ক্লোরোfeel-এর পাতা

Saturday 7 January 2017

মনিকা : পার্থপ্রতিম ঘোষ

হিন্দি ফিল্মি গানের সঙ্গে বাবার বনিবনা ছিলনা একেবারেই। শক্ত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সে গানের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা ছিল আমাদের বাড়িতে। গানের সঙ্গে আমার ছোটবেলার ঘরকন্নায় তাই মূলত ছিল বাংলা গান, আর রবিঠাকুর ছিলেন সিংহভাগ জুড়ে। এমনক দ্বিজেন ও হেমন্ত মুখুজ্জে আমার কাছে প্রথম এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। একটা ছোট মার্ফি কোম্পানির রেডিও ছিল আমাদের বসার ঘরে, বুকসেলফের মাথায়। তার অনেক পরে, ফিলিপ্স কোম্পানির একটা রেকর্ড প্লেয়ার বাড়িতে যখন এল, আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। রেডির ডায়াল ঘুরিয়ে সক্কালবেলায় বাবা হয়তো ধরে ফেলতেন অমর পাল, তার কাপা কাপা জোয়ারিময় গলায় – ‘জাগোরে নগরবাসী’ অথবা নেমন্তন্ন আসত ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ সুবিনয় রায়ের গলায়। নয়তো হেমন্ত গাইতেন ‘প্রাঙ্গনে মোর শিরীষ শাখায়’, বা সুচিত্রা মিত্রর গলায় বাজত – ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। বাবা খেয়েদেয়ে অফিস চলে যাবার পর আমার মায়ের মুক্তি হত অনুরোধের আসরে, ‘আধুনিক গানে’। সেও বাংলা আধুনিক গান। মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখার্জ, সবিতা চৌধুরী, বনশ্রী সেনগুপ্ত, বা নির্মলা মিশ্র-র পাশাপাশি লতা বা আশাও আমার কাছে বাঙালিই ছিলেন দীর্ঘকাল। আর এরই ফাকে ফাকে, দৈবাৎ এক ঝলক খুশির হাওয়ার মতো, লালটুপি সান্তাক্লস-এর মতো হুড়মুড় করে এসে পড়ত আলপনা বন্দোপাধ্যায়ের “যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনা বিয়াবতী” বা সন সিংহের গলায়, ‘এক এক্কে এক’, গা ছম ছম করা – ‘ঠিক দুক্কুরবেলা ভতে মারে ঢিল’। 


