বছর কয়েক আগে, তখন কর্মসূত্রে নাসিকে। টাউনশিপ আর ফ্যাক্টরি শহর থেকে প্রায় বাইশ কিমি দূরে— জায়গটার নাম ওঝার গাঁও। এখনও প্রধান সড়ক একটিই, ন্যাশানাল হাইওয়ের— যেটা ১৮০ কিমি দূরে মুম্বাইতে গিয়ে শেষ হচ্ছে। চারপাশ ঘিরে আঙুরখেত আর নতুন নতুন গজিয়ে ওঠা ওয়াইনারি। সেসময় ই-টেন্ডারিং-এর কারণে ইন্ট্রিগ্রেটেড মেটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের একটি অল্পবয়েসি মেয়ের সঙ্গে আলাপ। মেয়েটি সিস্টেমের লজিস্টিক দিকটা দেখে। ফলত নানা বিষয়ে কথা থেকে আলাপ জমে যায়। মেয়েটির বাবাও আমাদের সহকর্মী। এরা যদিও ওড়িশার লোক কিন্তু মেয়েটি জন্ম থেকেই টাউনশিপে আছে। লেখাপড়া সবই স্থানীয় ইস্কুল কলেজে, ফলত মারাঠিটা প্রায় মাতৃভাষার মতো বলে। শুধু কী কথা, মাঝে মাঝে দেখি অখেয়ালে খুব দ্রুতলয়ের কিছু গান গুনগুন করে। একদিন জানতে চাইলাম কিন্তু দেখলাম নানা কথায় মেয়েটি এড়িয়ে গেল। ভাবলাম লজ্জা পেয়েছে। আমিও বিষয়টা আর উত্থাপন করলাম না। কিন্তু কানে রয়ে গেল অদ্ভুত এক দ্রুতলয়ের সুর। ব্যাপারটা ভুলেই গেছি। একদিন এক স্থানীয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণে গেছি মানমারে। মানমার ওঝার থেকে বেশ কিছুটা দূর এবং আরও একটু বেশি গাঁওটি— মানে গ্রাম্য। সেখানে বিয়েবাড়িটা একটা বড় সব্জিমান্ডির পাশে। যারা ওখানকার পেঁয়াজ বা আঙুরের মান্ডি দেখেছে তারা বুঝবে কত বিরাট হয় তার আয়তন। তা সেই মান্ডির পাশে দেখি মঞ্চ বাঁধা হয়েছে আর সন্ধে নামতে সেখানে মাইকে খুব জোরে জোরে ঘোষণা হচ্ছে। মারাঠিতে বলে কিছু বুঝছি কিছু বুঝছি না, কিন্তু এইটুকু বুঝলাম এখানে জলসা হবে। বিয়েবাড়ির মধ্যে ডুবে ছিলাম তাই আর ওদিকে খেয়াল করিনি। ফেরার সময় গাড়ির কাচ নামিয়ে দেখি মঞ্চের সামনে প্রচুর ভিড়। স্থানীয় সব বয়সী পুরুষ মহিলা এমনকি নাবালকেরাও ভিড় জমিয়েছে আর মঞ্চে ঢোলকের আওয়াজের সঙ্গে দারুণ ছন্দে নেচে যাচ্ছে একদল নর্তকী। তাদের পায়ের দ্রত ছন্দ আর কোমরের বিভঙ্গের সেই লোকনাচ দেখে না দাঁড়িয়ে উপায় নেই। এখানে মেয়েগুলো গাইছে না, শুধু নাচছে আর গান হচ্ছে বক্সে। মারাঠি নওয়াড়ি শাড়ি পড়া, চুলে সাদা ফুলের মালা জড়ানো আর পায়ে বাঁধা ধাতব ঘুঙুরের আওয়াজ— সব মিলে এক অন্যমাত্রার শ্রবণ ও দৃশ্যসুখ যা কখনও