ক্লোরোfeel-এর পাতা

Sunday, 22 April 2018

গোড়ার কথা - যে মৃত্যু নিজের হাতে : মিতুল দত্ত

মুখেচোখে কথা নিয়ে এই পৃথিবীতে বেড়াতে আসে যারা, কুটনো কুটতে আসে, তাদের একজন ছিল আমার দিদা। সেই দিদা রোগে পড়ল। দিনে ছ'ঘন্টা রেয়াজ তখন আমার। আর রাত্তিরে খাওয়াটাওয়া সেরে, দরজায় ছিটকিনি দিয়ে একঘন্টা বিস্তার প্র্যাকটিস। সেই একঘন্টার ঘড়িধরা টাইমের মধ্যে ঢুকে পড়তে চাইত দিদা। 'ম্লান আলোকে ফুটলি কেন গোলোকচাঁপার ফুল' গেয়ে শোনাবার আব্দার নিয়ে। বলত, 'নানালোকের পুঁটলি'টা একবার গা না টিংকু। মাঝেসাঝে খুলতাম ছিটকিনি। গেয়ে শোনাতামও। মেজাজ বিগড়ে থাকলে খুলতাম না। বলতাম, যাও তো। সেদিনও খুলিনি। দিদা বারবার বলছিল, খোল না টিংকু। গানটা শুনেই চলে যাব। মাকালীর দিব্যি। দরবারী নিয়ে পড়েছি তখন। গলায় জোয়ারি আনার জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছি। খেঁকিয়ে উঠেছিলাম। যাও তো। পরদিন সকালে দিদা চলে গেল। একদম। ব্লাড ইউরিয়া ছিল। তিনশো সাড়ে-তিনশো প্রেশার। বছরে তিনবার হসপিটাল হত। যমে-মানুষে হত। দিদা মরে যাবার পর তোশকের তলা থেকে এত এত শুকনো পানপাতা বেরিয়েছিল। পরে অনেক ভেবেছি, বছর বছর মরতে মরতে ফিরে আসা দিদা কি তবে ইচ্ছেমৃত্যু বেছে নিয়েছিল? আদরের নাতনির মুখঝামটা নিতে পারেনি সেদিন?

দিদা মারা যাওয়ার আগের রাতটাকে যদি রিওয়াইন্ড করা যেত? তাপস মরে যাওয়ার আগের কয়েকটা ঘন্টা? আমার অনলাইন অ্যালবামের পেজ লাইক করে, চারঘন্টা পরে মরে গেল তাপস। মই উঠিয়েছিল দোতলায়। ছেলেকে এসএমএস করেছিল, কাল তুমি অনেক বড় হয়ে যাবে (এরকমই একটা জঘন্য কিছু)। আমি তখন জেগে। ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি ফেসবুকে। ভোর চারটে অব্দি কবিয়ালের চ্যাটরুমে মহাভারত লিখছি দুজনে। আর তার মধ্যেই তাপস মই থেকে সরিয়ে নিচ্ছে পা। শেষবারের মতো কেঁপে উঠে স্থির হয়ে যাচ্ছে। একদম। মাসখানেক আগে ফোন এসেছিল তাপসের। কবে কলকাতায় আসবি বল তো। অনেক কথা আছে। তারও বছর কয়েক আগে, এরকম আরেকটা ফোন। প্রমোদদা। কবি প্রমোদ বসু। একদিন ব্যান্ডেল যাব মিতুল। কথা আছে অনেক। তারপরই আনন্দবাজারের সেই খবরটা। আত্মঘাতী প্রৌঢ়। না, কবি না। শুধু প্রৌঢ়। আনন্দবাজারে চাকরি করতেন প্রমোদদা। একটা সেন্টেন্সও খরচা নয় সেই খাতে। 

কী ছিল সেই অনেক কথা? জানা হয়ে উঠল না আর। অনেক অনেক কথা নিয়ে প্রমোদদা, তাপসরা ভাগিরথীর জলে মিশে গেছে। যাকে বলে হুগলী নদী। ভালোনাম যার মাগঙ্গা। মিশে গেছে সুমিতা। মায়া টেনেছিল ওকে। মায়া অ্যাঞ্জেলো। বালি ব্রীজ থেকে খসে পড়েছে টুপ করে। নীচে কলুষনাশিনী। ঘরে বাপ-মা মরা একফোঁটা মেয়ে। মিশে গেছে অমিতেশদাও। ডুবে গেছে নীলাচলের অতলান্তে। অনেক গল্প বাংলাবাজারে উড়েছে সেসময়। ওটা কি ইচ্ছেমৃত্যু ছিল?

ইচ্ছেমৃত্যুর অধিকার নিয়ে লড়াই হচ্ছে। হাইকোর্ট সুপ্রীমকোর্ট হচ্ছে। গুগল জানিয়ে দিচ্ছে কোন কোন দেশ অলরেডি পেয়ে গেছে গ্রিন সিগন্যাল। আমাদের দেশের নাম সেই লিস্টে দেখে, তা একটু এলিট এলিটও লাগছে আর কী। আত্মহত্যা আর ইচ্ছেমৃত্যু, একই জীবনের শেষের কবিতা। অলমোস্ট স্বরচিত। পদ্ধতিটাই যা একটু আলাদারকম। যদিও আত্মহত্যা সিগন্যাল পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। মহাপাপ বলে দাগিয়ে দিয়েছে যে শাস্ত্র। ওদিকে টিমটিম করতে করতে টিঁকে আছে, বলা ভালো বেঁচে মরে আছে যে, গুজারিশ সিনেমার হৃত্বিক রোশনের মতো, সে চাইলে ইচ্ছেমৃত্যুর টিকিট কাটতেই পারে। এ তো শিকলি কেটে, খাঁচার দরজা ভেঙে, প্রাণপাখিটি উড়িয়ে দেবার মতোই। যদিও একটা বিটকেল প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে। যন্ত্রণাসর্বস্ব শরীর, সে কীভাবে জানাতে পারে তার ইচ্ছের কথা? হৃত্বিক অবশ্য হুইলচেয়ারে ঘুরে ঘুরে রেডিয়োয় টকশো করা থেকে নিজের ইউথানেশিয়ার জন্য চেঁচানো থেকে মরার আগে বিয়ে অব্দি সবই করেছে। সিনেমার বাস্তব আর জীবনের বাস্তব এক হলে কেমন হত? শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে মনে পড়ে। তখন ক্যান্সার। শেষদিকে। বিছানায় মিশে যাওয়া শরীর। শরীরের সমস্ত যন্ত্রণা চোখে। যে চোখ ভোলা যায় না। হৃত্বিক রোশনের হুইলচেয়ারে শ্যামলদাকে, কুমুদজেঠু, পোলারের বাবা, সুরজিতের দিদি, দীপান্বিতার মা, সিধুদার শ্বশুরকে যদি বসিয়ে দিতে পারতাম। পারত ওরা? চাইতে পারত মুক্তি? গলা ফাটিয়ে? আমরা ওদের মুক্তি দিতে পারতাম? এও মায়া। মায়া অ্যাঞ্জেলো না। মায়ার সংসার। সন্ধ্যারাণী। সর্বস্ব খুইয়েও প্রিয়জনের শরীরটুকু আঁকড়ে থাকা। শরীরের মায়া বড় মায়া। দিদা বলত। যদ্দিন মানুষটা আছে, থাক। আহা।

চোখের সামনে একটা মানুষকে দেখেছিলাম। আরেকজনের অসুখ শরীরে নিয়ে চলে যেতে। এত প্রমিনেন্ট ইচ্ছেমৃত্যু আর দেখিনি। মাঝেমধ্যেই আসত বাড়িতে। রাত্রিবেলা থেকে যেত। তাকে পাশবালিশ করে ঘুমোতাম। একদিন, ভোর চারটে তখন, দেখি, উঠে বসে মাথায় হাত বোলাচ্ছে আমার। বলল, ভোরবেলা চলে যাব, তুই তখন ঘুমোবি, দেখা হবে না। সেই শেষ দেখা। উভয়ত। এরপর ড্রিমল্যান্ড নার্সিংহোমে। কোমায়। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, যেও না। চলে গেল। যাইনি আশ্রমে। ঘরের আলো নিভিয়ে, চোখ বন্ধ করে, ভুলে যাওয়া মন্ত্র মনে করার চেষ্টা করছি। আলো হয়ে উঠল ঘর। পরিষ্কার বুঝলাম। যে মৃত্যু বিচ্ছেদ নয়, যে জীবন ছেড়ে যায় না, তার আলো জ্বলে উঠল আমার ঘরে।

আমি চোখ খুললাম না আর।

মৃত্যু বনাম অধিকার : বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়

ছবি : Dr. S. Ali Wasif
তার কোনো অসুখ নেই। তার একটাই অসুখ। সে পুরুষদের আর সহ‌্য করতে পারছে না। গত ছমাস যাবৎ আরও অসহ্য লাগছে তার। সব পুরুষকে। দলমতস্থানকাল নির্বিশেষে। গত সপ্তাহের পর তা চরমে উঠেছে।

সে এক্ষুনি চলে যেতে চায়। এমন একটা উপমহাদেশে যেখানে বাতাসে বীর্যের গন্ধ নেই। যেখানে এমন পুরুষ নেই যার কার্যকর লিঙ্গ আছে। বাবা নেই, দাদা নেই, ভাই নেই, দাদু নেই, কাকু নেই, মামু নেই, মামাশ্বশুর নেই। প্রেমিক নেই। বর নেই। প্রিয়বন্ধু নেই। কিন্তু সেই ভালো জায়গাটা কোথায়? সুবোধ সরকার বলতে পারেননি। বললেন, বইয়ে আছে দেখে নিও। জয় গোস্বামী বললেন, জানি আমার কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছ। কবিরা এত মিথ্যুক হয়? ছিঃ ছিঃ। নির্বাণ বলেছিল, তুই তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখা। এটা তোর মনের অসুখ। গত তিনদিনে সে ডিপি কালো করে নির্বাণকে ব্লক করে দিয়েছে। নির্বাণ ওর হাত ধরেছে। মানে, ধরেছিল। গুড টাচ। কাঁধে হাত রেখেছিল। হাত কাঁধ থেকে নীচে নামেনি। ঘটনা হল নির্বাণও পুরুষ। একটা নির্জন দ্বীপে নির্বাণের গোপন অঙ্গটিকে ও আর বিশ্বাস করে না। এখন। কারণ এখন ও অ্যালাউ করতে পারে শুধু লিঙ্গহীন, অণ্ডহীন, লিউপ্রাইড দিয়ে খোজানো মানুষকে। নপুংসক, উত্থানরহিত, অপারগ না-পুরুষকে। শিশুপুরুষ ও ধ্বজাহীন বৃদ্ধকে। ব্যাস। কমা আর ফুলস্টপ।

বেণুমাসির বয়েস সিক্সটি প্লাস। তাকে একলা পেয়ে বলপ্রয়োগ করল তারই চেনা ইলেকট্রিশিয়ান। কালো, পাঁচ ফুট আট, বয়েস আঠাশ। আরতির নাতনির বয়েস সাত বছর। তাকে বিলা করল তার ফোকলা মেসোদাদু। বয়েস আটষট্টি। পকসো-র নকশা দিয়ে কিছু হবে না। আইন আদালত উকিল দিয়ে হবে না। চাই গ্যাসপুতুল। পুতুলের গোপন অঙ্গে মৃত্যুগ্যাস ভরা আছে। পুতুলকে যা করার কর, তারপর ফোট। গ্যাসপুতুলের দাম আছে। তবে রাষ্ট্র ভেবে দেখতে পারে। ধর্ষণ করলেই গ্যাসপুতুলের সঙ্গে এক রাত। লাইভ দেখাবে। মহাউত্থানের পর মহাপ্রস্থান পর্ব। যেমন পাণ্ডুর হয়েছিল মাদ্রীর সঙ্গে। কিন্তু পাণ্ডুর হার্টে ফুটো ছিল আর বারণও ছিল। সেই মুহূর্তে মাদ্রী শোনেনি সেই বারণ। ফলে যা হবার তাই হল। যাই হোক, এটাই শাস্তি হোক এখন। খরচাপাতি দেবে ভোটে জেতার সরকার।

ব্যাপারটার বিহিত করতে না পারলে মেয়ে হিসেবে সে আর বাঁচবে না। কারণ সে আর বাঁচতে চায় না। আত্মহত্যা নয়। নিষ্কৃতিমৃত্যু নয়। ইচ্ছামৃত্যু। প্রতিবাদমৃত্যু। সে মরলে তার চোখদুটো পাবে(না কোনো জন্মান্ধ মেয়ে নয়), যার চোখ উপড়ে ফেলেছে কোনো পুরুষের নগ্ন নৃশংস হাত। তার লিভার, কিডনি, হার্ট, ত্বক, সব সে দান করে যাবে আহত অবসৃত আক্রান্ত মেয়েদের। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমন একজন পুরুষ যে কবিতা লেখে। তার কাছ থেকেও চিরবিদায়। সে-ই তাকে আইডিয়াটা দিয়েছে। কিন্তু ওই যে, পুরুষ তো। তাই সরি, এবং গুডবাই।

শুনলাম, ঝাঁকে ঝাঁকে শ্রমিক লাল পিঁপড়েরা শরীর ফুলিয়ে পেটে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বের করতে পারে গন্ধবিষ। আক্রমণ এলে। এইভাবে তারা রানি পিঁপড়েকে বাঁচায় আক্রমণকারীর হাত থেকে। অর্থাৎ অ্যাক্টিভ মাস সুইসাইড। কাগজে ফলাও করে বেরিয়েছে। সে নিজেকে শ্রমিক পিঁপড়ে ভাবে। তার আত্মবলিদানে যদি টনক নড়ে কারও। তারপর দলে দলে গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে যদি নিরস্ত করা যায় শত্রুদের। যদি শিশু ও বৃদ্ধাদের দেওয়া যায় ধর্ষণহীন সমাজ। যদি কিশোরী, তরুণী, যুবতীরা বেছে নিতে পারে আত্মরক্ষার অধিকার। ভাবার সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় জেগে ওঠে টারবাইন। পেটে গ্যাসবেলুন। সে ভাবে, যদি ফের আকাশে ওড়ে কাগজের লালনীল ঘুড়ি। যদি হাঁটু মুড়ে মেয়েদের কাছে ক্ষমা চান রাষ্ট্রনায়ক, কবি, অভিনেতা, সফল ও ব্যর্থ পুরুষেরা। যদিও ইউটোপিয়া, যদি এমন দিন আসে, মেয়েরা বেছে নিতে পারে উত্তরাধিকারের সাম্য অধিকার? 

