ক্লোরোfeel-এর পাতা

Saturday, 7 January 2017

লেখা আমার মা : সন্দীপন চক্রবর্তী

২০১২-র গোড়ার দিকে এক সকালে, ৫০ বছরে পা দেয়ার আগেই, আচমকা বন্ধ হয়ে গেল জয়দেব বসুর ইহজীবনের হৃৎস্পন্দন। কিন্তু জয়দেব জানতেন মৃত্যু বিরতি মাত্র। দুখানি কোয়ান্টামধ্যে আপাতশূন্যতা। ২০১৩-র গোড়ায় তাই আমরা পেলাম তাঁর নতুন কাব্যগ্রন্থ কবিতা ২০০৬-২০১২। একটু খেয়াল করলে দেখব, কালচিহ্নিত এই বইয়ের মাত্র ২-৩টি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, মূলত ২০০৭ থেকে ২০১১ এই ৫ বছরের মধ্যে কবিতাগুলো লেখা। বইয়ের সূচনাকথায় শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন যে কীভাবে সম্ভব হয়ে উঠল এই বই, কীভাবে সাজানো হল।

বইটি ৩টি ভাগে সাজানো। প্রথমভাগের লেখাগুলিতে পাই বামপন্থায় বিশ্বাসী,  সি পি আই (এম)-এর দলীয় কর্মী এক জয়দেবকে, যিনি একইসঙ্গে তীব্র সমালোচনা করেন তাঁর দলীয় পন্থার, অথচ সেই দলকে ভালোওবাসেন তীব্রভাবে, যেখানে ফুটে ওঠে মূলত তাঁর সামাজিক মুখ। এখান থেকে যাত্রা শুরু করে বইয়ের শেষ তথা তৃতীয়ভাগে এসে পৌঁছাই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে, সেখানে প্রধান হয়ে ওঠে তাঁর ব্যক্তিমুখ। আর এই সামাজিক থেকে ব্যক্তিগতয় পৌঁছনোর জন্য তাদের মধ্যে সেতুবন্ধের মতো কাজ করে দ্বিতীয় অংশটি, যেখানে এই দুই মুখ এসে মিলে যায়। 

জয়দেব টের পাচ্ছিলেন – ‘বিপ্লবীরা নেতা হবে এবং নেতারা মানুষ হতে চাইবে না কোনওদিন! বুঝতে পারছিলেন চারিদিকের এই পরিব্যাপ্ত পল্লবগ্রাহী মিডিওক্রিটি, স্বার্থপর বচনপ্রিয় মিডিওক্রিটির চাবুক চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। এই মিডিওক্রিটির অংশ তো আমরাই। আমরা যারা কাজ করি না, বিপ্লব কপচাই, আমরা যারা নিজের, শুধু নিজেরটাকেই চাই। তাই আমরা সময়-সুযোগমতো ভোল পাল্টে ফেলি। আজ সেই আমরা সবুজ আবির, রানির এঁটো চাখছি, / সেই আমরা বনসাই, ফের শিকড় গেড়েই থাকছি। কিন্তু মানুষের মনের সঙ্গে যোগ হারিয়ে ফেলায় এই পরিবর্তনের আভাস পাননি বিপ্লবী থেকে শুধুই নেতা হয়ে ওঠা মানুষেরা। শুধুই ঘরে তোর ভোটার আছে কয়জনা-র হিসেব কষতে গিয়ে তাঁরা বুঝতেই পারেননি যে কাল মিছিলে হাঁটল যারা / ভাবছ আজকে দেবে তারা; / সাঁই হাসিছেন, এই তো লীলা / হাঁটছি কিন্তু দিচ্ছি না। কিন্তু দলের এসব ত্রুটিকে নির্মমভাবে আক্রমণ করা সত্ত্বেও জয়দেব নির্ভীকভাবে বলতে পারেন হ্যাঁ, আমি তো সিপিএম-টাই করি। / খিস্তি করো, কে কাকে আটকায়? / কিন্তু যাঁরা শ্রদ্ধেয়, সেই তাঁরা কি যান না? / বকুলবাগান রোডে? বলতে পারেন – ‘আমি উড়তেছি লাল-ঝাণ্ডায়, / আমার মন-ভোমরা বসছে সেখানে...। আর ঠিক এখানেই, এই পরিব্যাপ্ত ধান্দা আর ভণ্ডামির সময়েও নিজের রাজনৈতিক সততা দিয়েই, কিস্তিমাৎ করে যান তিনি। 