এইভাবেই চলতে থাকে, কাচড়াপাড়ার রেল কোয়ার্টারে আমার মফস্বলী শৈশব ও বাল্যকালের সরল ও খুশি খুশি বাংলা রাজ্যপা, আর তার মধ্যে সম্ভ্রান্ত ও গম্ভীর দাড়িওলা মানুষ একজন এবং তার রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক গান স্থায়ী আসন পেতে বসে যান আমার মধ্যে। সেটা সত্তরের দশক হবে। বাড়িতে অজানা এক তিমির কাকু এসে থেকে গেলেন এর মধ্যে কোন এক দিন। অফিস থেকে ফিরে বাবা আর তিমির কাকু, কী সব কথা বলেন, বুঝিনা একটুও। আর কিছু মানুষ আসেন মাঝে মাঝে, নীচু গলায় কথা বলেন পরস্পর, তারপর চলে যান। বাবার মুখে একটু একটু শুনছি একটা অজানা নাম, ঘুরে ফিরেই। নকশাল! তিমির কাকু শুতে যাবার আগে আমাকে রোজ ডাকেন মশারির নীচে। গল্প শোনান, রবিন্সন ক্রুশোর বা কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টোর। এই সব আনন্দের রাজ্যপাটের ফাকফোকর দিয়ে কবে যেন দূরের এক নিষিদ্ধ নিশিডাক নিয়ে ঢুকে পড়েছিল নিকা। দূরে, পুজো-প্যান্ডেলের মাইকে ভেসে পাশের বাড়ির রেডিও থেকে নাকি কোন গা শির শির স্বপ্নপুরী থেকে ভেসে এসেছিল – ‘নিকা ও মাই ডারলিং, পিয়া তু অব তো আ যা’। গানের কথা পুরো বুঝিনি সেদিন, হিন্দি ভাষার সঙ্গে চেনাজানা হয়নি তখন। কিন্তু, রাহুলদেবের গলায় ঐ প্রতিধ্বনি হয়ে বয়ে যাওয়া মোনিকা ডাক, আশা ভোসলের তীক্ষ্ণ মদিরতাময় কন্ঠে বার বার উছলে ওঠা ‘পিয়া তু’, স্যাক্সোফোন আর অরগানে বেজে যাওয়া অর্কেস্ট্রেশনের মধ্যে একটা ক্যারাভান যাত্রার ইশারা নিয়ে ‘নিকা’ নামটা আমার বাল্যমনের গভীর অবচেতনায় ঢুকে পড়ল। জুড়ে গেল বাস্তুহারা করে দেবার অজানা এক ডাক, এডভেঞ্চারের ইশারা। এর মধ্যে একদিন তিমির কাকু আমাকে অনেক এডভেঞ্চারের গল্প শুনিয়ে, কোন এক মাঝরাত্রে আমাদের কোয়ার্টার ছেড়ে চলে গেলেন। সকালবেলায় বাবা খবর দিলেন – তিমির কাকু নেই, চলে গেছেন। দুদিন পর, মথুরা বিলের কাছের জঙ্গলে নাকি তাকে পাওয়া গেছিল। না, তাকে নয়, পাওয়া গেছিল তার শরীর।  তিনি চলে গেছিলেন অন্য কোন এডভেঞ্চারের দিকে। 


এর অনেক অনেক পরে, যখন আমার যুবা বয়েস, যখন আমি বাড়ির ঘেরাটোপ পেরিয়ে যাচ্ছি, বাবার হাত ছেড়ে দিচ্ছি, যখন আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত নাগরিক, তখন আবার এসে পড়লেন নিকা। বিস্ময়ের চোখ তখন খুলছে। সুনীল, সমরেশ, বিমল কর, রমাপদ বা শঙ্কর ছেড়ে আমার মধ্যে ঢুকছেন মানিক, কামু, কাফকা, দস্ত্যভস্কি বা মার্কোয়েজ। সত্যজিত, মৃণাল আর ঋত্বিক হাত ছাড়েননি বটে, কিন্তু অন্য দিগন্ত খুলছেন বেনেগাল, বা সথ্যু, আর পেন্টিং-এর মতোণি কাউল। দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ছেন  বার্গম্যান আর তার ভাস্করের মতো নারীরা – থুলিন, বা লিভ উলমান। আসছে ফেলিনির ম্যাজিক, নদীর মতো বহমান ডি সিকা, জাভাত্তিনি, রসেলিনি, আর  গুনে গুনে গোদার আসছেন বা ত্রুফো। কবিতার মতো পাসোলিনি আর ব্রেসো এলেন যেমন, সঙ্গীত ও পেন্টিং-এর মাঝামাঝি অবস্থানে এলেন আশ্চর্য তারকোভস্কি। এর মাঝখান দিয়ে গান্ধী ভবনের অন্ধকার হয়ে যাওয়া পর্দা থেকে ক্রমে ক্রমে বেরিয়ে এলেন তিনি। আমার বাল্যবয়েসের সেই দিনকাল থেকে আবার এসে পড়লেন নিকা। মনিকা ভিত্তি। তিনি  যতখানি আন্তনিয়নির, যতখানি তার সৃষ্টির সঙ্গে ওতোপ্রোত, ঠিক ততখানি আমারও ব্যক্তিগত। আশ্চর্য সমাপতনের মতো তিনি এলেন, গান নয়, শরীরী হয়ে এলেন আমার কাছে যে ছবির হাত ধরে, তার নাম ‘লা আভেন্তুরা’।  ইংরিজী তর্জমায় এর মানে দাঁড়ায় – The adventure!