জন্মতারিখ : রাণা রায়চৌধুরী

ছবি : David Kiraly
আগে আমার একটা স্বভাব ছিল যে কোনো বাড়িতে গেলে লক্ষ করা যে, সে বাড়িতে সিলিঙে ফ্যান ঝুলছে কি না তা দেখা। চেয়ারে বসার আগে দেখে নিতাম ওপরে ফ্যান ও ফ্যানের ওপরে সিলিঙে আঙটা লাগানো আছে কিনা।

মনে সবসময় ঘুরত, কবিতার মতো একটা দড়ি ঝুলে আছে কিনা, সিলিং থেকে বা আকাশ থেকে। দড়িটা দুলছে। দুলছে। দড়ির ডগায় একটা বড় মাথা ঢুকে যাওয়ার মতো ফাঁস। আমার ক্ষুদিরামের কথা মনে পড়ে। আমার ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় নাম্নি এক সামান্য যুবকের কথা মনে পড়ে। আর মনে পড়ে নাটা মল্লিকের কথা।
নাটা মল্লিক-এর নিশ্চয় ভিতরে গান ছিল। নাটা মল্লিকেরও ভিতরে নিশ্চয় একটা মায়ামমতাময় ফুলের বাগান ছিল। কিন্তু তাকে ধনঞ্জয় নামক ওই নিরীহ দুবলা ছেলেটার গলায় ফাঁসের দড়ি পরাতে হয়েছিল চাকরির তাগিদে। হায় চাকরি! এক্ষেত্রে ধনঞ্জয়ের মৃত্যুটা ইচ্ছামৃত্যু নয়। বেচারা ফাঁসে ফেঁসে গেছিল। আমার ধারণা, ধনঞ্জয়ের ফাঁসির দিনের আগে তার গ্রামের বাড়িতে তার বউকে নির্ঘাত তাবিজ-কবজ পরানো হয়েছিল, যাতে স্বামীর ওই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ওই নিরীহ মেয়েটির জীবনে না আসে। কিন্তু মহামান্য আদালত বলে আমাদের দেশে একটা কথা আছে।

আমি সেই ফাঁসির দিনে বাড়িতে বসে ভাবছিলাম, গলায় দড়ি পরানো হল, নাটা মল্লিক মা কালীকে প্রণাম করে দড়ি টেনে দিল। ধনঞ্জয়ের গলায় অমায়িক দড়ি এঁটে বসছে, ধনঞ্জয় ধনঞ্জয়, আমি আর ভাবতে পারিনা। অথচ ছেলেটিকে তার মা ছোটবেলায় বুকের দুধ দিয়েছিল পরম মমতায়। ধনঞ্জয় ছোটবেলায় সাঁতার কেটেছিল পুকুরে ঐ পাড়ে যাবে বলে। ঐ ওই পাড়ে তার আর যাওয়া হল না। গেল, কিন্তু গানের মতো নয়, দখিনা বাতাসের মতো নয়।
ধনঞ্জয়ের জিভ বেরিয়ে এসেছিল। আমি মনে মনে ভাবি।

আমার ভয় করে। তবু আমি এখনও সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাই, দেখি ফ্যানের স্পিড আছে কিনা। আর ছাদ দেওয়ার সময় রাজমিস্ত্রি একটা আংটা রেখেছিল কি না ফ্যান ঝোলানোর জন্য, কারণ রাজমিস্ত্রি জানে যে, বাবুর খুব গরম।

আর ক্ষুদিরামেরটা? ইচ্ছামৃত্যু? বোধহয় না। ক্ষুদিরামেরও বাঁচার ইচ্ছা ছিল। সেও ফেঁসে গেছিল। তফাত একটাই, ধনঞ্জয়ের দড়িটা ছিল দেশি, আর ক্ষুদিরামের দড়িটা ছিল বিদেশি। কিন্তু দুজনেরই বাঁচার ইচ্ছা ছিল। বাঁচা, বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকতে সবাই চায়। এই সুন্দর পৃথিবীর আলোবাতাস, মায়ের দীর্ঘ স্নেহ, প্রেমিকার অন্ত্যমিল দেওয়া চুম্বন, এই এই সবই মানুষের বাঁচার ইচ্ছাকে তীব্র করে।

কিন্তু হঠাৎ ঝড় উঠল। নিরীহ পথিকের ঘাড়ে, নিরীহ প্রাচীন গাছ ভেঙে পড়ল। প্রাচীন গাছ তার দেহ দিয়ে পিষে দিল ঐ অজানা পথচারীকে। বাড়ির লোক কাঁদল। শ্মশানযাত্রীর দল গামছা কাঁধে এল সৎকারের জন্য। কিন্তু যে মানুষটি, প্রবীণ বৃক্ষের নীচে চাপা পড়ে মরল, সে তো এই মৃত্যু চায়নি! অর্থাৎ ইচ্ছার বিরুদ্ধে মৃত্যু। বা যে তরুণ জওয়ান কাশ্মীর সীমান্তে জঙ্গীর রকেট হানায় প্রাণ দিল, সেও তো চায়নি এই আচমকা মৃত্যু। কারণ বাড়িতে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে সে রেখে এসেছে, এই তো গতমাসে। স্ত্রী নামক রমণীটির ওষ্ঠও সে তখনও ভালো করে স্পর্শ করেনি। বলেছিল, পরের ছুটিতে এসে সে স্ত্রীর সব গান, সব সুরকে ছোঁবে, স্পর্শ করবে, হানিমুনে যাবে চাঁদে। এই তো সামান্য পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মেজরের নির্দেশে সে প্রায় নীল আকাশের কাছাকাছি যে পাহাড়, সেখানে সে যায় আধুনিক অস্ত্র হাতে এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই সীমান্তের ওপার থেকে আসা আগ্নেয়াস্ত্রে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, এটা কী ইচ্ছামৃত্যু? তা তো নয়! কিন্তু জওয়ানের, দেশের কবিরা তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিল। কেউ অন্ত্যমিলে, কেউ ইনিয়েবিনিয়ে, কেউ পয়ারে, আবার কেউ বা ‘বলো বীর, বলো উন্নত মম শির’ এই ঢঙে সাদা পৃষ্ঠার সর্বনাশ করে, বউকে বলেছিল, “নিজে বাঁচলে বাপের নাম, কী বলো?”
কিন্তু সেই তরুণ জওয়ান বিউগিলে, আবেগমাখা জাতীয় সঙ্গীতের সুরে চিরবিদায় নিয়েছিল তো?
কিন্তু তা কখনোই নিজের ইচ্ছায় ছিল না।

কিন্তু আমি ভীতুর ডিম, সব ব্যাপারেই মনে হয় হেরে যাচ্ছি, আর বারবার তাকাচ্ছি ঐ সিলিং ফ্যানের দিকে।
ইচ্ছামৃত্যু বা সুইসাইড কারোর কারোর কাছে বিলসিতা। হয়ত আমার কাছেও। আমি বরাবর স্যুইসাইডকে মনের মধ্যে নিয়ে খেলেছি, আত্মহত্যার সঙ্গে মৈথুন করেছি, যৌনতাও করেছি। স্যুইসাইড বা ইচ্ছামৃত্যু যেন আমার কেনা জীবন বা মনের অর্ধাঙ্গিনী। খুব দুঃখ বা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যখন যেতাম তখনও আমি সিলিং ফ্যানের দিকেই তাকাতাম। কেন তাকাতাম জানি না। হয়তো সিলিং ফ্যানে আমার অধরা শান্তি আছে, বা আমার না পাওয়া সেই কবিতার পঙক্তিটি। কিন্তু তাকাতাম। এখনও চিৎ হয়ে শুয়ে তাকাই, হয়ত চিৎ বা চিদানন্দের সন্ধান করি। তবে আত্মহত্যার মধ্য কোনো চিদানন্দের চিহ্ন নেই, নেই কোনো ফুলের বাগানও।

বিবেকানন্দ দেবী কালীর কাছে অর্থ, চাকরি, এইসব চাইতে গিয়ে, সংসারের অনটনের কথা বলতে গিয়ে, বলে বসলেন, ‘জ্ঞান দাও, বৈরাগ্য দাও, ভক্তি দাও আর ত্যাগ দাও’।
আমার এ-সবের কোনোটাই নেই। পুরোটাই, আমি আমিতে ভরা। অহংবোধ, লোভ, ক্রোধ, চাওয়াপাওয়ার ইচ্ছা, যৌনখিদে, লালসা এইসব আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফলত, যখন রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ আমাকে বললেন, ‘এত বয়স হল বিয়ে-থা যখন করেননি, মাঝে মাঝে কথামৃতও পড়েন, তাহলে আর দেরি কেন? চলে আসুন মিশনে’।
মানে মিশনের শ্যামল মহারাজ আমাকে গেরুয়া পরতে বলছেন। সন্ন্যাসী।
আমি উত্তরে বললাম, ‘মহারাজ, আপনাদের এত ডিসিপ্লিন যা প্রায় সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার মতো মানতে হয়, এ আমি পারব না। আর তাছাড়া আমার বাড়িতে বিবাহবিচ্ছিন্না তরুণী বোন, তার দুটি শিশু, বৃদ্ধ পিতা, ওদের দেখবে কে?’
শ্যামল মহারাজ অন্য মঠ-মিশনের সন্ন্যাসীদের মতোই কিছু দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক কথা বলেছিলেন। মানে দলে এসো, সেবা করো। আমার মনে তখন পুরোমাত্রায় যৌন-অন্ত্যমিল খেলা করছে। সঙ্গে মায়া। প্রেম। বাবা বোন আর ঐ শিশুদুটির নিরীহ চাহনি। রোববারের মাংস। পানু ছবি। জীবনানন্দের কবিতা। অলস দুপুরে কোকিলের ডাক।

আমি মিশনের মহারাজকে ‘না’ করে দিলাম।

যদি ‘হ্যাঁ’ বলতাম, আজ মনে হয় তবে আমার ইচ্ছামৃত্যু হতো।

রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, কামিনীকাঞ্চনে মন না দিতে। আমার আবার কামিনীকাঞ্চনের প্রতি প্রবল টান থেকেই ভিতরে মায়া জন্মায়। ভালবাসা জন্মায়। আদর জন্মায়। বাড়ি ফেরার টান জন্মায়। আমাদের বাড়িতে কত পাখি আসে, কত ছোট ছোট ফুলগাছ। এদের ছেড়ে আমি সারা বিশ্বের পাখিদের গাছেদের ভালবাসতে পারব না। আমি ছোট, ছোটই থাকতে চাই। বৃহৎ, সে মহামানবের কাজ। সন্ন্যাসী হলে, বা বাড়ি থেকে পলাতক বিপ্লবী হলে, এঁরা দশের। আমি একার, আমি ছয়-সাত জনের। ফলত, নিজের গণ্ডিকে ভালবাসি। নিজের গণ্ডিকে অভিমান করি। নিজের গণ্ডির মধ্যে দুঃখ জমাই। চোখের জল ফেলি। আত্মহত্যার কথা মাথায় আসে। বন্ধুর পুরনো লেখা পোস্টকার্ডের চিঠি পড়ে, ইচ্ছামৃত্যুর চিন্তা মাথা থেকে চলে যায়। গুনগুন করে গান গেয়ে উঠি। বড়ো ভালবাসতে ইচ্ছে করে সবাইকে। সব্বাইকে। নিজেকে জড়িয়ে আদর করি। নিজেকে ভাল না বাসলে আর সবাইকে ভালবাসব কী করে?

আমি আরও জোরে গান গেয়ে উঠি। চিৎকার করে গাই। বিশ্ব-ভুবনকে শুনিয়ে শুনিয়ে হেঁড়ে গলায় গাই।

সিলিঙে অদৃশ্য দড়ি ঝোলে। আমি পাত্তা দিই না। আমি করতাল বাজিয়ে কীর্তন শুরু করি। বলি, আজ খিচুড়ি হোক। সঙ্গে ডিমভাজা। সঙ্গে আনন্দ। সঙ্গে আমার এই নিজস্ব অ্যাড্রেস।

ছেড়ে যেতে পারব না। বিছানায় কোমায় চলে গিয়েও পারব না বলতে, ‘ডাক্তারবাবু ইঞ্জেকশন দিয়ে ইতি টেনে দিন’। আমি পারব না। বড্ড বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে।

পুজোর জামাকাপড় কেনা এখনও যে বাকি। কত লোক টাকা পাবে সেগুলো শোধ করতে হবে না? এখনও রবীন্দ্রনাথ পড়া, পুরোটা হয়নি। এখনো বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’ বাকি। এখনো কত তরুণ কবির, কত কবিতা বাকি।

আর বাকি আনন্দ। আমি এখনও জীবনের সব আনন্দকে পাইনি। আনন্দ আসে, ধরতে গেলে দূরে চলে যায়। পুনরাধুনিক কবিতার দিকে সে চলে যায়।

আমি অপেক্ষা করি। অপেক্ষা। তিতির তুই কোথায়? শিয়ালদায়? ট্রেনের গণ্ডগোল? দুশ্চিন্তা করতে ভালো লাগে। এই দুশ্চিন্তা নতুন সুরের মতন।

তবু অদৃশ্য দড়ি ঝোলে সিলিঙে। আমি তারে পারিনা এড়াতে। 

কেন এই অাত্মহত্যা : সমরজিৎ সিংহ

ছবি : Vadim Filimonov
আত্মহত্যা একটা প্রক্রিয়া, যা আত্মহত্যাকারীকে সকল গ্লানি থেকে মুক্তি দিতে পারে। আত্মহত্যা এক নীরব প্রতিবাদও। যে প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়নি নানা কারণে, আত্মহত্যা করে, সে প্রতিবাদ করা যায়।

এরকমই ভাবতাম আমি। এখনও যে ভাবি না, তা নয়, ভাবি। আমি, নিজেই, চার চারবার আত্মহত্যা করেছি। আমার এই জীবন মূলত এক আত্মহত্যাকারীর, যে আপোষ করতে পারেনি অনেক কিছুর সঙ্গে, অনেকের সঙ্গে।

আমার প্রথম আত্মহত্যা ছিল বাবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। আমার বাবা আমাকে, আমার মা-কে ভালোবাসতেন না। এখন বুঝি, উপলব্ধি করি, ভালো না বাসাও এক অধিকার। তখন বুঝতাম না। কতই বা বয়স হবে আমার? ক্লাস ফাইভ। পুজোর সময়। আমাদের বাড়িতে প্রতিবছর দুর্গাপুজো হত। সে ঠাকুরদা, তস্য ঠাকুরদার আমল থেকে। পারিবারিক পুজোর মজা আলাদা। পরগণার লোক মান্যি করত। ঐ সমীহ আমার বাবার প্রচণ্ড দাপটের জন্য, না কি বংশসূত্রে, কোনো এক কালের রাজরক্ত বাবার শরীরে বইছে বলে, বুঝতে পারতাম না। মোদ্দা কথা, সবাই ভয় পেত বাবাকে। আমিও। 

মা, আমাকে নিয়ে, আলাদা থাকতেন। এখন যাকে সেপারেশন বলা হয়, সেটা মা তখনকার সময় করে দেখিয়েছিলেন। তিনি নিরক্ষর, কিন্তু স্বাধীনা। বাবাকে বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে, ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে, বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সব সম্পত্তি, স্থাবর-অস্থাবর, সব। 

বাবা প্রতারণা করেছিলেন মা-র সঙ্গে। রাজরক্ত যার শরীরে বইছে, তিনি বহুগামী হবেন, এতে কেউ কিছু মনে করত না। মা-কে বিয়ে করা, পরিত্যাগ করা, এসব, ফলে, তাকে মানে বাবাকে বিচলিত করেনি। তাছাড়া, মনিপুরী সমাজে তখন বহুবিবাহ জলভাত। 

তো বাবাকে পছন্দ করতাম না কখনও। তিনি আমার সৎ ভাইবোনদের আদর করতেন, আমাকে নয়। কষ্ট পেতাম খুব।
সেবার, পুজোর সময়, সকল ভাইবোনের জন্য বাবা আনলেন নতুন জামাকাপড়। আমার নেই। তিনি সকল ভাইদের হাতে তুলে দিলেন খেলনা পিস্তল। আমার হাতে নয়। 

রাগ হচ্ছিল খুব। মা-কে বললাম, এ কেমন বাবা আমাকে দিয়েছ তুমি? আমার জন্য কিছুই আনেননি? 

