মুখেচোখে কথা নিয়ে এই পৃথিবীতে বেড়াতে আসে যারা, কুটনো কুটতে আসে, তাদের একজন ছিল আমার দিদা। সেই দিদা রোগে পড়ল। দিনে ছ'ঘন্টা রেয়াজ তখন আমার। আর রাত্তিরে খাওয়াটাওয়া সেরে, দরজায় ছিটকিনি দিয়ে একঘন্টা বিস্তার প্র্যাকটিস। সেই একঘন্টার ঘড়িধরা টাইমের মধ্যে ঢুকে পড়তে চাইত দিদা। 'ম্লান আলোকে ফুটলি কেন গোলোকচাঁপার ফুল' গেয়ে শোনাবার আব্দার নিয়ে। বলত, 'নানালোকের পুঁটলি'টা একবার গা না টিংকু। মাঝেসাঝে খুলতাম ছিটকিনি। গেয়ে শোনাতামও। মেজাজ বিগড়ে থাকলে খুলতাম না। বলতাম, যাও তো। সেদিনও খুলিনি। দিদা বারবার বলছিল, খোল না টিংকু। গানটা শুনেই চলে যাব। মাকালীর দিব্যি। দরবারী নিয়ে পড়েছি তখন। গলায় জোয়ারি আনার জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছি। খেঁকিয়ে উঠেছিলাম। যাও তো। পরদিন সকালে দিদা চলে গেল। একদম। ব্লাড ইউরিয়া ছিল। তিনশো সাড়ে-তিনশো প্রেশার। বছরে তিনবার হসপিটাল হত। যমে-মানুষে হত। দিদা মরে যাবার পর তোশকের তলা থেকে এত এত শুকনো পানপাতা বেরিয়েছিল। পরে অনেক ভেবেছি, বছর বছর মরতে মরতে ফিরে আসা দিদা কি তবে ইচ্ছেমৃত্যু বেছে নিয়েছিল? আদরের নাতনির মুখঝামটা নিতে পারেনি সেদিন?
দিদা মারা যাওয়ার আগের রাতটাকে যদি রিওয়াইন্ড করা যেত? তাপস মরে যাওয়ার আগের কয়েকটা ঘন্টা? আমার অনলাইন অ্যালবামের পেজ লাইক করে, চারঘন্টা পরে মরে গেল তাপস। মই উঠিয়েছিল দোতলায়। ছেলেকে এসএমএস করেছিল, কাল তুমি অনেক বড় হয়ে যাবে (এরকমই একটা জঘন্য কিছু)। আমি তখন জেগে। ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি ফেসবুকে। ভোর চারটে অব্দি কবিয়ালের চ্যাটরুমে মহাভারত লিখছি দুজনে। আর তার মধ্যেই তাপস মই থেকে সরিয়ে নিচ্ছে পা। শেষবারের মতো কেঁপে উঠে স্থির হয়ে যাচ্ছে। একদম। মাসখানেক আগে ফোন এসেছিল তাপসের। কবে কলকাতায় আসবি বল তো। অনেক কথা আছে। তারও বছর কয়েক আগে, এরকম আরেকটা ফোন। প্রমোদদা। কবি প্রমোদ বসু। একদিন ব্যান্ডেল যাব মিতুল। কথা আছে অনেক। তারপরই আনন্দবাজারের সেই খবরটা। আত্মঘাতী প্রৌঢ়। না, কবি না। শুধু প্রৌঢ়। আনন্দবাজারে চাকরি করতেন প্রমোদদা। একটা সেন্টেন্সও খরচা নয় সেই খাতে।
কী ছিল সেই অনেক কথা? জানা হয়ে উঠল না আর। অনেক অনেক কথা নিয়ে প্রমোদদা, তাপসরা ভাগিরথীর জলে মিশে গেছে। যাকে বলে হুগলী নদী। ভালোনাম যার মাগঙ্গা। মিশে গেছে সুমিতা। মায়া টেনেছিল ওকে। মায়া অ্যাঞ্জেলো। বালি ব্রীজ থেকে খসে পড়েছে টুপ করে। নীচে কলুষনাশিনী। ঘরে বাপ-মা মরা একফোঁটা মেয়ে। মিশে গেছে অমিতেশদাও। ডুবে গেছে নীলাচলের অতলান্তে। অনেক গল্প বাংলাবাজারে উড়েছে সেসময়। ওটা কি ইচ্ছেমৃত্যু ছিল?
