ক্লোরোfeel-এর পাতা

Friday, 6 January 2017

হাতের মধ্যে মিলিয়ে যায় মৃদু হাতের আয়ু – শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ নিয়ে থেমসের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে লন্ডন সেদিন। এলোপাথাড়ি হাওয়া চলছে। ট্রাফালগার স্কোয়ারের এক দিকে একটা রেলিং-এ ভর দিয়ে আমি তখন ভার সামলাচ্ছি সারাদিন ধরে দেখে ওঠা ন্যাশনাল গ্যালারির ঐশ্বর্য। মাথা কাজ করছে না। কানে বাজছে প্রায় পঁচিশ বছর আগে এই শহরেরই কুইন এলিজাবেথ হল-এর একটা রেকর্ডিং। নিখাদের কষ নিংড়ে উঠে আসছে বিরহের পুকার। আর আমার চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে 'সানফ্লাওয়ার' – ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। সারা সন্ধে রাতের প্রতীক্ষার পর বাসি হয়ে যাওয়া অবহেলিত, ভালোবাসাহীনতার সূর্যমুখীর সেই হলুদ। এই মুহূর্তে আমার প্রতিটি লোমকূপ থেকে উঠে আসছে যে শিহরণ তা ভাগ করে নেওয়ার মতো পৃথিবীতে আর কেউ নেই একটি মানুষ ছাড়া। ট্রেঞ্চকোটের পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করে স্পিড ডায়াল করলাম ১ নম্বরে। বার দুয়েক রিং হওয়ার পর ওপার থেকে গলা শোনা গেল - “দেখলি?” স্বরের মধ্যে আনন্দ আর উত্তেজনা আমার শিহরণকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে যেন। আমি বললাম “হুঁ, কিন্তু তুমি থাকলে ভালো হত।” কেন যেন আমার চোখে জল এসে গেছে। বুঝতে পারছিলাম যে তার কত লড়াই, কত জয়, কত বিচ্ছিন্নতা, কত ব্যস্ততার মধ্যেও এই ছোট্ট হাতদুটো চিরকাল এবং কীভাবে এখনও বাবার ওই দুটো হাতের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। মনে আছে আমার তখন বছর চারেক বয়েস হবে। মোটমাট খুবই ছোট তখন। বাবার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ানোই আমার তখন প্রধান কাজ। সারাদিন এমনকী অনেক সময় মাঝরাত পর্যন্ত বাড়িতে গানবাজনা চলত। কতদিন হয়েছে বাবা গাইছে, ঘরভর্তি লোকজন, ছাত্রছাত্রী, ভক্তরা, আবার হয়তো শিল্পীরাও রয়েছেন। আমি বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি মাঝপথে, ঘুম ভেঙেছে তারার সা লাগছে যখন – তখন। তো সেরকমই একটা সময়, আমাকে একটু একটু করে মধ্যলয়ের বিস্তার শেখাচ্ছে বাবা তখন। ভৈরোর তালিম চলছে। সেদিন বেশ কিছুক্ষণ তালিম হওয়ার পর বিভাসদা এসে ঢুকল। তবলিয়া বিভাস সেনগুপ্ত। বাবা ইশারায় বিভাসদাকে তবলা নামাতে বলল। বিভাসদা তবলা নিয়ে এসে বসল। মধ্যলয় ত্রিতাল বন্দিশ “আদ ভৈরব রাগ রূপ ধরে”। মধ্যম, পঞ্চম, কোমল ধৈবত আর শুদ্ধ নিষাদের বিভিন্ন অলিগলি শেখাচ্ছে তখন বাবা। হঠাৎ উপরের নিখাদ থেকে ধৈবত পঞ্চম মধ্যম আবার পঞ্চম হয়ে কোমল রেখাবে এসে দাঁড়ালো বাবা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল “খরজের সা টা দাও দেখি”। ওই  মানুষটির  গলায় ওই রাস্তার পর খরজের সা-এ এসে শেষ করাটা যে কী কঠিন কাজ সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে একটা ভালো ব্যাপার হল তখন আমি অতশত বুঝতাম না। তখন আমি পণ্ডিত মানস চক্রবর্তী নয়, শুধুই বাবার সঙ্গে গাইছি এটুকুই বুঝতাম। আমি তখন আমার সেই কাঁচা গলায় ধ নি রে সা করে এসে দাঁড়ালাম সা-এ। অপেক্ষায় যে বাবা আবার কোনও একটা রাস্তা গেয়ে দেখাবে। কিন্তু বাবা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চোখ বন্ধ করে রইল। তারপর বিভাসদার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত হাসি দিল। সেই মন ভালো করা হাসি। বলল “ভৈরোর সা-এর এই ইনোসেন্স...এটা শিখিয়ে হয় না। এটা ও নিয়ে জন্মেছে।” সত্যিই আমি এখনও জানিনা আমি তোমার কাছ থেকে কী কখন কীভাবে শিখেছি! কিছুটা হয়তো অভিমন্যুর মতোও! আজকের জীবন যখন এতটাই জটিল যে তার সাপেক্ষে ছোটবেলার কথা ভেবে একদিন লিখে ফেলেছিলাম “হাতের মধ্যে মিলিয়ে যায় মৃদু হাতের আয়ু / তার চে' বড় জীবন নেই কোনও। / রাস্তাজোড়া অশ্বমেধ, আকাশ থেকে নেমেছে কার জিন / সমস্ত ঘুম ওষুধ নিংড়োনো”। আর এখন যখন গাই, লিখি, কম্পোজ করি, ক্ষণে ক্ষণে বুঝতে পারি কীভাবে যেন অনেককিছুই অজান্তে শিখে ফেলেছি। ভৈরোর ওই সা-এর মধ্যে যে ইনোসেন্স এর মায়া সেই মায়াই তো যেন ছেয়ে আছে সানফ্লাওয়ারের পাতায় পাতায়। মনের আলোছায়ার সবুজে, রাফায়েলের আলোআঁধারিতে। আর ট্রাফালগার স্কোয়ারের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আমি যেমন মেঘের মধ্য দিয়ে দিয়ে বীর মাড়োয়াকে আসতে দেখছি, তেমনই বোধহয় তুমিও দেখেছিলে।