সারাদিন খেলাম না। সম্ভবত, পঞ্চমীর দিন। সন্ধেবেলা ঠিক করলাম, মরে যাব। মরে, ভূত হয়ে, বাবাকে শাস্তি দেব। শোধ নেব। 

কাকাদের গোয়ালঘর থেকে একটা দড়ি নিয়ে, অন্ধকারে, চলে গেলাম বাড়ির পেছনে, মহাদেবের থানের কাছে যে আমগাছ আছে, সেখানে। ঐ আমগাছটিই ছিল আমার বন্ধু, যার কাছে সব কথা বলতাম। যাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতাম দিনের পর দিন। 

শিবের থান পার হলেই মনু নদী। আমার আর এক সহচরী। আমগাছে উঠবার আগে, নদীর দিকে তাকালাম। মরে গেলে, তাকে আর দেখতে পারব না। খেলতে পারব না। ভাবতে ভাবতে, এগিয়ে গেলাম তার দিকে। এ সময় নদী পূর্ণযৌবনা, তার রূপ অবর্ণনীয়। কাছে গিয়ে বললাম, আর কোনোদিন দেখা হবে না আমাদের। 

কেন? কলকল তার ধ্বনি। বলল, কেন দেখা হবে না, শুনি?
আমি আজ মরে যাব। এই পৃথিবীতে আর থাকব না।
কেন? কী হয়েছে তোমার?

কতক্ষণ কথা বলেছি, জানি না। খেয়াল করিনি। হঠাৎ লক্ষ করলাম, পাড়ার সব লোক ছুটে আসছে আমার দিকে।
ঐ তো, ঐ যে...
সমরজিৎ...
কী করছ তুমি?
ঝাঁপ দেবে না, সমরজিৎ, তুমি সাঁতার জানো না, ডুবে যাবে। 

টর্চের আলো, হ্যাজাক লাইট, প্রচুর লোক। দেখলাম, মা আসছেন। বাবা আসছেন।
বললেন, ঝাঁপ দেবে না, আমি কালই, তোমাকে জামাকাপড় কিনে দেব। 

আমি কি ঝাঁপ দিচ্ছিলাম ভরা নদীতে? আমি তো, দড়ি হাতে, এসেছিলাম আমগাছের কাছে, তার ডাল থেকে ঝুলে পড়ব বলে। 

আমার প্রথম আত্মহত্যা এভাবেই বিফলে গেল। সত্যিই কি গেল? না হলে, বাবা ঐ রকম বললেন কেন? 

কিন্তু যে তরুণী বধূ, দুপুরবেলা, তার ঘরে ডেকে, আমি পৌঁছবার আগে, বাড়ির পেছনে, ছোট্ট কাঁঠাল গাছে, ঝুলে পড়েছিল, সে কী বলতে চেয়েছিল আমাকে? কী তার দুঃখ ছিল ?

মরিবার হল তার সাধ : চন্দন ঘোষ


ছবিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া
বিশ্বাস করুন আত্মহত্যা করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না আমার। কিন্তু আমাকে যে কাজটা দেওয়া হয়েছে তা তো আত্মহত্যা সংক্রান্তই! আর হাতে কলমে অভিজ্ঞতা না থাকলে কি কলম ধরা যায় মশাই?

বস্তুত জীবনে এত আত্মহত্যা আমি দেখেছি যে চোখ পচে গেছে, ঘেন্না ধরে গেছে মশাই। দু-একটা তো স্রেফ আন্দাজই করতে পারিনি আগের রাত্তিরেও। হস্টেলে সমীরণদার সঙ্গে দেখা হল চারতলার সিঁড়ির মুখে। আমি ডিনারে নামছি। ও উঠছে দিব্যি মৌরী চিবোতে চিবোতে। এক গাল হেসে বল্ল, কী হে চন্দ্রবদন। খেতে নামছ বুঝি। কী প্রশান্তি মুখে তার। সেই রাত্তিরেই সে ১০০টা বারবিচুরেট খায়। আজও জানতে পারিনি কীসে খেল তাকে। তারপর ধরুন, গীতশ্রী। সে ছিল আমার এক বোন। আগের রাতেও কত গল্প করলাম তার সঙ্গে। ভোরবেলায় চলে গেলাম কাজে। ও ঘুমোচ্ছে ভেবে ডাকিওনি, গুড মর্নিং বলিওনি। আত্মহত্যাকারী বড়ো তঞ্চক হয়। প্রবীর তার মাকে প্রায়ই বলত, বেঁচে থেকে আর কী হবে? চলো মা দুজনে একসঙ্গে আত্মহত্যা করি। বেচারা মা! বুঝতেই পারেনি কিছু। ছেলেটার মতিগতি ফেরাতে কত যে ঠাকুর-দেবতার কাছে ছুটেছে। কত যে শিকড়বাকড়, তাবিজকবজ এনেছে তার ইয়ত্তা নেই। একটা জিনিস শুধু করেনি। ডাক্তারের কাছে যায়নি কখনও। তাই একদিন মাকে না নিয়েই সে হুট করে চলে গেল। তারপর আমার রিকশাওলা ঝড়ু অধিকারী, সে তো রেললাইনে শান্ত ছেলের মতো গলা দিয়ে চাকার বাজনা শুনতে গেছিল। "নরক থেকে নরকে, নরক থেকে নরকে"। ট্রেনটা কী নিষ্ঠুর! তাকে শুধু চুমু খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

আত্মহত্যা আসলে জীবনের বিপক্ষে এক দীর্ঘ নীরব ষড়যন্ত্র। তিল তিল করে তার সলতে পাকায় মানুষ। তিল তিল করে তার সপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে থাকে মনের ভেতর। তারপর একদিন দমকা হাওয়া ঝড় হয়ে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আত্মহত্যার এক নিজস্ব দর্শন আছে। যা মানুষকে ভেতরে ভেতরে আত্মহননের সপক্ষে শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করে।

এই তো বেশ এগোচ্ছে ব্যাপারটা! হ্যাণ্ডস অন অভিজ্ঞতার আগে সিচুয়েশনটা তৈরি করতে হবে তো! আত্মহত্যার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে তো! কিন্তু কী কারণে আত্মহত্যা করা যায়? আমি তো খুঁজেই পাচ্ছি না কিছু। পরীক্ষায় ফেল করিনি, প্রেমিকা পালিয়ে যায়নি, বউ তেমন মুখঝামটা দেয় না, দুবেলা খেতে দেয়, চাকরি নট হয়ে যায়নি, লোকে তেমন হ্যাটা করে না। তবে? কোনো ওয়াজাই তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা, কোনো কারণ নেই, এটাও তো একটা কারণ হতে পারে, চাঁদু। একটা অশ্লীল রকমের প্রাচুর্যও তো কারণ হতে পারে। অন্তত জীবনবাবু তো সেকথাই বলে গেছেন। জানলার দিকে তাকাই। না কোনো উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতার কোনো পাত্তাই নেই। কিন্তু একথাও তো সত্যি যে, যে জীবন ফড়িংএর দোয়েলের, তার সঙ্গে আমার মতো মানুষের এখনও দেখা হয়নি। তাহলে? তাহলে কি করেই ফেলা যায়?

এক গাছা দড়ি আর অশ্বত্থ গাছের খোঁজ করা যাক তবে। ওদিকে ঘরের কোণে এসে দাঁড়িয়েছেন কাফকা সাহেব। ইশারায় বলছেন, এতসব আয়োজনের কী দরকার ভাই। আমাকে দেখ। আমার ছুরি লাগেনি, দড়ি লাগেনি, বারবিচুরেট লাগেনি। আমি তো আসলে আত্মহত্যাই করেছিলাম। না কি? অতি ধীর, নিশ্চিত সেই মৃত্যু। জীবনের সব দরজাগুলো একটি একটি করে বন্ধ করে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। তাকে কী বলবে তোমরা? আত্মহত্যা না ইচ্ছামৃত্যু। উত্তর দিতে পারি না। হাতের দড়ি হাতেই থেকে যায়। হাতে কলম ওঠে না। হাতে কলমে আর কিছুই করা হয়ে ওঠে না।

আত্মহনন, হননকাল - জীবন থেকে শিল্পে : পার্থপ্রতিম ঘোষ

“অভিমানে মানুষ কিংবা মানুষের মতো আর যা-কিছুর
          বুক চিরে দেখা
               আত্মহনন…”

আত্মহননের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ শুরু সুনীল গাঙ্গুলী পড়তে গিয়ে। সেই সাক্ষাতে তুলি ছিটোনো লাল ছোপ যদিও বা থেকে থাকে, সে লাল যুবা বয়েসের রঙ। সেখানে কালো রঙের ঠাঁই নেই। নেই, তার কারণ নিশ্চয়ই এ কবিতার উচ্চারণে ফুটে ওঠা এক যৌবন ছবি। যার চলনে জেগে ওঠে - মৃত্যু নয়, বরং “শহরের পিঠ তোলপাড় করা অহংকারের দ্রুত পদপাত, একখানা নদী, দু’তিনটে দেশ, কয়েকটি নারী” — আত্মহনন এখানে জীবনেরই অন্যপিঠ, উচ্ছ্বল ও রোমান্টিক। আর, অন্যপিঠে আছে লাশকাটা ঘর। পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে গেলে সেই ঘরের টেবিলে চিত হয়ে শুয়ে থাকার  সাধ হয় কারও। যদিও মশা। যদিও তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থাকা। যদিও মাছি। রক্তক্লেদ ছেড়ে রোদে উড়ে যাওয়া জীবন। তবুও জীবনানন্দীয় জীবন একগাছা দড়ি হাতে অশ্বত্থের দিকে হেঁটে যায় কেন বার বার? উত্তর নেই।
শুধু...
"নিঝুম দৈত্যের মতো রাত্রি নেমে এলে তুমি
লাফ দিয়ে পড়লে নীচে, হাইওয়ের মর্মমূলে
শূন্যতার সমাধির দেশে” (মিতুল দত্ত)

আত্মহনন, নাকি ইচ্ছামৃত্যু? কাকে ধরব বুঝে উঠতে পারিনা। কতখানি তফাত এ দুটি শব্দে? ইচ্ছামৃত্যু যদি হয় mercy killing, আত্মহনন যদি suicide, এই দুই মৃত্যুর মধ্যেই নিহিত আছে জীবন-বিযুক্ত হবার ইচ্ছে। এই ইচ্ছে জীবনের সমস্ত বায়োলজিক্যাল যুক্তির বিপরীত! মানুষ ছাড়া জীবনের আর কোনো ফর্ম আত্মহননের রাস্তায় হাঁটে কি? রহস্যময় যদিও জাটিঙ্গা গ্রামের পাখিদের অকালমৃত্যু। ঝাঁক ঝাঁক জাটিঙ্গা পাখির মৃত্যুবরণকে  আত্মহননের চশমা দিয়ে দেখেছে মানুষ অনেককাল। কিন্তু পক্ষীবিদরা বলেন, এ মৃত্যু তাদের স্বেচ্ছামৃত্যু নয়, বরং এর কারণ এক নির্মম পথভ্রান্তি। মানুষই কি তবে একক, একমাত্র স্পিসিস এই জীব-বিশ্বে, যে বার বার জীবনের স্বাভাবিক যুক্তির বিরুদ্ধে হেঁটেছে? কেন? জীবন যখন আর আনন্দ নয়, শুধুই ভার ও যন্ত্রণা, সেই যন্ত্রণা যখন বহনসীমা পেরিয়ে যাচ্ছে কোনও মানুষের কাছে, যখন তার জীবনের মানে আর লজিক মিলিয়ে  যাচ্ছে মহাশূন্যের মধ্যে, তখন হনন-ইচ্ছের উপান্তে এসে দাঁড়ায় সে। ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই ইচ্ছে হয়ত সাহায্য চায় অপর জীবনের কাছে, স্বীকৃতির কাছে, কিন্তু  আত্মহননের রূপায়ণ নিজেরই হাতে। তার অপরের স্বীকৃতির অপেক্ষা নেই, প্রয়োজনও নেই। এ এক এমনই হননকাল, যার মধ্যে জীবনের যুক্তি ও কালপর্বের শেষ।
তাই হননকাল আসে জীবনে। আর জীবন থেকে কবিতায়, সিনেমায় কেবলই তার ছায়া ফেলে যায়। 

দিদিকে দিয়ে শুরু করে সারি সারি অকালমৃত্যু সহ্য করেছে অপু। সেই সহনীয়তা তার টুকরো হয়ে ভেঙে গেল  অপর্ণার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে। মুরারি, অপর্ণার ভাই, মুখ কালো করে দাঁড়িয়েছিল দরজার পাশে। খুলনায় স্ত্রী অপর্ণাকে ছেড়ে আসার পর অপুর প্রতিটা দিন কেটে গেছে অপর্ণার সান্নিধ্যেই, তার কাঁচা হাতে লেখা চিঠির ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোরের মধ্যে সহসা ছেদ টেনে মুরারি যখন বয়ে আনল অপর্ণার মৃত্যুসংবাদ, অপু নিতে পারেনি। আঘাত ফিরিয়ে দিয়েছে মুরারিকে মুষ্ট্যাঘাত করে। তার পর শূন্যতা। শুধু অন্ধকারে জেগে থাকা অপুর আয়ত চোখ আর ঘড়ির টিক টিক। এই টিক টিক শব্দ বিরাট হয়ে পৃথিবীর সমস্ত শব্দকে ঢেকে ফেলে ক্রমশ, আর অপুর মন পর্দা থেকে ঠিকরে এসে আমাদের সকলের মন হয়ে ওঠে ঐ শব্দ–ছবি দিয়ে। এর পর, হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় সেই টিক টিক।  নিকষ অন্ধকার আর নিরেট শব্দশূন্যতা। পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে, পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন। আবার ট্রেনের কাছে গেল অপু। বাল্যকালে দিদির সঙ্গে নিশ্চিন্তিপুরের যে প্রথম ট্রেন দর্শন অপুকে বিরাট পৃথিবীর দিকে ঠেলে দিয়েছিল, সেই ট্রেনের কাছে অপু গেল আবার। কেন? জীবনের ডাকে নয়, জীবনের ইতি টেনে দিতে। ঘড়ির থেমে যাওয়া শব্দ মুছে গেল ট্রেনের ঘর্ঘর শব্দে। না, আর ট্রেন দেখিনা। অপুকেও না। ক্যামেরা উঠে গেল আকাশে, শূন্য আকাশে! একটি শুকরের আর্তনাদ ভেসে এল।

অপু আত্মহননের ইভেন্ট হরাইজন ছুঁয়ে ফিরে এসেছিল। ব্ল্যাকহোলে ঝাঁপ দেওয়া বাকি ছিল শুধু। কিন্তু অপুর  এই যাত্রার মধ্যে সত্যজিৎ আত্মহননের যে তীব্র ছবি এঁকে দিয়েছিলেন, তা আর কোনো ছবিতে দ্বিতীয়বার করেননি তিনি। না, জলসাঘরে বিশ্বম্ভরের মৃত্যুর মধ্যেও না।