আন্তোনিয়নি মানে এক যাত্রা, যা অভিযাত্রা নয়, বরং এক অনির্দেশের দিকে স্বততঃ গমন। স্বতত এক জার্নি বা নিরন্তর এক সরে সরে যাওয়ার নাম হয়ত আন্তনিয়নি। লা আভেন্তুরার কত আগেই তো আন্তনিওনি এসছিলেন আমার কাছে, তার ১৯৫৭-র ছবি ইল গ্রিদো নিয়ে। ইল গ্রিদো মানে – The Cry.  ক্রাই, মানে এক বিপুল কান্না। বুকের অতলান্ত থেকে উঠে আসা কোন এক অনির্দেশ চাওয়ার নামও তো ক্রাই। দা ক্রাই ছবির প্রধান পুরুষ যে আল্ডো, সে তো শুধু যাত্রা করে এক নারী থেকে ভিন্ন নারীতে। স্বাদবদল নয়, বরং স্থিতিই চেয়েছিল সে। আশ্রয় খুজেছিল ঘুরে ঘুরে, শেষ আশ্রয় পেতে আবার সে যখন ফিরে এল তার প্রথম নারীটির কাছে, ইর্মা যার নাম, সে কি তখন স্থিত ও তৃপ্ত ভিন্ন এক সংসারে? তাই আল্ডো সরে গেল আবার। কোথায়? মৃত্যুর কাছেই যেতে চেয়েছিল কি? নাকি মৃত্যু নিজেই এল তার কাছে savior হয়ে? এই এম্বিভালেন্স আশ্রয় খোঁজে ইর্মা-র শেষ কান্নার মধ্যে। 


লা আভেন্তুরাও এক সন্তত যাত্রার কথা বলে। সেই যাত্রার শরীর মেটাফর হয়তো মনিকা ভিত্তি। আনা আর সান্দ্রো, চলিত অর্থে স্থিত ও তৃপ্ত স্বামী-স্ত্রীই তো ছিল! তবে কেন সিসিলি দ্বীপের আনন্দভ্রমণের মাঝে হঠা স্বামীকে ছেড়ে নিরুদেশ হল আনা? কোথায় গেল সে? এ ছবি তার উত্তর খোজেনি। বরং আনাকে খুজেছে সান্দ্রো আর ক্লদিয়া, খুজতে খুজতে কখন, কোন রহস্যে, নিজেরাই জড়িয়ে গেছে প্রেমে। গৌণ হয়েছে আনাকে খুজে ফেরা। এই খোজার মধ্যে দিয়ে আন্তোনিয়নি আবার তো সেই এক অনির্দেশ যাত্রার দিকেই নিয়ে যান আমাদের। সেই যাত্রার অন্ধগলিতে ঘুরে ঘুরে, ক্লদিয়ার প্রতি প্রবল প্রেমাশক্ত হয়েও সান্দ্রো কেন গেল আবার এক ভিন্ন যৌন অভিজ্ঞ্যতার দিকে? কেন আবিষ্কৃত হল সে এই যৌনতার মধ্যে, আর কার চোখে নয়, ক্লদিয়ারই চোখে? কান্নায় ভেঙে পড়েছে ক্লদিয়া, আমার মনিকা ভিত্তি! 