আগে শুনিনি বা দেখেনি— হয়তো শুনেছি হয়তো দেখেছি তবে অন্য রকম— কীরকম সেটা? ওই যে ওড়িয়া মেয়েটা গুনগুন করেছিল সেই সুরটা মনে পড়ে গেল এদের নাচের সঙ্গে বাজা গান শুনে আর এও মনে হল মুম্বাই সিনেমার করিওগ্রাফাররা বহু চটুল নাচে যেন এই নাচের ধাঁচটাকেই ব্যাবহার করে। আমার থতমত খাওয়া দেখে বন্ধু খান্ডারে বলে— আপন দিসত নাহি, হে লাভনি আহে— মানে আপনি দেখেননি আগে, এটা হল লাভনি। খান্ডারে কিছুটা চোখ কুঁচকে বলে চলে, আরে এইসব গাঁওটি মিনিংলেস গান দেখতে দাঁড়ালেন কেন। আমি বললাম দারুণ লাগছে। একটু দাঁড়ালে হয় না? খান্ডারে বলে এগুলো সব খারাপ মেয়েমানুষদের নাচ (ওর ভাষায় চিকনি-চামেলি), গ্রাম-মফস্বলের মারাঠিরা দেখলেও শহুরে শিক্ষিত মারাঠিরা এগুলোকে অশ্লীল প্রদর্শন ভাবে। বুঝলাম ওই মেয়েটি কেন আমার কাছে ওর ছান্দিক ভালোলাগাকে লুকিয়েছিল। পরের দিন পি এফ অফিসের প্রবীণ কর্মী গাঙ্গুরেকে জিজ্ঞাসা করলাম। জানতাম গাঙ্গুরে মাহার সম্প্রদায়ের এবং ধর্মে বৌদ্ধ। বাবা সাহেবের কারণে এরা অনেকেই এখন বৌদ্ধধর্মের বিন্দুবিসর্গ না জেনে ও বুঝেই বৌদ্ধ হলেও পূর্বের জাত-ধর্মের অনেককিছু, যেমন আমিষ ভক্ষণ থেকে লাভনির প্রতি টান ছাড়তে পারেনি। গাঙ্গুরের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি, দেখি খান্ডারে এল, আমরা একসাথেই ব্রেকফাস্ট করছিলাম।কথায় কথায় লাভনি ফিরে এল, ফিরে এল আরও কিছু কাঁচামিঠে কথা।বুঝলাম এই বৃন্দ-নাচের শরীরী উদ্দামতার সক্ষম প্রয়াস আর দ্ব্যর্থবোধক গানের কথার যে উদ্ভাস তার মৌতাত পেতে গেলে মনের আগলটুকু খুলতে হবে— কখনও সেই কথার কোনও মাথামুন্ডু নেই মনে হবে— আদপে যেন পাগলামি!
“মাঝা উসালা লাগাল খোলা গা...”, কী এর মানে? মানে করে বলা খুব কঠিন— অনেক চেষ্টা করে বন্ধু খান্ডারে অনুবাদ করে বলল, এই গানের কথার অন্তর্নিহিত মানে হল—
“একটা শেয়াল আমার আখের খেতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে...।”
আহাঃ কী দারুণ করে বলা! যৌনতার এমন বিস্তার গ্রাম্য লোকগানের কথায়!
“ফড় সামভাল তুরিয়ালা গ আলা
তুজিয়া উসালা লেগাল কোলহা গ
মুল জমিন কাল সোন
তায়াত নামাঙ্কিত রুজল বিয়ান
তুজা উস ভাদলা জোমান
ধাটাধাটাত উভারি ধরলি
পিরাপিরাত সাখার ভরলি
নাহি ভইচ জাগা উরলি
রঙ পানাছা হিরভা ওলা
তুজিয়া উসালা...”