অপু হননকালের রাস্তায় হেঁটে ফিরে এসেছিল জীবনের কাছে আবার। কিন্তু মৃণাল সেনের মালতী আর ফিরে আসেনি। আশ্চর্য সমাপতন মনে হয় যখন ভাবি, মৃণাল বাইশে শ্রাবণ নির্মাণ করেন প্রায় অপুর সংসারের নির্মাণকালের মধ্যেই। অপুর সংসার রিলিজ করে ১৯৫৯ সালে, আর বাইশে শ্রাবণ ১৯৬০। দুটি ছবিতেই আত্মহননের চিত্র পাই! অপু ও অপর্ণার মতো, প্রিয়নাথ ও মালতীও সুখ-সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল। আর্থিক অনটন, অনাহার দুটি ছবিতেই তার কালো ছায়া নিয়ে হাজির। কিন্তু তবু, স্পিরিটে এই দুটি ছবির রাস্তা ভিন্ন। বাইশে শ্রাবণে প্রিয়নাথের সংসার আরও বেশি ডার্ক, কঠিন, লড়াই ও তার বিশ্লেষণ চিহ্নে বিশদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সদ্য পূর্বের সময়কালে, ডিপ্রেশনের করাল গ্রাস আর তার মধ্যে প্রিয়নাথের বেঁচে থাকার প্রয়াস যখন ব্যর্থ হতে হতে তলানিতে ঠেকে, সে ক্রমশ স্বার্থপর হয়ে ওঠে। এক জান্তব ক্ষুধায় আক্রান্ত হতে হতে, প্রিয়নাথ ক্রমশ ভুলে যায় তার স্ত্রীর কথা। খেয়াল রাখেনা, তার স্ত্রীরও খাদ্যের প্রয়োজন ছিল! বাইশে শ্রাবণ ছবিটি আমাদের কাছে প্রিয়নাথের এই ক্রমিক ইভল্যুশনের এক দারুণ নিষ্ঠুর ছবি, যা পরতে পরতে খোলে। মালতী  হতদারিদ্র্য সহ্য করেছে, কিন্তু মেনে নিতে পারেনি প্রিয়নাথের স্বার্থপর হয়ে ওঠা। বাইশে শ্রাবণ ছবিটির শেষে  মালতীর আত্মহননের তির্যক আর করুণ ছবি আসে। তির্যক, কারণ এখানে মালতীকে দেখিনা একটিবারের জন্যেও। মালতীর আত্মহননকে দেখি প্রিয়নাথের মধ্যে দিয়ে, তার চোখ দিয়ে। মালতীর সাড়া না পেয়ে, প্রিয়নাথ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে, বিস্ফারিত চোখে তাকায় সিলিং-এর দিকে। পর্দার এপাশে আমরা শুধু দেখি, ঘরের ছাদ থেকে ঝোলা একটি ছাতার বাঁটের অবিরাম দুলে যাওয়াটুকু আর তার ঘর্ষণ শব্দ। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দোলে সেটি। সময় বয়ে যায়, হননকাল আসে, তার ইঙ্গিতময় করুণ নিষ্ঠুর ছবি দোলে, দুলতেই থাকে।

রায় ও সেন এর পরে, আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৬৫ অবধি। সুবর্ণরেখা ছবির অন্তিমে ঋত্বিক ঘটক বোধ করি বাংলা ছবির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর, কঠিন আর সবথেকে বেশি গ্রাফিকাল আত্মহনন চিত্রের মুখোমুখি দাঁড় করান আমাদের। সীতা আর অভিরাম, সীতার দাদা ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। ঈশ্বর চাননি এই বিয়ে কারণ, অভিরাম বাগদি সন্তান, নীচু জাত! সীতা ব্রাহ্মণ কন্যা। ঈশ্বরের এই জাতগর্ব আইরনি মনে হয়, যখন ভাবি পার্টিশন পরবর্তী সময়কালে তার আর সীতার প্রায় রিফুজি হয়ে পুব বাংলা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়াটুকু। অপু-অপর্ণা, প্রিয়নাথ-মালতীর মতো, অভিরাম আর সীতার সংসারও সুখময় বা স্থায়ী হয়নি। ভেঙে গেছে কঠিন সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে। সুবর্ণরেখার বাস্তবতা  আরও নগ্ন। অভি আর সীতার জীবন, বস্তির প্রান্তিক জীবন। তবু তার মধ্যেই তাদের স্বপ্নও ছিল। সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল, যখন অভিরাম বাস ড্রাইভারের চাকরি নিয়ে একদিন মবড হল, এক অনিচ্ছাকৃত অ্যাক্সিডেন্টের জন্যে যখন তাকে প্রাণ দিতে হল জনগণের হাতে। না, সীতা তবু বাঁচতে চেয়েছিল। যৌনকর্মীর জীবিকা একমাত্র পাথেয় হলেও সে বাঁচতে ছেয়েছিল তার সন্তানের জন্যে। কিন্তু না, সীতা সব মেনে নিতে পেরেও,  নিতে পারেনি সেই মুহূর্তকাল, যখন তার যৌন পেশার প্রথম খদ্দের হিসেবে সে ঈশ্বরকে আবিষ্কার করল! এত বছর পর, সমাপতন আর আইরনির মতো, ঈশ্বর এসেছিল সীতার কাছে আবার, তার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বোনের কাছে! কীভাবে?

দরজা খোলে, তার আওয়াজ আসে আর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়া এক চিলতে আলোর সঙ্গে সঙ্গে সীতার অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়েন ঈশ্বর! বাইরের আলো ছেড়ে ঘরের অন্ধকারে এসে ঈশ্বরের চোখে ধরা পড়েনা সীতা। ক্যামেরায় ছেয়ে থাকে তার নেশাগ্রস্ত ঝাপসা দৃষ্টি। কিন্তু সীতার চিনতে দেরি হয়না দাদাকে! নেপথ্যে বেজে যাচ্ছে ওয়েস্টার্ন। বাহাদুর খানের সরোদ নয়, তার মেলোড্রামাটিক সিম্ফনি। সেই শব্দ ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে সীতার নিশ্বাসের শব্দে। পর্দা জুড়ে সীতার বাঁদিকের বিস্ফারিত চোখের বিগ ক্লোজ আপ। অন্ধকারে জ্বলে ওঠা সেই চোখ। তার হাতে উঠে আসে বঁটি। এর পর সীতা নয়, ঈশ্বরকে দেখি। দেখি তার চোখের বদল। তার পাঞ্জাবীতে এসে লাগে রক্তের ছিটে।  শুনি, মুরগি কাটার মতো ধড়ফড় শব্দ। দেখি, খাটের তানপুরা আর তবলার দুলে দুলে ওঠা। শব্দ শেষ। ক্যামেরা প্যান করে এগিয়ে যায় সীতার হাত থেকে তার মৃত, স্থির চোখের উপরে।

বাংলা তথা ভারতীয় ছবির তিন শক্তিমান আদিপুরুষ ও দিকপালের হাতে আত্মহননের চলচ্চিত্রায়ণ যেন এক পরিক্রমা সেরে ফেলে এভাবেই।

ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র মনি কাউল, যার ছবি সম্পূর্ণ ভিন্ন আর একক পরাবাস্তব রাস্তায় হেঁটেছিল, ১৯৯১ সালে একটি ছবি করেন। ছবিটির  নাম নজর। এ ছবির শুরুতে আর ভরবিন্দুতে আছে এক ষোড়শী স্ত্রীর আত্মহনন। 

আরও অনেক বিশিষ্ট ভারতীয় ছবির নাম যোগ করা যাবে, যেখানে আত্মহননের চিত্ররূপ উঠে এসেছে বিবিধ মাত্রায়। হালফিলের ‘মাসান’ ছবির শুরুতে একটি নির্মম আত্মহননের চিত্র আছে। পুলিশি অত্যাচার আর নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে পীযুষ নামক একটি যুবককে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে দেখা যায় বাথরুমে। মনে পড়বে ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির ডিপ্রেসড ছাত্রটির আত্মহত্যার কথাও। ভারতের বাইরে, প্রবল ডিস্টার্বিং আত্মহনন দেখেছি, ‘The hour’ আর ‘The Piano Teacher’ ছবিতে। নিকোল কিডমান, The Hour ছবির অসামান্য ভার্জিনিয়া উলফ। এ ছবির শুরু ভার্জিনিয়ার আত্মহনন দিয়ে। মুখের সমস্ত কথা হারিয়ে যায় মিশেল হানেকে’র The Piano Teacher ছবির শেষ দৃশ্যে এসে। পিয়ানো শিক্ষক এরিকা, কন্সার্ট হলের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের কাঁধের একটু নীচে ছুরি চালিয়ে দেন। তারপর বেরিয়ে চলে চান অবিচল চিত্তে, কন্সার্ট হল থেকে বাইরে, খোলা রাস্তায়। ক্যামেরা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি তাহার পাশে দাঁড়াও। কেন কাঁদছে মানুষ? কেন ২৮শে মার্চের কাকভোরে বরফশীতল জলের অন্ধকারে চলে যেতে হয় একজন প্রতিভাবান ভার্জিনিয়াকে? কেন তাকে লিখতে হয় নীচের সেই মর্মান্তিক শেষ চিঠি স্বামী লেনার্ডকে?
“Dearest,
I feel certain I am going mad again. I feel we can’t go through another of those terrible times. And I shan’t recover this time. I begin to hear voices, and I can’t concentrate. So I am doing what seems the best thing to do.”


কান্না ও শূন্যবোধ অতলান্ত স্পর্শ করলে মানুষ বার বার যায় ইচ্ছামৃত্যুর দুয়ারে, লেখা হয় -

“মাঝরাতে তুমি ছুটে গিয়েছ নিজের কাছে
   খুন করতে নিজেকে।
শুধু একজন মানুষ, আজ সমস্ত রাত, খোলা
   ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে” (ভাস্কর চক্রবর্তী)


রাত কত? উত্তর মেলেনা। শুধু আত্মহত্যারা আর ইচ্ছামৃত্যুরা যাওয়া আসা করে জীবনে। জীবন থেকে শিল্পে, কবিতা থেকে সিনেমায় তার অন্তহীন প্রক্ষেপ।

একটি সুইসাইড নোট : শবরী রায়

বহুদিন যাবৎ নিজের দুহাত বাঁধা অনুশীলন করছি। দু-পা বেঁধে ফেলা খুব সহজ। বাদল দর্জিকে দিয়ে বড় বড় পকেটওয়ালা এক পোশাক বানিয়েছি। পাহাড়ি নদী সমতলে নামার মুখে বিশাল এক পাথরের চাঙড়ের ওপর বসে সুইসাইড নোট লিখি। অত তাড়া নেই। ধীরেসুস্থে লিখি। ভাবি কাকে দায়ী করা যায়, কাকে কাকে দায়ী করব। ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলি। হতভম্ব মুখগুলো স্পষ্ট দেখতে পাই। আহারে পুলিশ টুলিশ কী বাজে ব্যাপার। যে যাই করে থাক, কিছুতেই স্বীকার করবেনা। তারপর ছাড়া তো পেয়েই যাবে একদিন। তাই ক্ষমা করে দিলাম যাওয়ার আগেই। সন্ধে নামার আগে ওই পোশাক পরে, পকেট ভর্তি করি কুড়িয়ে আনা নুড়ি পাথরে, জলের শব্দ শুনতে শুনতে পা বেঁধে ফেলি, ছিঁড়ে ফেলি সুইসাইড নোট, ঘুম পাচ্ছে, কয়েকটা ঘুমের ওষুধও খেয়েছিলাম। হালকা অন্ধকারে নিজের দুহাত বেঁধে শুয়ে পড়ি জলে।

এটা আমার সুইসাইড নোট। আরও দু-একটা লিখেছিলাম। ছিঁড়ে ফেলেছি। বেশ বিপজ্জনক। কবিতা নয় কিন্তু। একসময় পার্সে রেখেছি ধারালো নতুন ব্লেড, শ্বশুর-শাশুড়ির ঘুমের ওষুধ শ-দেড়েক প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে কিনে জমানো। গলায় দড়ি? বীভৎস। ট্রেনে কাটা? ছিঃ। শুভবুদ্ধি পুরোটা কখনওই ঘুমিয়ে পড়েনি। চারপাশে মৃত্যু দেখেছি, আত্মহত্যা। যে চলে যায়, যায়। মর্গের কাটাছেঁড়ার পর ধর্মানুযায়ী। হিন্দুরা আত্মহনন করে ফেলা আত্মীয়র আত্মার শান্তি কামনায় শ্রাদ্ধ করেনা। এটাই নাকি শাস্ত্রের মত। শাস্তিই তো। যারা থাকে, যাদের রেখে চলে যায় তাদের শাস্তি। কী হিংসাপরায়ণ! নাকি তাদের ভাবনাচিন্তা তাৎক্ষণিক লোপ পায়। ড্রাগ নেওয়া মানুষ ড্রাগ ওভারডোজে মৃত, এমনও দেখেছি। এসব কোনোটাই কি ইচ্ছেমৃত্যু? আত্মহত্যা একধরনের গভীরতম অসুখ। যার লক্ষণ আছে। সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না। হাসতে হাসতে উঠে পাশের কামরায় গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন হতে পারে। হতে পারে তাৎক্ষণিক, হতে পারে দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতি। যেকোনো ব্যাধির মতো এটাও একটা ব্যাধি। যার চিকিৎসা সম্ভব। আমার দিদা স্বর্ণলতার কোলের কাছে বসে গল্প শুনেছিলাম তাঁর মাসতুতো দিদির কথা। আদর্শের জন্য যাঁরা মরবেই জানতেন। দিদার চট্টগ্রামের শৈশব স্মৃতি। সবার মনে কি তত জোর হয়?

একটা চিঠি আমাকে খুব ভাবায়। অনুবাদ না করেই তুলে দিচ্ছি। এই সুইসাইড নোট আমি বহুবার পড়েছি। হয়তো আরও অনেকেই পড়েছেন। কেউ চলে যেতে চাইলে কে আর তাকে ধরে রাখে। আত্মহত্যা সবসময় কলঙ্কের স্মৃতি হয়না। ইচ্ছেমৃত্যুও বলা যায় তাকে কখনও।
          
Dearest,

I feel certain I am going mad again. I feel we can’t go through another of those terrible times. And I shan’t recover this time. I begin to hear voices, and I can’t concentrate. So I am doing what seems the best thing to do. You have given me the greatest possible happiness. You have been in every way all that anyone could be. I don’t think two people could have been happier till this terrible disease came. I can’t fight any longer. I know that I am spoiling your life, that without me you could work. And you will I know. You see I can’t even write this properly. I can’t read. What I want to say is I owe all the happiness of my life to you. You have been entirely patient with me and incredibly good. I want to say that — everybody knows it. If anybody could have saved me it would have been you. Everything has gone from me but the certainty of your goodness. I can’t go on spoiling your life any longer.

I don’t think two people could have been happier than we have been.