লা আভেন্তুরা দিয়ে মনিকার সংগে যে জার্নি শুরু করেছিলেন আন্তোনিয়নি, তার সম্প্রপ্সার পরের দুটি ছবিতেও। লা নত্তে(The night ), আর লে’ক্লিসে(The Eclipse) ছবিতেও মনিকা আছেন তার আম্বিভালেন্স নিয়ে। লা নত্তের ভ্যালেন্টিনায় মনিকার ভুমিকা অনুঘটকের মতো। কিন্তূ The eclipse ছবিতে মনিকাই প্রধান। তার অবস্থান এ ছবিতে লা আভেন্তুরা ছবির এক রিভার্সাল। The eclipse, ভিত্তোরিয়ার আধারে মনিকার জার্নির ছবি। সেই জার্নিও অনিশেষ আর অনির্দেশের দিকে। ফ্রেম থেকে মনিকা ফ্রেমহীনতার দিকে যেতে চান বার বার। শেষ দিকে ভিত্তোরিয়া তার পুরুষটিকে বলছেন, আমার মনে হয়, আমি তোমাকে আর ভালোবাসবনা, অথবা আর ভালোবাসব। লা আভেন্তুরার মতো লা এক্লিসের শেষ দৃশ্যও অনিঃশেষ। পিয়েরো আর ভিত্তোরিয়া দুজনে দুজনকে আদরে ভরিয়ে দিয়ে, ফিরে আসবার কথা দিয়েও আর কেউ কার কাছে ফিরে আসেননা। পড়ে থাকে শুধু স্পেস, শন্য স্পেস, আর কিছু অবজেক্ট। এই একইসঙ্গে থাকা এবং না থাকার যে এম্বিভ্যালেন্স আন্তনিওনির যাত্রার প্রকল্প, তার শরীরী রূপ পায় মনিকার মধ্যে, বিশেষ করে তার চোখের অনির্দেশ্যতার মধ্যে। 


স্বপ্নের মতো মনিকা ভিত্তির চোখ। লা আভেন্তুরার যে যাত্রা, তার শেষ আসে এক স্বপ্নের মতো টেরেসের মাঝখানে। আমাদের নিয়ে যান আন্তোনিয়োনি শন্য এক স্পেস-এর মধ্যে। খোলা স্পেস-এর nothingness-এর মধ্যে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছে সান্দ্রো। মনিকা এগিয়ে এসেছেন নিঃশব্দে। হাত রেখেছেন সান্দ্রোর মাথায়। গাছের পাতা্রা কাপে। আর শুধু হাওয়া বয় শন শন! সেই মুহূর্তে দেখি মনিকা ভিত্তির চোখ। কী বলে সেই চোখ? সেই চোখ আমার বাল্যকালের কথা বলে। আমার মৃত্যুর কথাও। আমার এডভেঞ্চারে হারিয়ে যাওয়া তিমির কাকুর কথা বলে। কোথায় আছেন মনিকা? সেই মুহূর্তে? সান্দ্রোর কাছে, না দূরে?  অন্য কোথা, অন্য কোনখানে?। এইখানে দাঁড়িয়ে মনিকা আর মনিকা ভিত্তি নন। তিনি যেখানে আছেন, সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন অন্যখানে, অন্যকোথাও। এই অন্যকোথাও অবস্থানের নাম মনিকা। এই elsewhere বোধের নাম মনিকা ভিত্তি, যা আন্তোনিয়োনির সিনেমারও প্রাণভ্রমর। মনিকা ছাড়া লা আভেন্তুরা হয়না। মনিকা ছাড়া অন্তোনিয়নিও সম্পূর্ণ হননা। মনিকা আর তার চোখ আন্তোনিয়নির থাকা ও না থাকার দ্ব্যর্থকতার এক রূপক। মনিকা ভিত্তি আন্তোনিয়নির অনিঃশেষ গমনের এক সংহত শরীরী রূপ। মনিকা আর তার চোখ আমার বাল্যকালে ফিরে যাওয়া এক ব্যক্তিগত অনির্দেশের নিশিডাক।

1 comment:

  1. আমি ভেবেছিলাম, মনিকা ও মাই ডার্লিং! শুরুটা যে ভাবে করেছিলে... দারুণ লাগল। শেয়ারালাম।

    ReplyDelete