— সাবধান (আখের খেতে) চিত্ত চঞ্চল করা ফুল এসেছে
ব্যাটা শেয়াল আসতে পারে সেই লোভে
আমার আসলি জমিটা কালো সোনা
সেখানে ভাল বীজ ছড়ালে
(রসালো)পুরুষ্ট আখ বেরোবে
যে দেহের সবটা উদলা
কোথাও খালি নেই— সে আখের অঙ্গ অঙ্গ মিঠে
আর পাতাগুলো ঘন সবুজ
সাবধান চোর শেয়ালের থেকে।
খান্ডারে শহুরে মারাঠি, ওর কাছে এটা মিনিংলেস লাগে— আমি সেই সেয়ানা শয়তান চোর শেয়ালের মতো পুরুষ আর আখের খেতের অনুষঙ্গে নারীর মধুভাণ্ডের মেটাফরকে ভেবে খান্ডারেকে চেপে ধরি— আরও শোনাও। জোওয়ারের ভকরি, মানে পাঁপড়ের মতো মুচমুচে ইন্সট্যান্ট রুটি আর সবুজ মুগডালের রসা খেতে খেতে ও বলে এইসব গাঁওটি মানে গ্রাম্য কথার মানে বোঝানো খুব কঠিন— সুলোচনা চ্যবন খুব নাম করা শিল্পী ছিলেন, ওঁর কিছু লাভনি আছে আপানাকে দেব তবে কটার মানে ঠিকঠাক পারব জানিনা। তেমন গানের কথায় আমিও মজেছি। আমি ওদের লাভনি কথার মানে জিজ্ঞাসা করি, জিজ্ঞাসা করি এর ইতিহাস। যা জানলাম তার বিস্তারে যাওয়ার আগে কিছু বলি সংক্ষিপ্ত করে। লাভনি নামটা এসেছে লাবণ্য শব্দ থেকে। অনেক ভারতীয় নাচের জন্ম মন্দিরের চাতালে বা রাজসভায়। ধর্মীয় অনুষঙ্গ আর আধ্যাত্মিকতায় তাদের বিস্তার, কিন্তু লাভনিতে আছে শৃঙ্গার রসের মাতামাতি। মধ্যযুগের মারাঠাদের তখন দোর্দণ্ড প্রতাপ। লাওনি বা লাভনি শুরু হয়েছিল, রণক্লান্ত মারাঠা সৈনিকদের মনোরঞ্জনের জন্যে। লাভনি ছাড়াও আরও কিছু লোকনাচ ছিল পশ্চিম ও মধ্য ভারতের নানা অংশে। তার মধ্যে তামাশা বিশেষ উল্লেখ্য। মারাঠি লোকনাট্য তামাশার খোঁজ পাওয়া যায় সেই পেশোয়ারের যুগ থেকে। গ্রাম্য মারাঠি দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জন আর লোকশিক্ষার প্রয়োজনে গ্রামবাংলার যাত্রাপালার মতোই শত শত বছর ধরে তামশা হয়ে আসছে। শতাধিককাল প্রাচীন এই লোকনাট্যে লাভনি এক অত্যাবশক উপাদান। লাভনি মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণ মধ্যপ্রদেশের নয় শুধু, এমনকী কর্নাটক ও তামিলনাড়ুর কিছু অংশেও লাভনির চর্চা হত। যদিও আজ শোলাপুর কোলাপুরের নাচ বলেই লোকে চেনে আর চেনে নিছক যৌনতার ভঙ্গিসর্বস্ব এই তকমায়। আমি বেশ উদ্দীপ্ত হয়ে ওদের আরও কিছু গান তর্জমা করে বলতে বলি। কিন্তু আমাকে অবাক করে গাঙ্গুরে এক বাঙালির নাম বলল। তিনি আমার ডিপার্টমেন্টেই ছিলেন, বছর দুয়েক আগে রিটায়ার করেছেন, যদিও এখন নাসিক শহরে বাড়ি করেছেন কিন্তু মাসে বার দুই কোম্পানির বাসে চেপে ত্রিশ কিমি দূর থেকে টাউনশিপের হাসপাতালে আসেন। এও জানলাম সেই প্রবীণ বাঙালিটির নাকি এইসব ব্যাপারে খুব ঝোঁক, নিয়মিত লেখালেখি করেন এবং সেটা অফিসের সবাই জানে। আমি হাতে চাঁদ পেলাম। কয়েকদিন পরে বাস্তবিক দেখা হল দেবনাথবাবুর সঙ্গে। আলাপ খুব দ্রুত সখ্যে পরিণত হল। যদিও প্রথমে লাভনির ব্যাপারে কিছু বলিনি। কিন্তু জানতে পারলাম মানুষটি গত চল্লিশ বছর ধরে