চিঠিটি ভার্জিনিয়া উলফের লেখা তাঁর প্রিয়তম স্বামীর উদ্দেশ্যে। শেষ চিঠি। অবশ্যই সুইসাইড নোট।

শ্রীখোল ও আতরের শিশি, তবু : ইন্দ্রজিৎ রায়

ছবি : Paulo Guimaraes
ড্রাগন ড্রাগন খেলা সেবার নতুন, কে ড্রাগন হবে, তার পিঠে অন্যেরা উঠবে, তখন তো ছেলেমেয়ে একইসাথে খেলতাম, গিল্লি ডান্ডা, কিতকিত, পরে তেঁতুলবিচি নিয়ে খেলতে গিয়ে প্রদীপ তো জাগলিং শিখে রীতিমত প্রোগ্রাম করতে লাগল, পুকুরটার ওপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে সাইকেল নিয়ে আসতে আসতেই আমার সহপাঠি, মুরারকা গ্রামের ছেলে গজেন, কাজলের প্রেমে কাৎ হয়ে পড়ল, কাজল এদিকে আমাদের অধ্যাপকের মেয়ে, তাঁর কাছে আবার আমরা টিউশন পড়তেও যেতাম, কাজল কখনওবা আসত বাবাকে চা দিতে, গজেন আমার পাশে বসে উদ্বেল, আমি মন দিয়ে অতনুবাবুর পড়া শুনছি, পাশ দিয়ে রাতকাহানির মতো ভেসে যাচ্ছে গ্রামজীবনের এঁচোড় কষা, তার চাপা রসুনের ঝাঁঝ, তোমার লাল রঙের বাড়ি, যাতে পরে তুমি ঠান্ডামেশিন লাগিয়েছিলে, সেটা নিয়েও বিবাদ হয়েছিল, আসলে কিছু বিবাদ একধরনের বিষক্রিয়ার মতো, আস্তে যা ক্ষয় করে যা করার নয় তাকেই, চিঠি লিখে আত্মহত্যার সুযোগ সকলে পায় কি, এটা নিয়ে একটা কবিতা ছিল হিরণ্যর, তরুণ কবি থাকতেই সে একটি বড় কাগজের সম্পাদকের নেকনজরে পড়ে, কিন্তু কপাল, ওঁর চাহিদা মতো মাল ও সাপ্লাই করতে না পারায় সে চাকরি চলে যায়, তবু সেই বড় কাগজের নাম ভেজে ও একটা কবিতা সেন্টার খুলে নেয়, স্টেশনের কাছে, সেখানে কবিতা লেখা থেকে আবৃত্তি, সবকিছু শেখানো হয়, অডিও ভিশুয়াল পদ্ধতিতে, কিন্তু মাঝখান থেকে ডায়বেটিস যে হিরণ্যকে নিয়ে যেতে পারে এক অন্য ছাপাখানায় একথাটা হয়ত তেমন ভাবে নি কেউ, 
ঘন, কালো মেঘ আর হাওয়াতে ভরে আছে এই শহর যখন, জৈষ্ঠের শেষ, এই শহরতলি আমি বাইরে থেকেই দেখে এসেছি, এখানকার সবজান্তা, চালাক চালাক সব মানুষ, তাদের মুখচোখের অসার সেয়ানা ভাব, অনিঃশেষ মাল মেটিরিয়াল কেনার বাসনা, এসবই যে কোনো সংবেদনশীল রোগে আক্রান্ত মানুষের মরে যাওয়া, সে কিছুতেই মেলাতে পারে না সুস্থ, সফল মানুষের এই উদ্ভাস, তারাও এই বেদনকে নিয়ে শ্লেষ করতে ছাড়ে না, তার সম্পাদকের চিঠি আসে বিদেশ থেকে, তিনি সাবধান করেন, হাঁদু, এসব করিস না, খেতে পাবি না, কী দরকার তোর লোকের সঙ্গে লাগতে যাবার, কিন্তু সেই কুকুরটা, যাকে গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কারণ সে ২৭ জনকে কামড়ে দিয়েছে, তার মুখের যে অভিব্যক্তি, ভোউ ভোউ, আমি পাগল নই, তার মধ্যে সে ক্রমশ নিজেকে দেখতে পেতে থাকে

পাড়ায় পাড়ায় লালপার্টি করা ছেলেরা রাতারাতি জার্সি বদল করেছিল, হিরণ্যর সামনেই, ওর কাকাকে দেখেছিল এক পুলিশ বুট দিয়ে পাঁজরগুলো ভেঙে দিতে, না এর পরেও হিরণ্য তেমন কিছু করেনি, কবিতা লিখেছিল কটা, আর হ্যাঁ মাঝেমাঝে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে, রাস্তার শব্দে ওর এই খিস্তিগুলো চাপা পড়ে যায়, না হিরণ্যের কথা বলতে আসিনি, ওর কথা বলার জন্য অনেক লেখক কবি কাগজ আছেন, যারা নিয়ম করে স্মরণসংখ্যা প্রকাশ করে এই মনে রাখা ভুলে যাওয়ার খেলাটাকে বাঁচিয়ে রাখে, আমি কি ভালো হব? মেয়েদের মা বোন ভাবব, ভিড় বাসে কোনো নধর শরীর দেখলেও গা ঘেঁষে দাঁড়াব কি, সবাই বলার পরেও কেন বুঝতে পারছি না যে আমাকে ঠিকঠাক হয়ে উঠতে হবে...

বাড়ি ফিরছি, গতকাল বিকট ঝড়জল গেছে, খুব ভালো হয়েছে, দু'চারটে তৈরি হচ্ছে এমন পোমোটারি যদি পড়ে যেত, খুব ভালো হোত, পোমোটিং বলে যে পেশাটা তৈরি করা হয়েছে, সারা শরীরের ভেতর যেন একটা গা ছমছমে চুপ, যেন ভেতরের যন্ত্র সব ঘুমিয়ে, গাড়ি ছুটছে ৩২ নম্বর হাইরোড দিয়ে, ভেতরে বিড়ি সিগারেট, গাঁজা ও মাথার শ্যাম্পুর এক অদ্ভুত মিশ্রণ, গান চলছে গাড়ির পেছনে, ভালো হতে হবে, বড় এবং সুস্থ, কামাতে হবে, এটা শুনলেই রামবাবা খেপে বলত আরামের মধ্যেই কেউটে সাপ বসে আছে, ভক্ত বিছুটি, ছুঁলেই কারেন্ট মারবে...

যখন পায়ের পেশীগুলো খুলে যাবার মতো হয়ে আসত আমি আর বিশু সিংমুড়া বাড়ির সামনে নিমগাছটার নীচে, এই বিশু আমাকে কলেজ বিড়ি চেনায়, এবং ফিল্টারহীন পানামা সিগারেটগুলো চেনায়, সমস্ত লেখাই কেউ কেউ পড়বে ভেবে যখন লেখা হতে থাকে, বৃষ্টির দিন এবং চৈত্রশেষের পাতাপড়ার যে রসায়ন শহরতলি দিয়েছে, তেমন আর হয়নি এবং যেটা হয়েছে তা হল যে মৃত জেনেও প্রতিদিন সকালে চুল আঁচড়ে, দাড়ি কেটে আমি ওখানেই ফিরে যাই, ওখানেই, আজ হঠাৎ সাগ্নিক ইউথ্যানাসিয়া শব্দটা বলল, সিঁড়িতে দেখা, বাকি সিঁড়িটা একা নামতে নামতে মনে পড়ল বিশ বাইশটা বছর, চিঠি আসা এবং না আসা, হাওড়ার অচেনা গলিতে তোমাদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে কবিতাপাঠরত আমার ছেলেবেলার প্রায় অবলুপ্ত গাদাবন্দুক ঝোলানো বাড়ি, মিথ বলে যে ব্যাপারটা আছে, সেটা আমার গায়ে সাবানের, ছোবড়ার মতো আমার মাতামহী ঘষতেন গায়ে পিঠে, ভুল কি ঠিক আমি তো জানি না, বোতাম টেপা যে দিন ও পাল্টে যাওয়া কন্ঠ মানুষের, একবার যেতে দেওয়ার পর আর না ফিরে আসা, অবসাদ খুঁজে পাওয়া দিন, জ্যামিতি মন দিয়ে না শেখার ক্ষয়, সামনে আরও একটা দিন, তারপর হয়ত আরও, আতরওয়ালা, তার দমচাপা গলি ফলে কোনো সময় নেই আর, শহুরে বিষাদ থেকে দূরে যেতে হবে, প্রকৃত দুঃখ ও শব্দের কাছে, মরে যাওয়া যায় এমন সব বিকেলগুলো কি ডাকেন আজও, ডাকেন? কমিক্স কিনতে যাব, আজকে, জামাটা হাতে নিয়ে মাথাটা একটু টাল খেলো, অকস্মাৎ 

সুইসাইড নোট লিখে ক্ষান্ত হন উনি, যদিও ওটা আর শেষে করা হয়নি, তাহলে এটা কী? মনোবিদের চেম্বারের পেছনে মাঠ, সেখানে ততক্ষণে চক্র বসে গেছে, সাধন ভজনের, উল্লাসের সেই করাল চাপা ডায়রির গায়ে গতকালের চা রক্তের মতো, ঝলমলে, উত্তরবঙ্গর সেই ঝল্লমল্ল নাচের মতো, হিরণ্যকে মনে পড়ল এসময়ে, অকারণে, সারল্য কি মানুষকে ঠেলে দিতে পারে? অন্যদিকে? প্রশ্নহীন, রোগবালাই মুখর একটি জীবন অভিমুখে পুনরায় নিজের ঝোলা কাঁধে বাঁকাশ্যামদার বাড়িঘরের দিকে, গেছিলে? 

বদলে যাওয়া মানচিত্রে, চিত্রাবলি, শিশুদের অনুপস্থিতি যা ক্রমশ এক অসুখের মতো, কী করবে এখানে হিরণ্য বেঁচে থেকে, ভাতের হোটেল ও ভাঙা মেলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, নব্বইয়ের কবিতা যা এখন দূরাগত গানের কলি মাত্র, অন্য কাজ করতে গিয়ে যা কানে আসে অকস্মাৎ, ওগুলো আমি লিখেছিলাম, ওই অনুভূতিশূন্য, বাহারি শব্দমালা - মানুষ দৌড়ে যায়, প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে নেয় কাতর চোখ শিক্ষিকাকেও, যিনি সব হারানো শিশুগুলোর আলো, এগুলো কী? সুইসাইড নোট তো এমন হয় না দেখতে, মনোবিকলনশাস্ত্র বলেও কিছু আছে? কতটা হয়? *#@:ওহ আবারও ভুল টাইপ করছি, মাঝরাতে, কী লিখতে গিয়ে কী লিখে ফেলছি, মনোবিকলনশাস্ত্র, ইচ্ছামৃত্যু, নাকি ইচ্ছার মৃত্যু, কোনটা যে কী, বুঝতে গিয়ে ক্রমশ পাথর হয়ে যাচ্ছে চোয়াল, ঝুঁকে পড়ছি রঙিন মানচিত্রের দিকে, কলম হাতে, যেন মৃত্যুভয়, ভয়ের গলি থেকে ডাক আসছে রোজ

একটা পাখির কথা ভাবতে গিয়ে হিংস্রতার কথা ভুলে, কী পাখি ছিলিম ওটা, কিছুতেই মনে পড়ে না, সন্ধের মুখে যখন তিনমাথার মুখে দাঁড়ায়, তেলেভাজা সব ফিরতে থাকে, আরও কালো হয়ে হিরণ্য ও তার বন্ধুদের ধুলো সংলগ্ন সৃষ্টিনাশ দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম একদিন, ব্যাস ওই দাঁড়িয়ে থেকে যেতে পারে কেউ, তাদের জন্য সমস্ত উত্তাপ অপেক্ষা করে কোথাও, জালি মনোবিদ আমার মাতামহের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলছেন, সেশনের পর সেশন চলে যাচ্ছে, দাদুর মনোবিকলনশাস্ত্র আড়া ঝাঁপতাল যেন, দাদু ভুলে যাচ্ছে সব, গভীর একটা মাঝরাতে হঠাৎ দাদু, আচ্ছা, আমার গুরুদেবের নাম কী, বলো তো, না, আমারও কী হল, বললাম, কাঠিয়া বাবা মনে হয়, রামদাসজী, দাদু একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে শুনে যে গেলেন, আর ফেরেন নি, হোম ডেলিভারিতে খেয়ে খেয়ে, শুন্য বৃষ্টির দুপুরগুলোতে বিনয় মজুমদারের কবিতা অজস্রবার পড়ে, মাঠের আড়াআড়ি আলোটাকে অনুসরণ করে বাড়ি ফিরতে থাকে বিয়েবাড়ির হাসি, দুধসাদা, থকথকে ভয়, আরও জোরে হাসি আড় ও বোহাইল ধানের খেত দেখে, কী করে কাঠিয়া বাবার নামটা মনে এল, আমি পরিচিত ছিলাম না এই নামটির সঙ্গে, হলাম একটু, দাদু আর কিছু বলেন নি বিশেষ, কাপড়ও ত্যাগ করলেন, শেষের দিকে, মনোবিদ কোনো পেপারওয়েট আমাকে দেন নি সেদিন স্মৃতি হিসেবে, প্রতিবার দেন, তবু মাতামহের ওই আস্তে মিটে যাওয়া, যেন ইচ্ছামৃত্যুর একটা টানেল খুলে যায় মাথার বালিশের পাশে, মাথা ঘোরাতে একটা ফাঁকা তন্তুক্ষয়, একে একে পানদোকান, ঝটাপট শব্দে খুলতে থাকে, এইসব মনোবিদ, তারা কি এটা বোঝে? তারা কি তারা বোঝে? মাতামহের ফাঁকা বাসা, রাতপাহারা, আমন চাষের, পোকা মারার সব গল্পের মাঝেই মাতামহের ইচ্ছামৃত্যু খেলাটা, শেষ ঝিমুনির মতো, মাথাটা একবার তুললাম, শেয়ালদা ঢুকবে গাড়ি

ইচ্ছেডানা : তন্বী হালদার

ছবি : Destiny Womack aka dWo
গালুডি পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মনে হয় কেন আমি বাঁচব। যেখানে যতটুকু, সেখানে ততটুকুই তো খাপে মাপা। এই যে ঐ সূর্য নামক অগ্নিপিন্ডটি কেমন সুন্দর হাঁসের ডিমের কুসুমের রঙের মতো হয়ে গিয়ে একটু পরেই পাহাড়ের ওপারে টুপ করে খসে পড়বে। মনে হবে যেন রাতটুকুর জন্য পাহাড়ের ওপারের কোনো গ্রামে বেড়াতে গেল। প্রকৃতির রাজ্যে কোথাও কিছু কম পড়ে না। কিন্তু আমার জীবন রাজ্যে এত কম কেন। কেন সেখানে শুরুতেই শেষ হয়ে গেল জীবনের ধারাপাত। জীবন বারবার মুখ ফিরিয়ে বলেছে, হেরো এমা তুমি হেরো। আর আমি গো গো স্ট্যাচুর খেলার মতো স্থবির দাঁড়িয়ে গেছি। দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমার পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে। কিন্তু কে বা কারা যেন বারবার এসে শিকড় উপড়ে কেটে ফেলেছে। আমি কিন্তু হাল ছাড়তাম না। বারবার বাঁচার নেশায় হামাগুড়ি দিয়ে, বুকে হেঁটে, গড়িয়ে গড়িয়ে, পথ করে যা হোক করে নরম মাটি খুঁজে নিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের তাপ শুষে নিয়েছে আমার জীবনের সকল সম্পর্কের রস। ভ্যাম্পায়ার রক্ত চুষে খেয়েছে আমার। মাটি শুকিয়ে পাথর। সেখানে আর আমি শিকড় চালাতে পারছি না। প্লিজ আমাকে দুটো ইচ্ছেডানা দাও। যাতে ভর করে আমি উড়ে যেতে পারি অনন্ত মহাকাশে। প্লিজ দয়া করো আমি ভয়ঙ্কর এই যন্ত্রণা, এই অপমান, এই লাঞ্ছনা আর সহ্য করতে পারছি না। আমি অব্যাহতি চাই, মুক্তি চাই। গালুডির পাহাড়ের ওপারে যে গ্রাম হতে পারে হাসনাহানু, মহুয়ামিলন, ঝিলিমিলি আমি সেখানে যেতে চাই। আমি ঘুমাতে চাই। মহাঘুম। এটা আমার বাঁচার অধিকার। ইচ্ছেডানায় ভর করে আমি একটা নীলতিমি হয়ে বেছে নেব আমার অভিমান। মৃত্যু। আমার বন্ধু। আমার পরম আত্মীয়। আমার ইচ্ছেমৃত্যু।

মৃত্যু বিষয়ক : সায়ন্ন্যা দাশদত্ত

আর পাঁচটি সংসারের মতোই যমের একটা আবছায়া আভাস আমাদের চালেডালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। আগেও ছিল চিরকাল। গ্রীষ্মরোদে বাসা করেছে চড়াই। স্বামী স্ত্রীর ঘর। একজোড়া ছানা হয়েছে ডিম ফুটে। মিহি মিহি চিঁ পিঁ শুনতে পাচ্ছি মাঝেমাঝেই। তারপর বিকেলে ঝড়। বিস্কুট হাতে মগ্ন হয়ে দেখছি দখিনের নারকোল গাছ মাথা নাড়ছে পাগলের মতো। একটা আকস্মিক আলো। কড়কড় শব্দে মাথা ভেঙে যায় কারুর? মৃত্যু তবে নীরবও নয়?
          
