরবাসী দর্শক শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানো সহজ হবে। শহরবাসী দর্শকদের ধারণা বদলে
দিতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অনেক পরে হলেও আশা-লতাও লাভনি গেয়েছেন। লাভনি দলগুলোর
সুচী কিম্বা পরিবেশনায় নিজস্বতা আছে...প্রত্যেক দলের নিজ নিজ পরিকল্পিত গান ও নাচের
অনুষ্ঠানসুচী তৈরি থাকে। সুরেখাদের এমনই অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘নটরঙ্গী নার’। তেমনি মায়া
যাদবদের ছিল ‘ষোড়া হাজাবাত দেখনি’। সুরেখা বাঈ অন্য দলে নাম লেখালেও নিজের ‘নটরঙ্গী
নার’ অনুষ্ঠান “ছাড়তে পারব না” — বলে দিলেন মায়া যাদব ও তাঁর ‘ওম নাট্য গন্ধা’ দলকে।
এর কারণ ছিল... সুরেখা বাঈয়ের দলের অন্যান্য কর্মী বাজনদারদের জীবিকার প্রশ্ন। “ওরা
কোথায় যাবে?” ‘ষোড়া হাজাবাত দেখনি’ প্রদর্শন করার পর সুরেখা বাঈ-এর চাহিদা ও দর্শকদের
উৎফুল্লতা দশগুণ বেড়ে গেল। পাশাপাশি নিজের ‘নটরঙ্গী নার’ বা নাটুকে নারী-র প্রদর্শনে
দর্শক শ্রোতা বাড়তেই লাগল। তবে সুরেখা বাঈও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তামাশা–লাভনিতে এখন
ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতকলা বাদ দিয়ে হিন্দি-মারাঠি সিনেমার চটুল গানগুলো পেশ করা হয়। সঙ্গে
অঙ্গপ্রদর্শনসুলভ নাচের ফলে সস্তার চটুল দর্শক জুটে যায়— যারা নিছক মনোরঞ্জন চায়...সঙ্গীত
ও নৃত্যকলা নয়। রেষারেষি করে তামাশা-লাভনির দলগুলো অর্থ উপার্জনের জন্যে অশ্লীলতার
আশ্রয় নেয়। যদিও মাঝে মাঝে সুযোগ আসে আরও বৃহত্তর ক্ষেত্র থেকে। যেমন সুরেখা বাঈও বিদেশে
যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে বসেছিল ‘বৃহৎ মহারাষ্ট্র মন্ডল’-এর
দ্বি-বার্ষিক অনুষ্ঠান। আমেরিকা প্রবাসী মারাঠিদের মাতিয়ে দিয়ে আসেন সুরেখা বাঈ। সুরেখা
বাঈ-এর কথায়— ওই ঘটনা আমার জীবনে অপ্রত্যাশিত, অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। আর বললেন
‘সুযোগ’-এর কর্ণধার সুধীর ভট-এর কথা। নিউইয়র্কে গিয়ে সুরেখার বাঈ-এর কোনও খাবারই মুখে
রোচে না— প্রায় উপোসী হয়ে থাকার অবস্থা। সুধীরজি জানতে পেরে ‘ডাল-ভাত’-এর ব্যবস্থা
করে দিলেন। তাই খেয়ে সুরেখা বাঈ-এর প্রাণ রক্ষা। সুধীরজি ‘ক্যায় বাঈ সাংগু’(কী আর বলি
গো)তে সুযোগ করে দিলেন। ওই একই শিরোনামে লোকনাট্য ‘ক্যায় বাঈ সাংগু’ নাট্যমঞ্চে নাটকরূপেও
পরিবেশিত হয়েছে...কয়েকজনের স্বীকৃতি সত্ত্বেও লাভনি নাচগানের শিল্পীদের সামনে শুধুই
অবনমন... সব চেয়ে বড় বিপদটা তবে কী? মধ্যবিত্তের মানসিক অবস্থান। যারা কখনও কালহাতি
কি মাতঙ বা অন্য দলিত ও অন্ত্যজ ঘরের প্রান্তিক হয়ে যাওয়া নাচনিদের মননকে খুঁজতে চায়নি...কিন্তু
তাদের গানের সংকেতে বিভঙ্গে মৌতাতে ছড়ানো শৃঙ্গার রসকে যারা বিচার করে অর্থাৎ সেইসব নাগরিক মানুষের শিল্পে গানে
বিজ্ঞাপনে নারী শরীরকে যে অভব্যতায় বেচাকেনা করে সেসব তার থেকেও বেশি না কম তা বুঝতে একটা গান পড়ি? বাদবাকিটুকুর
বিচার পাঠকের...
লাম্ব রুঁদ পিকলা বিঘা
ইয়াচি কুতভর থেভসিল নিগা
সুরেখা বস্তু মানঝে আভাতান জগাত
ইয়ালা কুম্পান ঘালসিল কিতি
জাত চোরাঞ্চি লাই হিকমতি
আরদ্যা রাত্রি ঘালতিল গালা, অন তুজিয়া ...
—ফলটা খুব ডাগর আর সুরেখা(সুন্দর) হয়েছে
সুরেখা বস্তু আগলানো খুব কঠিন
এ তো কেবল হাতছানি দেয়
আর আগল রাখতে দেয় না—
মাঝরাতে চতুর চোর সিঁদ কাটতে পারে।
(চলবে...)
......(Malabika Guha Mustafi)
ReplyDeleteপরিযায়ী শিল্পীগোষ্ঠী ও গোষ্ঠীনেত্রীর এ ধূসরমান জীবনী... পরের পর্বের অপেক্ষা বাড়ছে.... বড় সহানুভূতিশীল
ReplyDeleteধারাবাহিক ভাবে যখন লেখা পড়ি, নিজের মন্তব্য অনেকসময় অতিরিক্ত লাগে।তাই ....দিয়েই জানান দিই লেখার সাথে পড়ার পথ চলা সমানভাবে সচল।আরো জানার অপেক্ষায়.....(Malabika Guha Mustafi
ReplyDelete.....@malabika guha mustafi..
ReplyDeletewell said.songe thakun
anek dhynobad @siddhartha dapratham porbo ki porechhilen.
ReplyDeleteanyway linkta dilam. https://chlorofeelblog.blogspot.in/2017/01/blog-post_12.html?m=1
ব্যবহৃত ছবিগুলি কার তোলা জানালে ভালো হয়।
ReplyDeleteএগুলো সেজেল যাদবের একটি লেখার সঙ্গে ছিল।চেষ্টা করব জানতে।
ReplyDeleteএগুলো সেজেল যাদবের একটি লেখার সঙ্গে ছিল।চেষ্টা করব জানতে।
ReplyDelete