লন্ডনের আকাশ সেদিনও সারাদিন মেঘাচ্ছন্ন ছিল। আর সেই দিনভরের মেঘাচ্ছন্নতার রেশ যেন এসে পড়েছে থেমসের পাড়ে উইপিং উইলোর নীচে একলা এক বেঞ্চের একপাশ ঘেঁষে বসে থাকা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ এক যুবকের চোখেও। নিজের দেশ, ঘর, আপনজনদের থেকে সে তখন হাজার মাইল দূরে। হাতের ছাইরঙা ডাইরির পাতায় পাতায় তখন তার ছত্র ছত্র একাকীত্ব লেখা হতে হতে তার মতোই গভীর হয়ে উঠেছে। সন্ধে-পরবর্তী আলোয় তখন সেজে উঠেছে লন্ডনের পথঘাট। থেমসের ধারে ধারে বাতিগুলির রেশ ধীরে ধীরে কাছ থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে যেভাবে অলঙ্কার মিলিয়ে যায় প্রেমিকার কুন্তলের আঁধারে। কুইন এলিজাবেথ হলের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে একটু আগে। অগুন্তি মানুষের মুগ্ধতায়, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় ভেসে যাচ্ছে স্মৃতি তখন। কিন্তু এই ভেসে যাওয়ারও তো একটা ক্লান্তি আছে। সে ক্লান্তির ভার বড় বেশি। এবারে ফেরা দরকার। বাড়ি ফেরবার সময় হয়েছে। ভাবতেই মনে হল যেন বা এটা কলকাতাই! অনুষ্ঠানশেষে বাড়ি ফেরবার পথে যেন বা গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছে ধূমপানের বদভ্যেসটা সমাধা করবার জন্য। হয়তবা আর কয়েক ঘন্টা রাস্তা পেরোলেই ছায়াহিন্দোল! কলিং বেলে আঙুল পড়তেই দ্রুতপায়ে এসে দরজা খুলে দেবে তার রাণী ঘরনী আর আওয়াজ পেয়েই ঘুমচোখে দৌড়ে আসবে ছোট্ট রাজকুমারী, কোলে পিঠে উঠে পড়বে বিড়ালছানার মতো। হ্যাঁ, সে তো রাজাই! তার যদিও হাতিশালে হাতি নেই, ঘোড়াশালে ঘোড়াও নেই তবুও সে যখন তার গানে, তখন সে ওই প্রতিটি স্বরের পালক। সারা ভূমণ্ডল শাসন করার ক্ষমতা রয়েছে তার স্বরক্ষেপণে। সে জানে, কিন্তু মানতে বড় কুন্ঠা তার। মানবে তো মানুষ! শ্রোতা! আর মানবে প্রকৃতি আর তার ঈশ্বর! সেই শক্তি যাকে ধারণ করতে পারলে তবেই শিল্পী স্রষ্টা হয়ে ওঠেন।

একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে যুবকটি নিজের অজান্তেই একটি সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে তখন। তার বাবার কথা মনে পড়ছে। অনেক পথ পেরিয়েছিলেন তিনিও। সে তো বড় সহজ পথ ছিল না। পথের নিয়ন তারও একাকীত্বের সঙ্গী ছিল হয়ত। অনেক অন্ধকার হেঁটে তিনি যেদিন আলোর রাস্তা পেয়েছিলেন আর পরে সেই আলো চিনিয়ে দিয়েছিলেন ছোট্ট সাতবছরের পুত্রকে, তারকাখচিত শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে তুমূল হর্ষধ্বনিতে আসর শেষ হয়েছিল সেদিনও। কিন্তু সে আলো তো কেউ কাউকে দিতে পারেনা, যার যার ভাগের আলো যে তাকে অর্জন করতে হয়। সেই অর্জনেরই খেলা চলেছে এখন। আর এই যুবকটির কাছে এই খেলার একটাই নিয়ম, নিজের শিল্পের কাছে সৎ থাকা। আর কোনও বিকল্প নেই, মিথ্যে নেই এখানে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তখন ধোঁয়ার কুণ্ডলীগুলি মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায় আর ওই কুয়াশার মধ্যেই কোথায় যেন সময়টা হারিয়ে যাচ্ছে তার। কয়েকটা সুখটান দিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে ছাড়তে হঠাৎ দূর থেকে মিহি মহিলা কন্ঠের ডাক শোনা গেল - “Manas ji!” ফিরে তাকালেন মানস। প্যাট্রিশিয়া। “Is that you there?” “Yes!” বললেন। “We were thinking we lost you! What are you doing here?” চিন্তিত গলায় জিজ্ঞাসা করল প্যাট্রিশিয়া। ঠোঁটের কোণ থেকে উঁকি দেওয়া একচিলতে হাসি নিয়ে উত্তর দিলেন মানস, “I guess I was just recollecting some thoughts!”

8 comments:

  1. নিপুন একটি লেখা। দুই প্রজন্মের দুই উজ্জ্বল উত্তরাধিকার , কী সুচারূ ভাবে টাইম জাম্প করেছে। সিমলেস গদ্য। খুব ভাল লাগল

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ জানবেন পার্থ দা, বাবাকে নিয়ে লেখা বরাবরই চ্যালেঞ্জিং আর অসম্ভব আবেগতাড়িত হয়ে লেখা হয়. কিন্তু কোথাও একটা নিজেকে দূরে রেখেও লিখতে হয়। আমি শুধু চেষ্টা করি .

      Delete
  2. মানস চক্রবর্তী বাঙালী তথা এই উপমহাদেশের এক গর্বের ধন যা হারায়নি একফোঁটা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি আপনার লেখার ভক্ত চিরকাল। ধন্যবাদ জয়ন্ত দা।

      Delete
  3. মানস চক্রবর্তী বাঙালী তথা এই উপমহাদেশের এক গর্বের ধন যা হারায়নি একফোঁটা।

    ReplyDelete
  4. কী আর বলি ! তোর লেখা পড়ি আর মনে হয় কেন যে তোদের সময়ে জন্মাইনি । আহা, প্রণয় নিবেদন করার মতন রচনা ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. মলয়দা আপনি যেভাবে দিল খুলে উৎসাহ দেন খুব কম কৃতি মানুষ তা পারে। খুব ভালো থাকবেন।

      Delete
  5. অন্তর ছুঁঁয়ে গেল।

    ReplyDelete