যমের গল্পটা এভাবে ফুরিয়ে যায়না। সে চড়াই-এর জোড়া বাচ্চা হাওয়ায় উড়ে পড়ল। লাল সিমেন্টে কালো বর্ডার টানা। একটা হিমশীতল মেঝের ওপর কীভাবে ওরকম নিস্পন্দ পড়ে থাকা যায়, যমের গল্প না শিখলে জানতে পারেনা কেউই !
          
শিখলাম যম আছে। সারাজীবনই যম কাছেপিঠেই একটা অন্যমুখে হেঁটেচলে বেড়ায়। শুধু তেলাপোকার মতো অদ্ভুত একটা তেলচিটে গন্ধ থাকে তার। কেউকেউ টের পায় সময় হলে আর অনেকে রাতারাতি ভ্যানিশ হয়েও যায়।
            
কথায় কথায় জানতে পারলাম ইচ্ছেতেই চলে যাওয়া সহজ। দু তিনটে নল অথবা এক আধটা কাচের মতো স্বচ্ছ সিরিঞ্জ এবং বোতল আঙ্গুল থামিয়ে চুপ করতে বলে। যেখানে কোন সুইচরুম নেই। কেবল কতগুলো অচেনা অজানা তার তাদের নির্দিষ্ট অঙ্গের পাশে একপশলা বিদ্যুৎ রেখে গেছে। মৃত্যু নিয়ে এত কথা হয়নি তো আগে! তবে এখন? এখন?
             
নিরোধ অসহায় ছাতার নীচে হাঁটছে। লুকিয়ে থাকাই ভালো। এই বিপুল মানুষের ভেতর বাঁধন কেমন হয়? জনসংখ্যার প্রাবল্য, তবে কি একদিন জায়গা হবেনা আর? তবে বরং ছাঁটাই শুরু হোক। আহা!ও তো উইলিং নয়, তবে কেন আয়ুর ভেতর হাঁটা। মৃত্যু চাও? বেশ, রাজি। তবে সে যদিও তোমার। যে ট্রামের সাথে জীবনানন্দ কুয়াশার মতো মৃত্যু হয়ে যাচ্ছিলেন তার ক্রমিক নম্বর দেবে? জাস্ট ডায়ালে আ্যড করতে হবে? জীবনানন্দ আপিল করেননি! অন্যায়! তবে আর সমাজ রইল কোথায়? সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার তার একটা লিপিবদ্ধ সতর্কীকরণ থাকে, কবি বলেই অগ্রাহ্য হবে সেসব?
               
বিনয় যখন পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন...নোংরা নখ, ঘরভর্তি মলমূত্র, কফ। একবেলা খাইয়ে দেওয়ার কেউ নেই। কেউ নেই একটি গল্প বলার। সেই মুহূর্তে পাগল হচ্ছেন বিনয়...অনুগামীরা কেন একটি ইউথেনশিয়ার আয়োজন শুরু করেনি? তবে কি আগামী বছর বিনয় সংখ্যার বদলে দিকভ্রান্ত ক্লান্ত লেখকের সেলফ কিলিং ডিনার সাজাবে ভাবছ?
               
যম যেভাবে দাঁড়ায়, তার পায়ের ফাঁকে একবিন্দু আলো বাতাস নেই। যার মৃত্যু, যার জীবন্মৃত চিবুক একটি ফোঁটাও ফলের রস নেবেনা তার জন্যে মনোনয়ন নেবে? জরুরি ওটা? দিকেদিকে এই অজস্র প্রচার...প্রতিটি অক্ষম প্রাণ মৃত্যু বেছে নিক, এই মিছিলের দৃশ্যদূষণ অধিক। তবে কি কমিয়ে ফেলাই মুখ্য? একটি যৌক্তিক মুখোশ এবং আইন আঙুল দেখিয়ে বলছে জড়িয়ে থাকা সমস্ত হাত মিথ্যে। সমস্ত আয়ু, বিকল্প সুখের ভাবনা সবই কেমন ধোঁয়ার মতো অলীক হয়ে যাচ্ছে। এতদিনের বাঁচতে চাওয়া একলা...আপাতত ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন তবে মুখাপেক্ষী কেন? দ্বিচারিতা যমের পছন্দ নয়। মিহিন বাদশাভোগ চালের পায়েস চাপল কোথাও...খাওয়া হবেনা জেনেও শ্বাস টানলেন বয়স, তিনবারের স্ট্রোক, সব সবটা বুঝতে পারেননা ভালো! মর্জি মতন গন্ধ বুঝতে চান...বুঝতেও পারেন, যেমন আজ...এখন...এই! যম গোপনে সিঁড়ির কাছে এল। সিঁড়িঘরে আলো জ্বালেনি কেউ!

একটি সামুদ্রিক ইচ্ছামৃত্যু : পিয়াল রায়

ছবি : Yvette Hess
অন্ধ লোকটা রাস্তায় নামলেই টের পায় গাছগুলো সচল হয়ে উঠেছে। ওরাও হেঁটে যাচ্ছে লোকটার পাশেপাশে।  সমুদ্রের বালিতে ছাপ পড়ছে সহযাত্রার। সমুদ্র থেকে ভেসে আসা হাওয়ায় ওরা ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে। অন্ধচোখ দিব্যি টের পায় সাদা ফুলে ফুলে ভরা টগরগাছটা হাত চেপে ধরেছে রাধাচূড়ার। ওদের ফিসফিসানি কানে আসে লোকটার। লোকটা বুঝতে পারে গতরাতে অভিনীত একটা নাটকের কথা বলাবলি করছে ওরা। লোকটা বালির ওপর বসে। শরীর ঘেঁষে বসে পড়ে গাছগুলোও। খুবই নিচুস্বরে সুখদুঃখের আলোচনা চলতে থাকে। কারও শরীরে তীব্র বানিজ্যিক ক্ষত, কারও বা চোখে স্বজন বিহনের শোক। ওদের চোখের জল প্রস্বেদন হয়ে ঝরে পড়ে লোকটার গায়ে। পাতাদের কষ্ট নির্মল হাওয়া হয়ে মিশে যায় শিহরণে। হঠাৎ লোকটার মনে হয় তার কেউ নেই। আয়নায় ভেসে ওঠা অস্তিত্বহীন প্রতিবিম্ব মনে হয় নিজেকে। ব্যাধিগ্রস্ত কলজেতে দুলতে  থাকে মাস্তুল ছেঁড়া জাহাজ লোনাজলের দাপটে। লোকটার চোখদুটো ভেসে যায় একটি সামুদ্রিক ইচ্ছামৃত্যুর স্রোতে।

মৃত্যু এবং পুরুষোত্তম : তপন কুমার পাল

জাতস্য হি ধ্রুবঃ মৃত্যুঃ

যে জন্মায় তার মৃত্যু নিশ্চিত। মৃত্যু নানা প্রকার। ১/ স্বাভাবিক ২/ অপমৃত্যু ৩/ আত্মহত্যা ৪/ স্বেচ্ছা মৃত্যু ৫/ ইচ্ছামৃত্যু। আত্মাহুতি, আত্মমদত ইত্যাদি সবগুলিই প্রকৃতিগত ভাবে আলাদা।

বিভিন্ন কারণে মানুষ প্রকৃতির নিয়মে আসা মৃত্যুর আগে জীবনের সাথে বন্ধন ছিন্ন করতে চায়, যেটি আত্মহত্যা নামে পরিচিত। যখন চাওয়া-পাওয়ার মেলবন্ধনে অসামঞ্জস্য আসে, বিচলিত মন তার গতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, তখনই কোন মানুষ আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়। এই মৃত্যু কোনোদিন কোনোভাবেই সামাজিক বা আইনগত ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য নয়। যতদিন নিজের চাহিদা আর প্রাপ্তির মধ্যে দূরত্ব ছিল না ততদিন তাদের জীবনের প্রতি কোনো অভিযোগ বা বিতৃষ্ণা ছিল না। জীবন ছিল স্বপনের মতো প্রিয়।

অথচ আত্মকেন্দ্রিক মনের দাবী পূরণ না হওয়ায় নিজের চারপাশের প্রিয় মানুষ যাদের সুস্থ জীবনকে প্রভাবিত বা বিধ্বস্ত করতে পারে তাদের কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতো নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব বা উদারতা নেই। থাকতে পারে না। চারপাশের বিষাদগ্রস্ত মানুষদেরও প্রভাবিত করে অন্যের আত্মহত্যা। সমাজজীবন বা মানবজীবন নিয়ে চিন্তাশীল মানুষদেরও অস্থির করে তোলে অন্যের আত্মহত্যা।

দীর্ঘ রোগভোগ বা জাগতিক মায়ার প্রতি মন নির্লিপ্ত হলে বা নিজস্ব যাবতীয় দায়িত্ব সমাধানের পর মৃত্যু ইচ্ছা আসে কারও কারও মনে। সেক্ষেত্রে তার ইষ্টের কাছে মৃত্যু প্রার্থনা করে সেই ব্যক্তি। যা ইচ্ছামৃত্যু নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দেহ মন আত্মায় সে ব্যক্তি মৃত্যুকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে। প্রচলিত মতবাদ, এই সময়ে ঈশ্বর তার প্রতিকূলতার প্রতিকার সম্ভব না হলে তার মৃত্যু ইচ্ছা পূরণ করে থাকেন। স্বেচ্ছামৃত্যু - হিন্দুধর্মে স্বেচ্ছামৃত্যু স্বীকৃত। কোনো ব্যক্তি যখন মৃত্যুভয় অতিক্রম করে, কখনও বা অন্য জীবনের আকাঙ্ক্ষা থেকে মৃত্যুকে আবাহন করে, সেক্ষেত্রে প্রচলিত মতবাদ অনুসারে সেই ব্যক্তি জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধান অতিক্রম করে যোগবলে সমস্ত ইন্দ্রিয় ইচ্ছাকে নিরুদ্ধ করে ভ্রুযুগলের মধ্যে প্রাণকে স্থাপন করে শরীর ত্যাগ করে, তাকেই স্বেচ্ছামৃত্যু বলে।

ননাবিধ প্রাণত্যাগের মধ্যে সহজতর পদ্ধতি আত্মহত্যা। কিন্তু কোনো ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ সাধারণত এইভাবে মৃত্যু গ্রহণের কথা চিন্তা করেন না। কারণ শাস্ত্রমতে তারা জেনে থাকেন ভোগের জন্যই জীবন। জোর করে তার ছেদ ঘটানো উচিত নয় বা সম্ভব নয়। যদি সক্রিয়ভাবে কেউ এজাতীয় চেষ্টা করে তা ধর্মমতে, সমাজের নিয়মে বা আইনগত ভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।

অন্যায়ভাবে কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত হওয়া বা অহেতুক দূর্ব্যবহার ইত্যাদি যে সব কারণ দুর্বল মনের মানুষের মনে আত্মহত্যার চিন্তা নিয়ে আসে, সেসব কারণের সম্মুখীন হলে তাদের এই সত্যকে মেনে নিতে হবে যে, জগতের সবকিছু পাবার জন্য নয়, সমস্ত কামনা বাসনা পূর্ণ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে পুরনো ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে সম্পর্ক বা আশা নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করার কথা মনকে বোঝাতে হবে।

যেভাবে গাছের পাতা জন্মায় সেভাবেই নির্দিষ্ট নিয়মে পূর্বনির্ধারিত সময়ে তা ঝরে পড়ে। সেভাবেই সময়ের আগে ভোগের এবং জীবনের ছেদ ঘটানো অনুচিত ও অসম্ভব।

আত্মাহুতি : পুরাকালে ক্ষত্রিয়, বিশেষত রাজপুত জনজাতির মধ্যে সম্মান রক্ষার্থে যে জহরব্রত পালনের মধ্যে দিয়ে প্রাণত্যাগের চল ছিল তা কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যু বা আত্মহত্যা কোনোটির মধ্যেই পড়ে না। এক্ষেত্রে তারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণে বাধ্য হত।

আত্মঘাতী : নিজেকে হত্যার মধ্য দিয়ে আরও কয়েকজনকে হত্যা করে যারা, তারা আত্মঘাতী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

মন্দিরে উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে কাঁসরঘন্টার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় ক্ষর(দেহ), অক্ষর(আত্মা) এবং পুরুষোত্তমের বার্তা।
"অজ নিত্যঃ শাশ্বত অহং পুরানো,
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।"

আত্মা অজ, নিত্য, শাশ্বত ও চির পুরাতন। দেহ হত হইলেও আত্মা হত হয় না।

ইত্যু : মৌমিতা মিত্র

ছবি : Henry Asencio
ইত্যুর সংগে আমার অনেকদিনের আশনাই, যাদু কি ঝপ্পি, ঝপ্পি কি যাদু, 'ইচ্ছামৃত্যু' বড্ড মহাভারতীয়, রাজকীয় হোমরা চোমরা - নিজেকে কেমন ভীষ্মের মতো মহামতি মনে হয়। আমার মতো মতিচ্ছন্ন মেয়ে(মানুষ?) নরম নরম পালক পালক - যেটুকু ধারালো মাড়ালো দ্যাখো, জানবে গলাটা বঁটিতে কুঁচ হওয়ার আগে এবং অব্যবহিত পরে মাংসের যে উষ্ণতা, উগ্র গোলাপি গলগল, শুধু সেইটুকু, তাকে আর যাই হোক, প্রতিস্পর্ধা বলে না - বড়জোর ইত্যুর জন্য হাহা হুহু হতাশ্বাস বলা যেতে পারে।

