২০১২-র গোড়ার দিকে এক সকালে, ৫০ বছরে পা দেয়ার আগেই, আচমকা বন্ধ হয়ে গেল জয়দেব
বসুর ইহজীবনের হৃৎস্পন্দন। কিন্তু জয়দেব জানতেন ‘মৃত্যু বিরতি মাত্র। দুখানি কোয়ান্টামধ্যে আপাতশূন্যতা’। ২০১৩-র গোড়ায় তাই আমরা পেলাম তাঁর
নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা ২০০৬-২০১২’। একটু খেয়াল করলে দেখব, কালচিহ্নিত এই বইয়ের মাত্র ২-৩টি ব্যতিক্রম বাদ
দিলে, মূলত ২০০৭ থেকে ২০১১ – এই ৫ বছরের মধ্যে কবিতাগুলো লেখা। বইয়ের সূচনাকথায় শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন যে
কীভাবে সম্ভব হয়ে উঠল এই বই, কীভাবে সাজানো হল।
বইটি ৩টি ভাগে সাজানো। প্রথমভাগের লেখাগুলিতে পাই বামপন্থায় বিশ্বাসী, সি পি আই (এম)-এর দলীয় কর্মী এক জয়দেবকে, যিনি
একইসঙ্গে তীব্র সমালোচনা করেন তাঁর দলীয় পন্থার, অথচ সেই দলকে ভালোওবাসেন
তীব্রভাবে, যেখানে ফুটে ওঠে মূলত তাঁর সামাজিক মুখ। এখান থেকে যাত্রা শুরু করে
বইয়ের শেষ তথা তৃতীয়ভাগে এসে পৌঁছাই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে, সেখানে প্রধান
হয়ে ওঠে তাঁর ব্যক্তিমুখ। আর এই সামাজিক থেকে ব্যক্তিগতয় পৌঁছনোর জন্য তাদের মধ্যে
সেতুবন্ধের মতো কাজ করে দ্বিতীয় অংশটি, যেখানে এই দুই মুখ এসে মিলে যায়।
জয়দেব টের পাচ্ছিলেন – ‘বিপ্লবীরা নেতা হবে এবং নেতারা মানুষ হতে চাইবে না কোনওদিন!’ বুঝতে পারছিলেন – চারিদিকের এই ‘পরিব্যাপ্ত পল্লবগ্রাহী মিডিওক্রিটি,
স্বার্থপর বচনপ্রিয় মিডিওক্রিটির চাবুক চোখে দেখতে পাওয়া যায় না’। এই মিডিওক্রিটির অংশ তো আমরাই। ‘আমরা যারা কাজ করি না, বিপ্লব কপচাই’, ‘আমরা যারা নিজের, শুধু নিজেরটাকেই চাই’। তাই আমরা সময়-সুযোগমতো ভোল পাল্টে
ফেলি। আজ ‘সেই আমরা সবুজ আবির, রানির এঁটো
চাখছি, / সেই আমরা বনসাই, ফের শিকড় গেড়েই থাকছি’। কিন্তু মানুষের মনের সঙ্গে যোগ হারিয়ে ফেলায় এই
পরিবর্তনের আভাস পাননি বিপ্লবী থেকে শুধুই নেতা হয়ে ওঠা মানুষেরা। শুধুই ‘ঘরে তোর ভোটার আছে কয়জনা’-র হিসেব কষতে গিয়ে তাঁরা বুঝতেই
পারেননি যে ‘কাল মিছিলে হাঁটল যারা / ভাবছ আজকে
দেবে তারা; / সাঁই হাসিছেন, এই তো লীলা / হাঁটছি কিন্তু দিচ্ছি না’। কিন্তু দলের এসব ত্রুটিকে
নির্মমভাবে আক্রমণ করা সত্ত্বেও জয়দেব