মহারাষ্ট্রে আছেন আর ভাষাটার প্রেমে পড়ে গেছেন, ফলত মারাঠি সাহিত্য বাঙলায় অনুবাদ করার নেশা। সেটা এতদুর গড়িয়েছে যে সাহিত্য একাদেমি নামদেও কামলের দলিত চরিত্র নিয়ে লেখা ১৯৯৫ সালের একাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মারাঠি উপন্যাস ‘রাঘোয়া ভেল’ দেবনাথবাবুকে দিয়ে অনুবাদ করিয়েছেন আর তিনি এজন্য পুরস্কৃতও হয়েছেন। এসব জানার পর আমার এবার লাভনি নিয়ে কথা বলতে সাহস হল। অন্তত এই মানুষটি মধ্যবিত্তসুলভ মরালিটি কপচাবেন না। বাস্তবিকই তাই হল। বুঝলাম, লাভনির আজ বেশ দুর্দশা। এই গানের শব্দে নানা ‘ব্যভিচারের চিহ্ন’ একে সিভিল সোসাইটি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, ফলত এই গান ও নাচের শিল্প হিসেবে যে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। দেবনাথ বলছিলেন, আমিও জানিনা লাভনি অবজ্ঞাতেই তলিয়ে যাবে কিনা। নাকি মুম্বাই-এর আইটেম সঙ-এর লেজুরবৃত্তি করবে এই লোক-নাচগান! কারন এই গানে লজ্জাশরম না রেখেই যে বলে—
“কত আর সামলাব বুকের কাপড় এবারে বিয়ে করব গো— বিয়ে করবই
কত লোক দেখে পথে যেতে যেতে—
(আর) মনে মনে কতই(মিচকি)হাসে
আঁচল কেবলই খসে পড়ে— কত আর সামলাব তাকে
মনেতে আছে কেউ একজন— কেমনটা হয় যে বুকে
ঘুম আসে না রাতে মোটেই
স্বপ্নে দেখতে পাই কাকে যেন, পথে চলতে ধাক্কা মারে—
মনেতে ঝড় ওঠে— মনের মত পুরুষ কোথা—
(আমি) কোথায় থামবো গো
এবারে বিয়ে করতেই হয় গো—”
(চলবে)
লাভনীর folk dance হিসেবে পরিচিত আর কোনকান অঞ্চলেও এই ধরনের নাচ আছে।
ReplyDeleteলাভনীর folk dance হিসেবে পরিচিত আর কোনকান অঞ্চলেও এই ধরনের নাচ আছে।
ReplyDeleteমহারাষ্ট্র ছাড়া অন্য প্রদেশ এমন কি তামিলনাড়ুর কিছু অংশেও এই নাচ হতো। যদিও পেশোয়ারদের কারনে এর বিস্তার বাড়ে।পরের পর্বে এব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছি।
ReplyDeleteDarun laglo jene. Labhni lokonrityo dekhte chaile Maharashtrer kothay jete hobe ?
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteনাসিক বা সোলাপুর কোলাপুর অঞ্চলে কিছুটা মেলে। যদিও এখন মুম্বাইএ কিছু গবেষক ওয়ার্কশপ করে নতুন করে কিছু করার চেষ্টা করছেন।প্রকৃত লাভনি মৃতপায় নানাবিধ কারনে।ইউটিউবে দেখলে পুরোন শিল্পিদের কাজ দেখাই ভাল।লেখাটা বেশ কয়েটা পর্বে বেরোবে ফলত আরো কিছু তথ্য পাবেন আর কিছূও গান।ধন্যবাদ।সঙ্গে থাকুন
ReplyDeleteবাঃ সুন্দর । জয়ন্তদা ...
ReplyDeleteচুরির সাক্ষী থেকো
ReplyDeleteকী চুরি ? চোরটি-ই বা কে ?
Deleteওই যে আখের মধুভান্ডের লোভে চোর শিয়াল আসে।লাভনির শৃঙ্গাররসের এই মেটাফরগুলো খুব সাংকেতিক
ReplyDeleteওই যে আখের মধুভান্ডের লোভে চোর শিয়াল আসে।লাভনির শৃঙ্গাররসের এই মেটাফরগুলো খুব সাংকেতিক
ReplyDeleteসাথের ছবিগুলি কার তোলা জানালে ভালো হয়।
ReplyDelete