না মিতুলদি, ওকে 'ইচ্ছামৃত্যু' বলে ডাকতে বোলো না। ওর নাম মুখে নেওয়া বারণ আমার - কতবার ওর চওড়া লোমশ কালিয়া বুকে মাথা রেখে কেঁদেছি, বলেছি- "এবার সেই বিলীয়মান কেসটা হয়ে যাক, নীলাচলে মহাপ্রভু'র মতো তোতে বেশ মিশেটিশে গেলাম। দেখিস, তখন সবাই কত কাঁদবে, মাথা চাপড়ে বুক চাপড়ে,  ঘোমটা পরে, ঘোমটা খুলে, পুংকেশররা বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কল খুলে দেবে, ছড়ছড় করে চোখ আর পুংলিংগে কাঁদবে। কেউ ছাদে গিয়ে দু:খ ফুঁকে আর একটু বাতাস দুষিত করবে। সবাই বুঝে যাবে সব, কাঁচাসর্দির মতো গলগল করে বেরিয়ে আসবে আমার প্রতি সকলের টান, অনুতাপ, অপরাধবোধ, থরথর  থরহরি, হরিহর, বল হরি হরিবোল, বল হরি হরি বোল, কেউ গান শিখুক না শিখুক রে ইত্যু, এই সুরটা কেউ কখনো ভুল করে না। আমি সুরে সুরে সুর মেলাতে মেলাতে কাঁধে কাঁধে এলাটিং বেলাটিং করতে করতে সাঁঝবেলায় ঢলে যেতে চাই রে ইত্যু, ও ইত্যু আমার, আমার মুখখানা দ্যাখ, দেখেছিস? সরস্বতী পুজোর কত চাঁদ মালা থেকে খসে ধুতি পাঞ্জাবি পরে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের তিরতির হাত অঞ্জলি দিয়েছে, অধীর চোখ জ্যোৎস্না দিয়ে গেছে আমাকে, একবার চোখ তুলে চোখ নামিয়ে নেবার সাহস হয় নি কারও আর তুই আমাকে...একটু 'ইসে' দিলি না, আমার সকল নিয়ে সকল খুলে বসে আছি তা-ও তুই নিবি না আমায়। আমার এহেন আত্যন্তিক গেছোসোনাল বৃত্তির পরও শালা খ্যাঁকখেঁকিয়ে হাসে, শালাতম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কপালে একটা টিপচুমু খায় অথচ ঠোঁটের দিকে যেতে গেলেই হাসি দিয়ে ব্লক করে, এমন আনফ্রেন্ড ইত্যু আমার - শালা মম, বলে 'কারোর কিস্যু যাবে না আসবে না ছিঁড়বে না ফাটবে না রে শালি(ইত্যু আমায় এই নামেই ডাকে), কেবল তোরই পরের ভোরটা দেখা হবে না। বাকিরা সবাই দেখবে, কেমন করে ছেনাল আকাশ রাতারাতি চাঁদ থেকে সূর্য খসম বদল করে, সবাই দাঁত মাজবে, বাথরুম যাবে, পটি করবে, তোর জন্য আড়াই দিনের বেশি কোনো কমোড কাঁদবে না, যে হ্যান্ড শাওয়ারে তুই ছুঁচু করতিস - সে শুধু কুমীরের মতো ফিচকি ফিচকি কাঁদবে - আর কেউ না, বিশেষ করে যারা তোকে পোড়াতে গিয়ে সারারাত জেগেছে আর মোবাইলে ঘনঘন ঘড়ি ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ দেখেছে, একটার পর একটা আদিরসাত্মক জোকস পড়ে হেসে ফেলতে গিয়েও টপ করে গিলে ফেলেছে আর ভি. আই. ফ্রেঞ্চি ঘামিয়ে টানটান করে ফেলছে, তার...তার...তারওপর...তাদের দাঁড়িয়ে থাকারা এক এক করে ঢুলতে ঢুলতে অবাঞ্ছিত মেসেজ,  ভিডিয়ো, অ্যানিমেশন ডিলিট করতে করতে হাই চেপে বা তুলে হিসেব করতে বসেছে, আগে আরও দুটো, তারপর পুড়তে চল্লিশ মিনিট, ছাই ফেলতে ভাঙা নর্দমা অর্থাৎ গঙ্গার কাজ সারতে আরও কিছুক্ষণ - তারা  বাড়িতে ফিরেই রক্তজবা চোখে দাঁতে লোহাসন্দেশ কেটেই দু'মগ উপুড় করে বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়েছে যেন আর কোনোদিন উঠবে না কিন্তু উঠবে। তারা সবাই উঠবে, শুধু তুই উঠবি না রে শালি, তোর নাইটা শেয়ালে খাবে, তোর ছাই সমুদ্রে যাবে, তোর চকচকে ছবি ঝাপসা হবে, ধুসর হবে, দুর্বোধ্য থেকে অবোধ্য হবে, তারপর একটা জং ধরা পেরেক হয়ে অযাচিত গেঁথে থাকবি কালের দেয়ালে। তারপর একদিন দেখবি, যাদের মজা দেখাবি ভেবেছিলি, তারা সবাই ব্যাপারটাকে মজা হিসেবেই নিয়েছে আর উল বুনতে শুরু করেছে আর অফিসের নেক্সট প্রোজেক্টটা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে, যারা ঝিনুকে করে দুধ খেত তারা হরলিক্স কমপ্ল্যান পিডিয়াশিয়োর থেকে বিয়ার হুইস্কির পথে বহুদিন...শালি রে, হয়তো ওই হুইস্কিতেই তুই একটু, হ্যাং ওভারে পৌনেমতো, মাঝরাতের বিনিদ্র আধশোয়ায় সোয়াটাক, সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা চাঁদে সিকিটুকু, ডায়রির দোক্তায় লালছোপ, কোনো বিয়েবাড়ি বা অন্নপ্রাশনের এক দুজোড়া ছলোছলো চোখের 'আজ যদি...'তে,  রবিবারের মাংসভাত দুপুরের পর পুরনো হার্ড ডিস্কে পুরী বা নৈনিতালে তোর হঠাৎ ঝিলিকজনিত বুকের মোচড়ে, আর একছটাক অভিমানী প্রশ্নে - কেন? কেন? এতটা বাড়াবাড়ির কি দরকার ছিল? এতটা বাড়াবাড়িরই যে দরকার ছিল, আসলে এটা যে বাড়াবাড়ি নয়, থমথমের পর কালবৈশাখীর মতোই অনিবার্য আর নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল সেই মুহুর্তে তোর রুদ্রবৈশাখি সত্ত্বার কাছে, কেউ বুঝবে না রে শালি, কেউ বুঝবে না, বরং যত সময় যাবে, লোকে ঘটনাটার ভাবসম্প্রসারণকে সময় নষ্ট করা ভেবে স্রেফ 'দুর্ঘটনা' বলে প্রেসি করে দেবে। খবরের কাগজের একটা ধুসর কাটিং হয়ে আলমারির লকারে রাখা থাকবি তুই, কেউ কোনোদিন খুলে দেখার সাহস করবে না। কাশেমের মতো পাসওয়ার্ড ভুলে কাতরাতে কাতরাতে নিথর হয়ে যাবি, কোন আলিবাবা তোকে উদ্ধার করবে না আর শেয়ারের কাগজ, ব্যাংক, ইনশিয়োরেন্সের কাগজের যত ঐশ্বর্য, তার সংগে রাই হয়ে জুড়ে থাকবি, যেমন শ্যামের সংগে রাই, জুড়ে তবু দূরে দূরে...

এসব শুনলে কার মাথার ঠিক থাকে বলতো মিতুল দি, (কিছু মনে করিস না, তোকে তুই বললাম বলে, আসলে ইত্যুর ভাল নাম আর মিতুল দুটোতেই 'ম' আর 'ত' আছে তো; খানিকটা মওত আছে তো।), থাবড়াতে ইচ্ছে করে না বল? খুব খানিকটা থাবড়ে চাবকে, আঁশবঁটি দিয়ে ফালা ফালা করে এবং হতে হতে গলা ফাটিয়ে বলি, "আর যদি কোনওদিনও তোকে ত্রিসীমানায় দেখি..."

তবু রাত আসে। রাতের পেটে মাঝরাত আসে। মাঝরাতের বুকে শেষরাত আসে। নির্ঘুম আসে, নিষ্পলক চোখে নির্জলা আসে। চোখের পাতা ভারি...ও ভারী হয়ে ওঠে, তখন, ঠিক তখনই একটা চওড়া কালিয়া লোমশ বুকের ভার টের পাই এই জ্বালাপোড়াতীত বার্নল সত্ত্বায়। চোখ বন্ধ করেই বলি, 'ইত্যু, সেই কেসটা এবার হয়ে যাক, মিশন বিলীয়মান।" ইত্যু আমার বন্ধ চোখের পাতায় আঙুল বোলাতে বোলাতে বলে, "শোন রে শালি, ইত্যু তো তোর রইলই, যখন খুশি, যেখানে খুশি, যেমন খুশি কিন্তু 'ইজী' কে উপেক্ষা করা অত ইজি নয়, যতটা তুই ভাবছিস। একবার চোখ খুলে পর্দা সরিয়ে দ্যাখ।"
সরালাম।
সরে গেল।
ইত্যু।

পূবালী কচিকুঁচি আলো আমার ছোটনাগকপালপুরে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে মসৃণ করে দিল। তারপর আমার মুখের খুব কাছে মুখ আর হাসি নিয়ে এসে, চোখে চোখ রেখে বলল, "টেক ইট, ইজী"।

ছুটি : অরিত্র সোম


“নাদিয়া ভেসপুচি! না-দিয়া ভেস-পুচি...

আহ! কোত্থেকে এত শব্দ আসছে! এইতো সব চুপচাপ ছিল, আমিও ঘুমাচ্ছিলাম; তাহলে কে ডাকছে এখন আমায়? কে?

“নাদিয়া ভেসপুচি...”

আবার, আবার ঐ ডাকটা আসছে। আবার…আচ্ছা, গলাটা কেমন চেনা চেনা লাগছে না? কোথা থেকে আসছ তুমি? কোথায়?

“..................”

আরে, এই তো আমাদের স্কুল গার্ডেন! এই তো সেই গাছটা, বাহ এখনও কত সুন্দর লাগছে! ওই তো মিস কেলি, আমাদের ক্লাসটিচার; খুব ভালোবাসতেন আমাকে। আবার ডাকটা শোনা যাচ্ছে, কোথায় ডাকছে… কোথায়...কোথায়...কোথ...আরে ওই তো মিস্টার হেনরি ওলশান, আমাদের পি.টি. টিচার। এ বাবা, ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, আর আমি আবার লেট। যাই তাড়াতাড়ি...তাড়া...তাড়ি...তা...



আ...আমি কোথায়? আর ঘুমোতে ভাল লাগছে না। বন্ধুরা কতদিন আসেনি, খেলা হয়নি; আচ্ছা কাঠবেড়ালির বাচ্চাটা এখন ঠিক আছে? ও কি খেলছে এখন? তোমরা কি কেউ জানো? আর, আর আমার চিঠিগুলো, যেগুলো আমি প্রতি সপ্তাহে বাবাকে দেব বলে লিখতাম আর তারপর ট্রাঙ্কে গুছিয়ে রেখে দিতাম একবারে সারপ্রাইজ দেব বলে? জানো? জানো না, না!...আমি কোথায়...

“নাদিয়া, আমার ডার্লিং...”

বাবা! বাবা এসেছে! এটা তো বাবার গলা! এরকম আদুরে গম্ভীরভাবে একমাত্র বাবাই ডাকতে পারে। বাবা, কোথায় তুমি, কোথায়? আমি তোমার কাছে যাব। আমি...আমি চলতে পারছি না কেন? বাবা আমি তোমার কাছে যাব। আমি চলতে পারছি না...আমি...তোমার কাছে...



আহ...জানো আজ আমার খুব আনন্দের দিন। আজ আমি ছুটি পাব। আমার ছুটি হবে। তারপর, চকোলেট কেক খেতে খেতে আমি, বাবার কাছে যাব। জানো, কালকে বাবা এসেছিল। কতদিন পর বাবাকে দেখলাম! সেই কোন ছোট্টবেলায় বাবা কাজে চলে গেল; আর তো দেখলামই না। কাল কত গল্প হয়েছে, বাবা বলেছে যে ছুটির পর আমায় বেড়াতে নিয়ে যাবে। অনেক নতুন নতুন জায়গা দেখাবে, যেখানে কেউ যায়নি আগে; সেখানে শুধু আমি থাকব, আর বাবা...আমি...আর, বাবা...

ওই যে কারা আসছে। এবার আমার ছুটি হবে। মা, তুমি কাঁদছ কেন? আরে, আমি তো বাবার কাছেই আছি। তোমাকেও নিয়ে যাব, গল্প করব ঘোরার। ওই তো বাবা এসে গেছে; বাবা, দাঁড়াও আমি আসছি, একটু ড্রেস করে নিই। তারপর আমরা যাব...আসছি তাহলে...          

ভীষ্মমৃত্যু : ঈশানী বসাক

সূর্যের উত্তরায়ণের পূর্বে আমি দেহত্যাগ করব না, বলেছিলেন মহামতী ভীষ্ম। নিজের শরীরের অধিকার ছাড়েননি। শত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে নির্দিষ্ট করেছিলেন আসা যাওয়ার পালা। আমাদের মৃত্যু বড় আকস্মিক, অস্থির। যেন খরস্রোতা নদী। অর্গলহীন ভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের নুড়ি পাথরের মতো।
"ফাড্ডিল পাথর বিচুরিল বজ্রনাঁদে
মুকল ণই বাহী তহি কলঅল সাঁদে"

ইচ্ছামৃত্যু মানে আত্মহত্যা নয়। নিজের শরীরকে বিদায় জানাবার সঠিক প্রস্তুতি। তার অপভ্রংশ আত্মহত্যা। শত পুত্রের মৃত্যুকে মেনে নিতে না পেরে মহামহিম বশিষ্ঠ মৃত্যুর কাছে যেতে চেয়েছিলেন। বুঝতে পারেননি যে ইচ্ছামৃত্যুর কিছু নিয়ম আছে। আবেগ নয় তা ঠিক করতে হয় মস্তিষ্ক দ্বারা। যেমন ভীষ্ম নিজের মৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন যেদিন তিনি অনুধাবন করেছিলেন তার কাজ শেষ হয়ে এসছে। শোক ছিল অবশ্যই তাঁর। তবে সে তো বহু আগে থেকেই। যেদিন দুর্যোধন রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে পাশা-নির্বাচন করেছিলেন সেদিন। যেদিন কৃষ্ণের শান্তিচুক্তির প্রত্যুত্তরে দুর্যোধন বলেছিলেন এক সূচাগ্র মাটি তিনি ছাড়বেন না, তা সে যতই প্রাপ্তি হোক। অসাধারণ মতিভ্রংশ ধৃতরাষ্ট্রের, কুরুবংশের শেষ প্রদীপের প্রণিপাত কিছুই পারেনি তাকে টলাতে। তিনি ঠিক সেই লগ্নকে বেছে নিয়েছিলেন যেদিন যুদ্ধশেষে কেউ ন্যায় পেয়েছিলেন। ক্লেশজনিত কারণে আত্মহত্যা পাপ তা শাস্ত্রমতে লেখা। দাবানলে যখন ধৃতরাষ্ট্র আত্মাহুতি দেন তখন গান্ধারী এবং কুন্তী তাকে অনুসরণ করেন। সহমরণ নয়, জীবনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে সত্যই তাই শরীরের অধিকার প্রকৃতিকে দেওয়া উচিত তাঁরা মনে করেছিলেন। 