নির্ভীকভাবে বলতে পারেন ‘হ্যাঁ, আমি তো সিপিএম-টাই করি। / খিস্তি করো, কে কাকে আটকায়? / কিন্তু যাঁরা ‘শ্রদ্ধেয়’, সেই তাঁরা কি যান না? / ‘বকুলবাগান রোডে’?’ বলতে পারেন – ‘আমি উড়তেছি লাল-ঝাণ্ডায়,
/ আমার মন-ভোমরা বসছে সেখানে...’। আর ঠিক এখানেই, এই পরিব্যাপ্ত ধান্দা আর ভণ্ডামির সময়েও নিজের রাজনৈতিক সততা
দিয়েই, কিস্তিমাৎ করে যান তিনি।
দীর্ঘকবিতায় বিশেষ দক্ষতা ছিল জয়দেবের। এই বইতেও ‘জপেন-দা জপেন যা’-১ বা ‘দিন-ই-এলাহি’ বা ‘প্ল্যানচেট’-এর মতো কবিতায় পাই এমন এক দার্শনিক
প্রস্থানবিন্দু, যা একই সময়গ্রন্থির ভিতর বেঁধে রাখে সমসময় আর ইতিহাসকে, অতল
নিরাশার সঙ্গে বেঁধে রাখে আশার বিদ্যুল্লতা, মনোলগ বা কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে তৈরি
করে তোলে এমন এক ডিসকোর্স, যা আমাদের ক্ষতবিক্ষত করে, ঠেলে দেয় আত্মানুসন্ধানের
গহন অরণ্যে। ক্রমে ক্রমে জয়দেব নিজেও পেরিয়ে আসেন সেই অরণ্য। উত্তীর্ণ হন এমন এক
বোধে, ক্ষতচিহ্নহীন আর মাল্যবান যেখানে সময়।
কিন্তু ব্যক্তিজীবনের নানা হাহাকার, বিশেষত সন্তানের প্রতি অমোঘ টান অথচ তার
সঙ্গহীনতা ভিতরে ভিতরে ফালাফালা করে দিয়েছিল জয়দেবকে। তাই তাঁর কলম লেখে – ‘আমার কোনো কথা নেই, আমার
কোনো ভাষা নেই / শুধু জুরা; / আমার কোনো তৃষা নেই, আমার বিবমিষা নেই, / শুধু জুরা’। আর এই লেখা যখন শেষ হয় ‘আমার আর কেউ নেই, জুরা-র জন্য কেউ
নেই, / যদি আমি...’ – এভাবে, তখন আলোচনার সমস্ত যুক্তি ফুরিয়ে গিয়ে, চোখের কোণে শুধু জেগে ওঠে
ফোঁটা ফোঁটা রক্তবিন্দু। জয়দেব সেইজন্যই বড় কবি যে – তিনি জানতেন কীভাবে ওই রক্ত আর অশ্রুকে শব্দে অনুবাদ করতে
হয়। আর তাই বইয়ের শেষ কবিতায় এসে আর্তনাদের মতো বেজে ওঠে তাঁর স্বর – ‘লেখা আমার মা, / আমায়
ছেড়ে যেন তুমি কোথাও যেও না। / এই যে এত আলস্য আর নিজেকে এত ঘৃণা, / ঘোষিত
নির্বিবেক থেকে অমান-দক্ষিণা, / এ-সব থেকে নিষ্ক্রমণের কোথাও কোনো ভূমি / থাকলে
পরে সেই মাটিতে পৌঁছে দিও তুমি’। আর ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে – ‘মা কি আমি, আমিই তবে মা? / আমাকে ছেড়ে আমি যেন কোথাও যাই না’।
কবিতা ২০০৬-১২
জয়দেব বসু
সপ্তর্ষি প্রকাশন
৭৫ টাকা
জয়দেব বসু
সপ্তর্ষি প্রকাশন
৭৫ টাকা
্পড়ার ইচ্ছে জাগাল
ReplyDelete