দীর্ঘকবিতায় বিশেষ দক্ষতা ছিল জয়দেবের। এই বইতেও জপেন-দা জপেন যা-১ বা দিন-ই-এলাহি বা প্ল্যানচেট-এর মতো কবিতায় পাই এমন এক দার্শনিক প্রস্থানবিন্দু, যা একই সময়গ্রন্থির ভিতর বেঁধে রাখে সমসময় আর ইতিহাসকে, অতল নিরাশার সঙ্গে বেঁধে রাখে আশার বিদ্যুল্লতা, মনোলগ বা কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে তৈরি করে তোলে এমন এক ডিসকোর্স, যা আমাদের ক্ষতবিক্ষত করে, ঠেলে দেয় আত্মানুসন্ধানের গহন অরণ্যে। ক্রমে ক্রমে জয়দেব নিজেও পেরিয়ে আসেন সেই অরণ্য। উত্তীর্ণ হন এমন এক বোধে, ক্ষতচিহ্নহীন আর মাল্যবান যেখানে সময়। 

কিন্তু ব্যক্তিজীবনের নানা হাহাকার, বিশেষত সন্তানের প্রতি অমোঘ টান অথচ তার সঙ্গহীনতা ভিতরে ভিতরে ফালাফালা করে দিয়েছিল জয়দেবকে। তাই তাঁর কলম লেখে – ‘আমার কোনো কথা নেই, আমার কোনো ভাষা নেই / শুধু জুরা; / আমার কোনো তৃষা নেই, আমার বিবমিষা নেই, / শুধু জুরা। আর এই লেখা যখন শেষ হয় আমার আর কেউ নেই, জুরা-র জন্য কেউ নেই, / যদি আমি...’ – এভাবে, তখন আলোচনার সমস্ত যুক্তি ফুরিয়ে গিয়ে, চোখের কোণে শুধু জেগে ওঠে ফোঁটা ফোঁটা রক্তবিন্দু। জয়দেব সেইজন্যই বড় কবি যে তিনি জানতেন কীভাবে ওই রক্ত আর অশ্রুকে শব্দে অনুবাদ করতে হয়। আর তাই বইয়ের শেষ কবিতায় এসে আর্তনাদের মতো বেজে ওঠে তাঁর স্বর – ‘লেখা আমার মা, / আমায় ছেড়ে যেন তুমি কোথাও যেও না। / এই যে এত আলস্য আর নিজেকে এত ঘৃণা, / ঘোষিত নির্বিবেক থেকে অমান-দক্ষিণা, / এ-সব থেকে নিষ্ক্রমণের কোথাও কোনো ভূমি / থাকলে পরে সেই মাটিতে পৌঁছে দিও তুমি। আর ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে – ‘মা কি আমি, আমিই তবে মা? / আমাকে ছেড়ে আমি যেন কোথাও যাই না  