ইচ্ছেমৃত্যুর অধিকার নিয়ে লড়াই হচ্ছে। হাইকোর্ট সুপ্রীমকোর্ট হচ্ছে। গুগল জানিয়ে দিচ্ছে কোন কোন দেশ অলরেডি পেয়ে গেছে গ্রিন সিগন্যাল। আমাদের দেশের নাম সেই লিস্টে দেখে, তা একটু এলিট এলিটও লাগছে আর কী। আত্মহত্যা আর ইচ্ছেমৃত্যু, একই জীবনের শেষের কবিতা। অলমোস্ট স্বরচিত। পদ্ধতিটাই যা একটু আলাদারকম। যদিও আত্মহত্যা সিগন্যাল পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। মহাপাপ বলে দাগিয়ে দিয়েছে যে শাস্ত্র। ওদিকে টিমটিম করতে করতে টিঁকে আছে, বলা ভালো বেঁচে মরে আছে যে, গুজারিশ সিনেমার হৃত্বিক রোশনের মতো, সে চাইলে ইচ্ছেমৃত্যুর টিকিট কাটতেই পারে। এ তো শিকলি কেটে, খাঁচার দরজা ভেঙে, প্রাণপাখিটি উড়িয়ে দেবার মতোই। যদিও একটা বিটকেল প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে। যন্ত্রণাসর্বস্ব শরীর, সে কীভাবে জানাতে পারে তার ইচ্ছের কথা? হৃত্বিক অবশ্য হুইলচেয়ারে ঘুরে ঘুরে রেডিয়োয় টকশো করা থেকে নিজের ইউথানেশিয়ার জন্য চেঁচানো থেকে মরার আগে বিয়ে অব্দি সবই করেছে। সিনেমার বাস্তব আর জীবনের বাস্তব এক হলে কেমন হত? শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে মনে পড়ে। তখন ক্যান্সার। শেষদিকে। বিছানায় মিশে যাওয়া শরীর। শরীরের সমস্ত যন্ত্রণা চোখে। যে চোখ ভোলা যায় না। হৃত্বিক রোশনের হুইলচেয়ারে শ্যামলদাকে, কুমুদজেঠু, পোলারের বাবা, সুরজিতের দিদি, দীপান্বিতার মা, সিধুদার শ্বশুরকে যদি বসিয়ে দিতে পারতাম। পারত ওরা? চাইতে পারত মুক্তি? গলা ফাটিয়ে? আমরা ওদের মুক্তি দিতে পারতাম? এও মায়া। মায়া অ্যাঞ্জেলো না। মায়ার সংসার। সন্ধ্যারাণী। সর্বস্ব খুইয়েও প্রিয়জনের শরীরটুকু আঁকড়ে থাকা। শরীরের মায়া বড় মায়া। দিদা বলত। যদ্দিন মানুষটা আছে, থাক। আহা।
চোখের সামনে একটা মানুষকে দেখেছিলাম। আরেকজনের অসুখ শরীরে নিয়ে চলে যেতে। এত প্রমিনেন্ট ইচ্ছেমৃত্যু আর দেখিনি। মাঝেমধ্যেই আসত বাড়িতে। রাত্রিবেলা থেকে যেত। তাকে পাশবালিশ করে ঘুমোতাম। একদিন, ভোর চারটে তখন, দেখি, উঠে বসে মাথায় হাত বোলাচ্ছে আমার। বলল, ভোরবেলা চলে যাব, তুই তখন ঘুমোবি, দেখা হবে না। সেই শেষ দেখা। উভয়ত। এরপর ড্রিমল্যান্ড নার্সিংহোমে। কোমায়। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, যেও না। চলে গেল। যাইনি আশ্রমে। ঘরের আলো নিভিয়ে, চোখ বন্ধ করে, ভুলে যাওয়া মন্ত্র মনে করার চেষ্টা করছি। আলো হয়ে উঠল ঘর। পরিষ্কার বুঝলাম। যে মৃত্যু বিচ্ছেদ নয়, যে জীবন ছেড়ে যায় না, তার আলো জ্বলে উঠল আমার ঘরে।
আমি চোখ খুললাম না আর।
দিদা মারা যাওয়ার আগের রাতটাকে যদি রিওয়াইন্ড করা যেত? তাপস মরে যাওয়ার আগের কয়েকটা ঘন্টা? আমার অনলাইন অ্যালবামের পেজ লাইক করে, চারঘন্টা পরে মরে গেল তাপস। মই উঠিয়েছিল দোতলায়। ছেলেকে এসএমএস করেছিল, কাল তুমি অনেক বড় হয়ে যাবে (এরকমই একটা জঘন্য কিছু)। আমি তখন জেগে। ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি ফেসবুকে। ভোর চারটে অব্দি কবিয়ালের চ্যাটরুমে মহাভারত লিখছি দুজনে। আর তার মধ্যেই তাপস মই থেকে সরিয়ে নিচ্ছে পা। শেষবারের মতো কেঁপে উঠে স্থির হয়ে যাচ্ছে। একদম। মাসখানেক আগে ফোন এসেছিল তাপসের। কবে কলকাতায় আসবি বল তো। অনেক কথা আছে। তারও বছর কয়েক আগে, এরকম আরেকটা ফোন। প্রমোদদা। কবি প্রমোদ বসু। একদিন ব্যান্ডেল যাব মিতুল। কথা আছে অনেক। তারপরই আনন্দবাজারের সেই খবরটা। আত্মঘাতী প্রৌঢ়। না, কবি না। শুধু প্রৌঢ়। আনন্দবাজারে চাকরি করতেন প্রমোদদা। একটা সেন্টেন্সও খরচা নয় সেই খাতে।
কী ছিল সেই অনেক কথা? জানা হয়ে উঠল না আর। অনেক অনেক কথা নিয়ে প্রমোদদা, তাপসরা ভাগিরথীর জলে মিশে গেছে। যাকে বলে হুগলী নদী। ভালোনাম যার মাগঙ্গা। মিশে গেছে সুমিতা। মায়া টেনেছিল ওকে। মায়া অ্যাঞ্জেলো। বালি ব্রীজ থেকে খসে পড়েছে টুপ করে। নীচে কলুষনাশিনী। ঘরে বাপ-মা মরা একফোঁটা মেয়ে। মিশে গেছে অমিতেশদাও। ডুবে গেছে নীলাচলের অতলান্তে। অনেক গল্প বাংলাবাজারে উড়েছে সেসময়। ওটা কি ইচ্ছেমৃত্যু ছিল?