জীবনে আত্মহত্যার কথা ভাবিনি, ইচ্ছামৃত্যু ভেবেছি। তবে কেমন হত তুমি বলো তো? এ প্রশ্ন ভীষ্মকে পড়ে এসছে। আমি তাই ইচ্ছামৃত্যু বলিনা। বলি ভীষ্মমৃত্যু। অধিকারবোধ স্থানান্তরের আরেক নাম শরীর। সত্যি করে বলুন তো কেউ কখনো কি ভাবেননি আমি ছাড়া এ পৃথিবী কেমন। জানি অস্বীকার করবেন তবু বলছি। পাগলের প্রলাপ ভেবে সহ্য করে নেবেন। বড় অসহ্য লাগবে তাই ক্ষমা চাইলাম। আমরা সবথেকে বেশি নিজের মৃত্যুর কথায় পুলকিত হই নিজের প্রিয়জনের সঙ্গে থাকাকালীন। কল্পনা করি আমি না থাকলে ও কী করবে। চোখ দিয়ে জল বয়ে গেলে এক বিষাদাচ্ছন্ন পাহাড় নেমে আসে। তখন নিজেই নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করি, করুণভাবে প্রশ্ন করি, "মথুরা নগরপতি কাহে তুম গোকুল যাও।" বৈধ কে জানি না। তবে আমাদের চেতনার রঙ অবৈধ বৈধ এসব মানেনা। বড় অবাধ্য সে। এই দুঃখবিলাসের পর আমরা ভাবি নাহ্ সে বড় কষ্ট পাবে। তাই এহেন যেন না ঘটে। ব্রহ্মার ক্রোধ থেকে মৃত্যুর জন্ম। তার কত রূপ। এই দেবীকে নিয়ে আমাদের পাপ পুণ্যের হিসেব মেলাই। ভীষ্মমৃত্যু পাওয়ার আবেগে পড়ে থাকি ভেন্টিলেশনে। নিজের হৃদয় চেপে ধরে তাকে বলি ছেড়ে দেব না। উত্তরায়ণের লগ্ন পেরোয়। আমাদের চলে যাওয়া হয় না। শরীরের উপর অধিকার নিতে গিয়ে আমরা আত্মহত্যাকে জেতাই। সব কিছু মৃত্যুর মতো শেষ নাকি শুরু? উদ্বেগ জমাচ্ছি না। চলে যাওয়ার ভারসাম্য রেখে ছুটি। আজ হয়তো শেষ দিন। আরেকবার খালি সূর্যোদয় দেখে নিই।

আখের খেতে ঢুকেছে এক চোর শেয়াল : জয়ন্ত ঘোষাল

মালওয়া উপজাতিদের দেশ মালওয়া প্রদেশ। মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ অংশের আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের পাথর জমে তৈরি এই মালভুমি পৃথিবীর প্রাচীনতম একটি জনপদ। ৪৭-এর আগে এর এক নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় ছিল। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের মালওয়া এজেন্সি মধ্য ভারত, যাকে মালওয়া ইউনিয়ন বলা হত, তার সঙ্গে মিশে যায়। রাজনৈতিক সীমারেখা বরাবরই ভঙ্গুর...একটি জনপদের রূপরেখা কী রাজনৈতিক ম্যাপ বলে দেয় না তার সাংস্কৃতিক প্রভাব? মালওয়ার ক্ষেত্রেও বারবার তাই ঘটেছে। মহাকবি কালিদাস আর লেখক ভারতিহরির দেশ এই মালওয়া নিজস্ব ও অনন্য নৈসর্গিক আর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে এই দেশের মুলধারার সংস্কৃতিকেই সিঞ্চিত করেছে হাজার হাজার বছর ধরে। আর লোকায়ত নাচগানের মাদকতা! অবনঠাকুরের রাজকাহিনির ভিল সর্দার আর শোলাঙ্কি রাজকুমারির ঝুলন খেলা হয়েছিল এই মালওয়ার কোন নাম না জানা পাহারের কোলে তা ভেবে রোমাঞ্চ হয়! সমুদ্র থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উঁচু এই মালভূমি দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে আনত। চম্বল নদী আর নানা শাখা ও উপনদী এর দক্ষিণ অংশকে স্নাত করেছে। পশ্চিমে মাহি নদী। চোখ বুজলেই রণঝংকার আর গুপ্ত কী মৌর্য যুগের কথাকাহিনির উজ্জয়িনী আর আজকের নব্য শহর ইন্দর। মাদকতা এর রক্তে...তাই আফিমের মৌতাত! একদিন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আফিম চাষ হত নাকি এখানে। মধ্যপ্রদেশের দিওয়াস, ধর, ইন্দর, ঝাবুয়া, মান্দসাউর, নিমাচ, রাজগড়, রাতলাম, সাজাপুর, উজ্জয়িনী, আর গুনা ও সেহরের কিছু অংশ, রাজস্থানের ঝালোয়ার জেলা ও বান্সাওয়ারান্দ আর চিত্তগড় জেলার কিছু অংশ মালওয়ারের ভেতর পড়ে। এর উত্তর-পুর্বে হাতোদি আর উত্তর-পশ্চিমে মেওয়ার। পশ্চিমে ভাগাড় আর গুজরাট। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের শিলায় তৈরি মালভুমিতে নানা উপজাতিদের বাস হাজার হাজার বছর ধরে। রাজস্থানী মারাঠি গুজরাটি লোকায়ত সংস্কৃতি একে পুষ্ট করেছে। যদিও এখন আর তেমন চল নেই হিন্দির দাপটে তবু মালওই বলে একটি আঞ্চলিক ভাষা আছে যা হয়ত বিলুপ্ত হবে তাড়াতাড়ি আরও অনেক আঞ্চলিক ভারতীয় ভাষার মতোই। যেমন ভুলতে বসেছি খ্রীষ্টপুর্ব ৫০০ বছর আগের অভন্তি রাজ্যের কথা। পঞ্চম শতকের গুপ্তযুগে মালওয়ার স্বর্ণযুগ ছিল। মধ্যযুগে মারাঠারাও বরাহমিহির আর ভোজ্ রাজের স্মৃতিচিহ্ন মাখা মালওয়া শাসন করেছে। সেই হারিয়ে যাওয়া জনপদ খুঁজে পাওয়া যাবেনা আজকের রাজনৈতিক ম্যাপে— জাতিগত বিদ্বেষে দীর্ণ এই দেশকে আজও খুঁজে পেতে হলে আমাদের লোকায়াত শিল্পের হাত ধরতে হয়— নাচে গানে ছবিতে তাদের দেশজ গন্ধে সব সীমারেখা মুছে যায়। সেখান থেকেই আসে লাভনি নাচের কথা।

লাভনির নাচনিরা মূলত দলিত সম্প্রদায়ের— ভাতু, কালোয়াত, কোলহাতি, মাহার, মাতাঙ আর ডোমবারি এইসব দলিত গোষ্ঠির লোক, অথচ সেই গানের গীতিকাররা বা শাহিরিরা বেশিরভাগ উচ্চবর্ণের লোক।এখানেই এই নাচের সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কৌম রাজনীতির সঙ্গে প্রথাগত শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত দলিত মেয়েদের নিজস্ব যৌনমুক্তি ও পুরুষতান্ত্রিকতাকে নস্যাৎ করার প্রয়াস। লাভনির সুত্র খুঁজতে গিয়ে ১৩ শতকের কাছাকাছি পৌঁছতে হলেও মুখ্যত ১৯ শতকের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পেশোয়াদের আর পশ্চিম মহারাষ্ট্রের মারাঠা শাসকদের আনুকুল্যে এর প্রচার ও প্রসার বাড়ে। পরবর্তীকালে মধ্যবিত্তের আমোদপ্রমোদের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর ফিল্মের মতো গণমাধ্যমেও নানা ভঙ্গীতে, কখনও বিকৃত রুপেও— লাভনি যৌনতার উদ্দামতাময় দ্বর্থ্যবোধক শব্দের জাদুতে, ঢোলকের আওয়াজ আর নাচনিদের পায়ের মলের দ্রুত তালে মাতাতে থাকে। যদিও ১৯৪৮-এ মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বালাসাহিব খেরের জমানায় লাভনি আর তামাশাকে ব্যান করা হয়, যা দুবছর পর তুলে নেওয়া হলেও ‘আন্ধারি লাভনি’ বা ‘অন্ধকারের লাবণ্য’কে বাতিল করা হয়। এই অন্ধকার হল মধ্যবিত্তের যৌনতার প্রতি বিরূপ ভাবনার দ্যোতক। সরকারের মত ছিল লাভনিকে ভদ্র হতে হবে। কী হাস্যকর এই প্র্য়াস। স্যানিটাইজড করার চেষ্টা হল লোকশিল্পের ডানা ছেঁটে। লাভনির গানের যেসব শব্দে সরাসরি যৌনতার কথা আছে, আছে যৌনক্রিড়ার ভঙ্গীর কথা, বা পুরুষের বহু নারীসঙ্গের ব্যাভিচার কী পুরুষত্বহীনতা নিয়ে অথবা যেখানে পুরুষতন্ত্রকে শ্লেষের সঙ্গে ব্যঙ্গ করা হয় যে গানে, সেই সব হল ওই ‘অন্ধকারের’ অংশ। নীতিবাগিশদের লাভনির দিকে আঙুল তোলা দেখে বিশ্বাস করা কঠিন যে এদেশেই খাজুরাহ কোনারক তৈরি হয়েছিল। কেবল যৌনতামাখা কথাই নয় আর পাঁচটা লোকশিল্পের মতোই সমাজের সকল সুখদুঃখের পাঁচালি বলা হত— জাত-পাত কী ধর্মীয় বিভাজন থেকে রাজনীতি এমনকী প্রেম ও যৌনতা কিছুই অচ্ছুত ছিল না। কখনও তা যেন তর্জার মতোও। ঢোলকের অসম্ভব দ্রুত তালে নাচনিরা নাচে আর শরীরের বিভঙ্গ বা নানান ঝটকা-মটকা, যার অক্ষম নকল করে মুম্বাই-সিনেমার কোরিওগ্রাফাররা।

সম্প্রতি জে এন ইউ’র গবেষক ও নৃত্যশিল্পি সেজেল যাদব এক সাক্ষাৎকারে তাই বলেছেন, “আমার গবেষণা চলাকালীন একটা ঘটনা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেছিলাম। আমি বেশ কিছু নাচনির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন একজন বলল, স্টেজে তাদের নাচে্র তালে যৌনভঙ্গি আনতে হবে তখন পুরুষ নাচিয়ে হস্তমৈথুনের ভঙ্গি করবে সর্বসমক্ষে। আমি রাগে ফুটছি একথা শুনে। কিন্তু নাচনিরা বলল প্রথম প্রথম এগুলো অসুবিধা করলেও আদপে তো এগুলো অভিনয় এবং সেটা চালিয়ে যেতে হবে। আমাকে অনেক নাচনিই বলেছে বার বার প্রশিক্ষণ নিয়ে এইসবে ধাতস্থ হয়ে যায় ফলত যাই ঘটুক অভিনয়টা চালিয়ে যেতে পারে। যেটা শুনে আমি লাভনির দলগুলো কতটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছে সে ব্যাপারে আবার পুর্নমূল্যায়ন করতে লাগলাম।” লাভনি নাচের নাচনি যেমন তাদের গানে দূরবর্তী প্রেমিকের জন্যে তার শরীরী কামনাকে মুক্ত কন্ঠে ব্যাক্ত করে তেমন এর মধ্যে বিচ্ছেদ দুঃখ বিপন্নতার কথাও বুনে দেয় কারণ এইসব দলিত মেয়েদের সেই পেশোয়ার সময় থেকে বেচা হয়েছে প্রায় বিনামূল্যের বেগারখাটা শ্রমিক হিসেবে আর যখন খুশি যৌন ইচ্ছা মেটানোর জন্যে। তাই উচ্চবর্ণজাত গীতিকারেরা গানের মধ্যে পেশোয়াদের আর মারাঠা শাসকদের যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটানোর সফল কারিগর হয়ে নিম্নবর্গের নাচনিদের সেভাবে গড়ে তুলেছে। এইসব নাচনিদের বিয়ে হত না। মঞ্চে মঞ্চে নেচে নেচে যৌবন বয়ে যেত। তাই নাচনিরাও নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজেছে নিজেদের মতো করে। যদিও আধুনিক সমাজে শেষমেষ ধিকৃত হয়েছে তারা। বিষয়টা ক্রমে আরও জটিল হয়ে ওঠে। বাবাসাহিব আম্মেদকরও লাভনির বিরুদ্ধে গেছিলেন, কারণ তার মতে উচ্চবর্ণের লোকেরা দলিত মেয়েদের লাভনির প্রসারের ছলে বেশ্যা বানিয়েছে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের সুইডিস পন্ডিত তোর আন্দ্রে বলেছিলেন “we need to become acquainted with great personalities of the world religions in those garments in which the pious faith of the followers have clothed them…something of the magic of their personalities which we might not understand in any other way, speaks to us through the poetry of faith”। লোকসাহিত্য ও সংষ্কৃতিকে যুগোপো্যোগী করার চেষ্টায় বা যুক্তিবাদের ঘেরাটোপে শুদ্ধিকরণ করতে গিয়ে যদি বাউল থেকে দেহতত্ত্ব বা বৈষ্ণব পদ থেকে রাধার প্রেমিক কৃষ্ণের অবতাররূপের বিশ্বাসকে হটিয়ে দিই তবে রসাস্বাদনের জন্য কী পড়ে থাকে? আর  দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে লাভনির মতো লোকায়ত নাচের ধারা একটা রূপ পেয়েছে, তাকে বন্ধ করাটাই একমাত্র রাস্তা, নাকি দক্ষিণের দাসী-নাট্যমের মতো এর উত্তরণ ঘটবে তা নিয়ে এখন সেজেলের মতো অনেকেই বলছেন। বস্তুত দাসী-নাট্যমও মন্দিরের দেবদাসীদের নাচ এবং সেখানেও যৌনতার বিশেষ অংশ ছিল। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ও উদয়শংকরদের উদার চোখে তা স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তা ভারতীয় নাচের চিরায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলতে পেরেছে। লাভনিকে স্যানিটাইজ না করেই নাচনিদের অভিনয় কলাকে স্বীকৃতি দিয়ে ও তাদের শিল্পীর সম্মান দিয়ে কীভাবে মধ্যমেধার মর‍্যালিটির তোয়াক্কা না করে উন্নীত করা যায় তা নিয়ে অনেকেই এখন সরব হচ্ছেন। যে প্রধান প্রশ্নগুলো উঠে আসছে তা হল লাভনি কোথায় অভব্য বা অশালীন? কী করে পপুলার সিনেমাতে লাভনিকে ব্যবহার করেও শিল্পের আসন দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া শৃঙ্গারিক, আধ্যাত্মিক আর পোয়াড়া বা ব্যালাড লাভনির এই যে তিন ধারা তার মধ্যে কোনটাকে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে ও গেলে কীভাবে। এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এই ডিসেম্বরেই মুম্বাইতে গোদরেজ ইন্ডিয়া ক্লাবে লাভনি নিয়ে ওয়ার্কশপ ও অনুষ্ঠান হয়ে গেল। ডকুমেন্টরি ফিল্ম ‘নাটালে তুমচাসাথিতে’(সুশোভিত পর্দার আড়ালে) তাই এক নাচনি বলে, “লোকেরা ধ্রুপদী নাচের নাচিয়েদের সম্মান করে কিন্তু আমাদের করে না কেন?” গবেষক সাবিত্রী মেধাদুল ও ভূষণ কোরগাঁওকরের ‘সঙ্গীত বারি’ বলে ২০১৪-তে প্রকাশিত বইটিতে এইসব নাচনিদের নিয়ে অনেক বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। গত বছর তাঁরা শকুন্তলা নাগারকর, মোহনাবাই মহালঙ্গেরকর নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন, সেখানে শিল্পীরা নাট্যানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও নিজেদের জীবন নিয়ে বলেছেন। এবছর বিশিষ্ট মারাঠি নাট্য ব্যাক্তিত্ব সুষমা দেশপাণ্ডের লেখা ‘তিচিয়া আইচি ঘোস্ত আরহাত মাজহা আথভানিচা পাহাদ’ বা ‘এক মায়ের অভিনয়ের স্মৃতি’ শীর্ষক নাট্যরূপে রাজশ্রী সাওয়ান্ত ওয়াড় অভিনয় করেছেন।

(চলবে...)