‘বইমেলা ২০১৭’ থেকে আমার সংগৃহীত বইগুলির মধ্যে সম্পূর্ণ অন্যধারার একটি বই— ‘দুই ভুবনের পারে’, লেখক সিদ্ধার্থ মজুমদার। সিদ্ধার্থ পেশায় বিজ্ঞানী আর নেশায় কবি ও লেখক। পেশা ও নেশার এই দারুণ সংমিশ্রণ বইটির পাতায় পাতায় প্রতিফলিত হয়েছে। বিজ্ঞান এবং কবিতা, সাহিত্য ও শিল্পের মেলবন্ধন সিদ্ধার্থ মজুমদারের প্রিয় বিষয়। ইতিপূর্বে লেখকের আরও দুটি বই পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে, সেই দুটি হল— ‘বিজড়িত সময় সংলাপ’(ছোঁয়া প্রকাশন ২০১৩) এবং ‘বিপরীত পরাগ সংযোগ’(ধানসিড়ি প্রকাশন ২০১৪)। প্রথমটি কবিতার বই। দ্বিতীয়টি গবেষণামূলক রচনা। প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বইটি পুরস্কৃত হয়েছে ২০১৬তে ‘সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা’র পক্ষ থেকে। উল্লিখিত দুটি বইতেই প্রতিফলিত হয়েছে লেখকের প্রিয় ভাবনা, তা হল— শিল্প, সাহিত্য ও কবিতার সঙ্গে বিজ্ঞানের পারস্পরিক অনায়াস সফল সহাবস্থান। তবে লেখকের তৃতীয় এই প্রয়াসটি আরও চমকপ্রদ। ঠিক এইরকম একটি বই বাংলাভাষায় এর আগে লেখা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। অন্তত আমার সংগ্রহে কখনও আসেনি। বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় হল, ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘কবিতা, শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি’। এই দুই আপাত বিপরীত ভুবনের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিভাবান পুরুষ ও নারীর একান্ত ব্যক্তিগত যাপিত জীবনের অনেক না জানা কথা এবং একই সঙ্গে তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অমূল্য অবদানসমূহের বর্ণনা। আর এইসমস্ত অবদান ও নানা যুগান্তকারী আবিষ্কারের পশ্চাৎপটের বর্ণনা থেকে উঠে এসেছে সেই সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপট, নানা সুখ দুঃখ, প্রেম ভালবাসা, হতাশা, পাওয়া না পাওয়ার তৃপ্তি ও বেদনার কথা। এইসব মিলে দারুণ জমজমাট ও সুখপাঠ্য একটি বই।
সিদ্ধার্থ মজুমদারের বিশেষ কৃতিত্ব হল তথ্যের ভারে একটুও ভারাক্রান্ত না করে অনেক সমৃদ্ধ ও মূল্যবান তথ্য তিনি অতি অনায়াসে পরিবেশন করতে সফল হয়েছেন তাঁর এই বইটিতে। এখানে দেখি গর্ভনিরোধক ওষুধের আবিষ্কারক কার্ল জেরাসি আর নোবেল বিজয়ী রসায়নবিদ রোয়াল্ড হফম্যান-এর যৌথ ভাবে রসায়নাগার থেকে নাট্যমঞ্চে অনায়াস বিচরণের কাহিনি; কিংবদন্তি বিজ্ঞানী ফ্রাঞ্চিস ক্রিক, Structure
of DNA-এর আবিষ্কারক হিসেবে যে নামটি আজ আর কারওরই অজানা নয়, জানতে পারি সেই প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীর কবিতার প্রতি গভীর অনুরাগের কথা; আরও জানতে পারি, Theory of Relativity তত্ত্বের জনক আইনস্টাইনের সুর ও সঙ্গীতের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও দক্ষতার কথা; অবাক হই হলিউডের সুপারস্টার লাস্যময়ী নায়িকা হেডি ল্যামারের বিজ্ঞান প্রতিভার কথা জেনে। আরও আছে...নোবেলজয়ী জার্মান জীববিজ্ঞানী গুন্টার ব্লবেলের নোবেল পুরস্কারের পুরো টাকা (1 million
American dollar) দান করা...ব্রিটিশবাহিনীর হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত তাঁর প্রিয় শহর ড্রেসডেন-এর পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে। আবার মুগ্ধ হয়ে পড়ি স্বনামধন্য দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ভলতেয়ার এবং অসামান্য সুন্দরী আর প্রতিভাদৃপ্ত মেধাবী নারী এমিলের দুরন্ত প্রেমের কাহিনি এবং তারই সঙ্গে এই দুই সৃজনশীল...এরকমই আরও অনেক অজানা কথা ও হৃদয়ছোঁয়া সব কাহিনি ছড়িয়ে আছে বইটির পাতায় পাতায়।
পরিশেষে বলি এই বইটির সবচাইতে বড় বিশেষত্ব হল লেখকের পরিমিতিবোধ, সহজ সুন্দর ও সাবলীল ভাষার প্রয়োগ এবং কাহিনিগুলির অপূর্ব বিন্যাস ও সেগুলির পরিপাটি উপস্থাপনা...যা প্রতিফলিত করে লেখকের উচ্চ মেধা ও তাঁর গভীর শ্রম ও নিষ্ঠার। আর এইখানেই বইটির উৎকর্ষতা, তার স্বমহিমায় প্রজ্জলন।
একটু অন্য ধারার সৃষ্টিশীল লেখা পড়তে আগ্রহী সমস্ত পাঠককে আবেদন জানাই যে বইটি সংগ্রহ করুন ও পড়ুন...নিরাশ হবেন না।
সত্যি বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানের জগতে অবদানের কথা ছাড়া অন্য কিছুতে, সাহিত্যে বা কলা চর্চায় যে সমান পারদর্শীতা ছিল বা আছে সে খোঁজ আমরা কতটাই বা রাখ।
ReplyDeleteআবার একথাও ঠিক যে একটা সময় অনেক কবি সাহিত্যিক শিল্পিরাও সমসাময়িক বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন যথেষ্ট। তাদের কবিতায় শিল্পে যা প্রতিফলিত হয়েছে। ব্লেক, কোলরিজ, হুইটম্যান, ওয়ার্ডসোয়ার্থ, রবীন্দ্রনাথ অনেকের কথাই বলা যায়।
Delete