ইচ্ছেমৃত্যুর অধিকার নিয়ে লড়াই হচ্ছে। হাইকোর্ট সুপ্রীমকোর্ট হচ্ছে। গুগল জানিয়ে দিচ্ছে কোন কোন দেশ অলরেডি পেয়ে গেছে গ্রিন সিগন্যাল। আমাদের দেশের নাম সেই লিস্টে দেখে, তা একটু এলিট এলিটও লাগছে আর কী। আত্মহত্যা আর ইচ্ছেমৃত্যু, একই জীবনের শেষের কবিতা। অলমোস্ট স্বরচিত। পদ্ধতিটাই যা একটু আলাদারকম। যদিও আত্মহত্যা সিগন্যাল পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। মহাপাপ বলে দাগিয়ে দিয়েছে যে শাস্ত্র। ওদিকে টিমটিম করতে করতে টিঁকে আছে, বলা ভালো বেঁচে মরে আছে যে, গুজারিশ সিনেমার হৃত্বিক রোশনের মতো, সে চাইলে ইচ্ছেমৃত্যুর টিকিট কাটতেই পারে। এ তো শিকলি কেটে, খাঁচার দরজা ভেঙে, প্রাণপাখিটি উড়িয়ে দেবার মতোই। যদিও একটা বিটকেল প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে। যন্ত্রণাসর্বস্ব শরীর, সে কীভাবে জানাতে পারে তার ইচ্ছের কথা? হৃত্বিক অবশ্য হুইলচেয়ারে ঘুরে ঘুরে রেডিয়োয় টকশো করা থেকে নিজের ইউথানেশিয়ার জন্য চেঁচানো থেকে মরার আগে বিয়ে অব্দি সবই করেছে। সিনেমার বাস্তব আর জীবনের বাস্তব এক হলে কেমন হত? শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে মনে পড়ে। তখন ক্যান্সার। শেষদিকে। বিছানায় মিশে যাওয়া শরীর। শরীরের সমস্ত যন্ত্রণা চোখে। যে চোখ ভোলা যায় না। হৃত্বিক রোশনের হুইলচেয়ারে শ্যামলদাকে, কুমুদজেঠু, পোলারের বাবা, সুরজিতের দিদি, দীপান্বিতার মা, সিধুদার শ্বশুরকে যদি বসিয়ে দিতে পারতাম। পারত ওরা? চাইতে পারত মুক্তি? গলা ফাটিয়ে? আমরা ওদের মুক্তি দিতে পারতাম? এও মায়া। মায়া অ্যাঞ্জেলো না। মায়ার সংসার। সন্ধ্যারাণী। সর্বস্ব খুইয়েও প্রিয়জনের শরীরটুকু আঁকড়ে থাকা। শরীরের মায়া বড় মায়া। দিদা বলত। যদ্দিন মানুষটা আছে, থাক। আহা।
চোখের সামনে একটা মানুষকে দেখেছিলাম। আরেকজনের অসুখ শরীরে নিয়ে চলে যেতে। এত প্রমিনেন্ট ইচ্ছেমৃত্যু আর দেখিনি। মাঝেমধ্যেই আসত বাড়িতে। রাত্রিবেলা থেকে যেত। তাকে পাশবালিশ করে ঘুমোতাম। একদিন, ভোর চারটে তখন, দেখি, উঠে বসে মাথায় হাত বোলাচ্ছে আমার। বলল, ভোরবেলা চলে যাব, তুই তখন ঘুমোবি, দেখা হবে না। সেই শেষ দেখা। উভয়ত। এরপর ড্রিমল্যান্ড নার্সিংহোমে। কোমায়। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, যেও না। চলে গেল। যাইনি আশ্রমে। ঘরের আলো নিভিয়ে, চোখ বন্ধ করে, ভুলে যাওয়া মন্ত্র মনে করার চেষ্টা করছি। আলো হয়ে উঠল ঘর। পরিষ্কার বুঝলাম। যে মৃত্যু বিচ্ছেদ নয়, যে জীবন ছেড়ে যায় না, তার আলো জ্বলে উঠল আমার ঘরে।
আমি চোখ খুললাম না আর।