কবিতা ২০০৬-১২
জয়দেব বসু
সপ্তর্ষি প্রকাশন
৭৫ টাকা

মনিকা : পার্থপ্রতিম ঘোষ

হিন্দি ফিল্মি গানের সঙ্গে বাবার বনিবনা ছিলনা একেবারেই। শক্ত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সে গানের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা ছিল আমাদের বাড়িতে। গানের সঙ্গে আমার ছোটবেলার ঘরকন্নায় তাই মূলত ছিল বাংলা গান, আর রবিঠাকুর ছিলেন সিংহভাগ জুড়ে। এমনক দ্বিজেন ও হেমন্ত মুখুজ্জে আমার কাছে প্রথম এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। একটা ছোট মার্ফি কোম্পানির রেডিও ছিল আমাদের বসার ঘরে, বুকসেলফের মাথায়। তার অনেক পরে, ফিলিপ্স কোম্পানির একটা রেকর্ড প্লেয়ার বাড়িতে যখন এল, আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। রেডির ডায়াল ঘুরিয়ে সক্কালবেলায় বাবা হয়তো ধরে ফেলতেন অমর পাল, তার কাপা কাপা জোয়ারিময় গলায় – ‘জাগোরে নগরবাসী’ অথবা নেমন্তন্ন আসত ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ সুবিনয় রায়ের গলায়। নয়তো হেমন্ত গাইতেন ‘প্রাঙ্গনে মোর শিরীষ শাখায়’, বা সুচিত্রা মিত্রর গলায় বাজত – ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। বাবা খেয়েদেয়ে অফিস চলে যাবার পর আমার মায়ের মুক্তি হত অনুরোধের আসরে, ‘আধুনিক গানে’। সেও বাংলা আধুনিক গান। মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখার্জ, সবিতা চৌধুরী, বনশ্রী সেনগুপ্ত, বা নির্মলা মিশ্র-র পাশাপাশি লতা বা আশাও আমার কাছে বাঙালিই ছিলেন দীর্ঘকাল। আর এরই ফাকে ফাকে, দৈবাৎ এক ঝলক খুশির হাওয়ার মতো, লালটুপি সান্তাক্লস-এর মতো হুড়মুড় করে এসে পড়ত আলপনা বন্দোপাধ্যায়ের “যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনা বিয়াবতী” বা সন সিংহের গলায়, ‘এক এক্কে এক’, গা ছম ছম করা – ‘ঠিক দুক্কুরবেলা ভতে মারে ঢিল’। 


এইভাবেই চলতে থাকে, কাচড়াপাড়ার রেল কোয়ার্টারে আমার মফস্বলী শৈশব ও বাল্যকালের সরল ও খুশি খুশি বাংলা রাজ্যপা, আর তার মধ্যে সম্ভ্রান্ত ও গম্ভীর দাড়িওলা মানুষ একজন এবং তার রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক গান স্থায়ী আসন পেতে বসে যান আমার মধ্যে। সেটা সত্তরের দশক হবে। বাড়িতে অজানা এক তিমির কাকু এসে থেকে গেলেন এর মধ্যে কোন এক দিন। অফিস থেকে ফিরে বাবা আর তিমির কাকু, কী সব কথা বলেন, বুঝিনা একটুও। আর কিছু মানুষ আসেন মাঝে মাঝে, নীচু গলায় কথা বলেন পরস্পর, তারপর চলে যান। বাবার মুখে একটু একটু শুনছি একটা অজানা নাম, ঘুরে ফিরেই। নকশাল! তিমির কাকু শুতে যাবার আগে আমাকে রোজ ডাকেন মশারির নীচে। গল্প শোনান, রবিন্সন ক্রুশোর বা কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টোর। এই সব আনন্দের রাজ্যপাটের ফাকফোকর দিয়ে কবে যেন দূরের এক নিষিদ্ধ নিশিডাক নিয়ে ঢুকে পড়েছিল নিকা। দূরে, পুজো-প্যান্ডেলের মাইকে ভেসে পাশের বাড়ির রেডিও থেকে নাকি কোন গা শির শির স্বপ্নপুরী থেকে ভেসে এসেছিল – ‘নিকা ও মাই ডারলিং, পিয়া তু অব তো আ যা’। গানের কথা পুরো বুঝিনি সেদিন, হিন্দি ভাষার সঙ্গে চেনাজানা হয়নি তখন। কিন্তু, রাহুলদেবের গলায় ঐ প্রতিধ্বনি হয়ে বয়ে যাওয়া মোনিকা ডাক, আশা ভোসলের তীক্ষ্ণ মদিরতাময় কন্ঠে বার বার উছলে ওঠা ‘পিয়া তু’, স্যাক্সোফোন আর অরগানে বেজে যাওয়া অর্কেস্ট্রেশনের মধ্যে একটা ক্যারাভান যাত্রার ইশারা নিয়ে ‘নিকা’ নামটা আমার বাল্যমনের গভীর অবচেতনায় ঢুকে পড়ল। জুড়ে গেল বাস্তুহারা করে দেবার অজানা এক ডাক, এডভেঞ্চারের ইশারা। এর মধ্যে একদিন তিমির কাকু আমাকে অনেক এডভেঞ্চারের গল্প শুনিয়ে, কোন এক মাঝরাত্রে আমাদের কোয়ার্টার ছেড়ে চলে গেলেন। সকালবেলায় বাবা খবর দিলেন – তিমির কাকু নেই, চলে গেছেন। দুদিন পর, মথুরা বিলের কাছের জঙ্গলে নাকি তাকে পাওয়া গেছিল। না, তাকে নয়, পাওয়া গেছিল তার শরীর।  তিনি চলে গেছিলেন অন্য কোন এডভেঞ্চারের দিকে। 


এর অনেক অনেক পরে, যখন আমার যুবা বয়েস, যখন আমি বাড়ির ঘেরাটোপ পেরিয়ে যাচ্ছি, বাবার হাত ছেড়ে দিচ্ছি, যখন আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত নাগরিক, তখন আবার এসে পড়লেন নিকা। বিস্ময়ের চোখ তখন খুলছে। সুনীল, সমরেশ, বিমল কর, রমাপদ বা শঙ্কর ছেড়ে আমার মধ্যে ঢুকছেন মানিক, কামু, কাফকা, দস্ত্যভস্কি বা মার্কোয়েজ। সত্যজিত, মৃণাল আর ঋত্বিক হাত ছাড়েননি বটে, কিন্তু অন্য দিগন্ত খুলছেন বেনেগাল, বা সথ্যু, আর পেন্টিং-এর মতোণি কাউল। দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ছেন  বার্গম্যান আর তার ভাস্করের মতো নারীরা – থুলিন, বা লিভ উলমান। আসছে ফেলিনির ম্যাজিক, নদীর মতো বহমান ডি সিকা, জাভাত্তিনি, রসেলিনি, আর  গুনে গুনে গোদার আসছেন বা ত্রুফো। কবিতার মতো পাসোলিনি আর ব্রেসো এলেন যেমন, সঙ্গীত ও পেন্টিং-এর মাঝামাঝি অবস্থানে এলেন আশ্চর্য তারকোভস্কি। এর মাঝখান দিয়ে গান্ধী ভবনের অন্ধকার হয়ে যাওয়া পর্দা থেকে ক্রমে ক্রমে বেরিয়ে এলেন তিনি। আমার বাল্যবয়েসের সেই দিনকাল থেকে আবার এসে পড়লেন নিকা। মনিকা ভিত্তি। তিনি  যতখানি আন্তনিয়নির, যতখানি তার সৃষ্টির সঙ্গে ওতোপ্রোত, ঠিক ততখানি আমারও ব্যক্তিগত। আশ্চর্য সমাপতনের মতো তিনি এলেন, গান নয়, শরীরী হয়ে এলেন আমার কাছে যে ছবির হাত ধরে, তার নাম ‘লা আভেন্তুরা’।  ইংরিজী তর্জমায় এর মানে দাঁড়ায় – The adventure!


আন্তোনিয়নি মানে এক যাত্রা, যা অভিযাত্রা নয়, বরং এক অনির্দেশের দিকে স্বততঃ গমন। স্বতত এক জার্নি বা নিরন্তর এক সরে সরে যাওয়ার নাম হয়ত আন্তনিয়নি। লা আভেন্তুরার কত আগেই তো আন্তনিওনি এসছিলেন আমার কাছে, তার ১৯৫৭-র ছবি ইল গ্রিদো নিয়ে। ইল গ্রিদো মানে – The Cry.  ক্রাই, মানে এক বিপুল কান্না। বুকের অতলান্ত থেকে উঠে আসা কোন এক অনির্দেশ চাওয়ার নামও তো ক্রাই। দা ক্রাই ছবির প্রধান পুরুষ যে আল্ডো, সে তো শুধু যাত্রা করে এক নারী থেকে ভিন্ন নারীতে। স্বাদবদল নয়, বরং স্থিতিই চেয়েছিল সে। আশ্রয় খুজেছিল ঘুরে ঘুরে, শেষ আশ্রয় পেতে আবার সে যখন ফিরে এল তার প্রথম নারীটির কাছে, ইর্মা যার নাম, সে কি তখন স্থিত ও তৃপ্ত ভিন্ন এক সংসারে? তাই আল্ডো সরে গেল আবার। কোথায়? মৃত্যুর কাছেই যেতে চেয়েছিল কি? নাকি মৃত্যু নিজেই এল তার কাছে savior হয়ে? এই এম্বিভালেন্স আশ্রয় খোঁজে ইর্মা-র শেষ কান্নার মধ্যে। 


লা আভেন্তুরাও এক সন্তত যাত্রার কথা বলে। সেই যাত্রার শরীর মেটাফর হয়তো মনিকা ভিত্তি। আনা আর সান্দ্রো, চলিত অর্থে স্থিত ও তৃপ্ত স্বামী-স্ত্রীই তো ছিল! তবে কেন সিসিলি দ্বীপের আনন্দভ্রমণের মাঝে হঠা স্বামীকে ছেড়ে নিরুদেশ হল আনা? কোথায় গেল সে? এ ছবি তার উত্তর খোজেনি। বরং আনাকে খুজেছে সান্দ্রো আর ক্লদিয়া, খুজতে খুজতে কখন, কোন রহস্যে, নিজেরাই জড়িয়ে গেছে প্রেমে। গৌণ হয়েছে আনাকে খুজে ফেরা। এই খোজার মধ্যে দিয়ে আন্তোনিয়নি আবার তো সেই এক অনির্দেশ যাত্রার দিকেই নিয়ে যান আমাদের। সেই যাত্রার অন্ধগলিতে ঘুরে ঘুরে, ক্লদিয়ার প্রতি প্রবল প্রেমাশক্ত হয়েও সান্দ্রো কেন গেল আবার এক ভিন্ন যৌন অভিজ্ঞ্যতার দিকে? কেন আবিষ্কৃত হল সে এই যৌনতার মধ্যে, আর কার চোখে নয়, ক্লদিয়ারই চোখে? কান্নায় ভেঙে পড়েছে ক্লদিয়া, আমার মনিকা ভিত্তি! 


লা আভেন্তুরা দিয়ে মনিকার সংগে যে জার্নি শুরু করেছিলেন আন্তোনিয়নি, তার সম্প্রপ্সার পরের দুটি ছবিতেও। লা নত্তে(The night ), আর লে’ক্লিসে(The Eclipse) ছবিতেও মনিকা আছেন তার আম্বিভালেন্স নিয়ে। লা নত্তের ভ্যালেন্টিনায় মনিকার ভুমিকা অনুঘটকের মতো। কিন্তূ The eclipse ছবিতে মনিকাই প্রধান। তার অবস্থান এ ছবিতে লা আভেন্তুরা ছবির এক রিভার্সাল। The eclipse, ভিত্তোরিয়ার আধারে মনিকার জার্নির ছবি। সেই জার্নিও অনিশেষ আর অনির্দেশের দিকে। ফ্রেম থেকে মনিকা ফ্রেমহীনতার দিকে যেতে চান বার বার। শেষ দিকে ভিত্তোরিয়া তার পুরুষটিকে বলছেন, আমার মনে হয়, আমি তোমাকে আর ভালোবাসবনা, অথবা আর ভালোবাসব। লা আভেন্তুরার মতো লা এক্লিসের শেষ দৃশ্যও অনিঃশেষ। পিয়েরো আর ভিত্তোরিয়া দুজনে দুজনকে আদরে ভরিয়ে দিয়ে, ফিরে আসবার কথা দিয়েও আর কেউ কার কাছে ফিরে আসেননা। পড়ে থাকে শুধু স্পেস, শন্য স্পেস, আর কিছু অবজেক্ট। এই একইসঙ্গে থাকা এবং না থাকার যে এম্বিভ্যালেন্স আন্তনিওনির যাত্রার প্রকল্প, তার শরীরী রূপ পায় মনিকার মধ্যে, বিশেষ করে তার চোখের অনির্দেশ্যতার মধ্যে। 


স্বপ্নের মতো মনিকা ভিত্তির চোখ। লা আভেন্তুরার যে যাত্রা, তার শেষ আসে এক স্বপ্নের মতো টেরেসের মাঝখানে। আমাদের নিয়ে যান আন্তোনিয়োনি শন্য এক স্পেস-এর মধ্যে। খোলা স্পেস-এর nothingness-এর মধ্যে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছে সান্দ্রো। মনিকা এগিয়ে এসেছেন নিঃশব্দে। হাত রেখেছেন সান্দ্রোর মাথায়। গাছের পাতা্রা কাপে। আর শুধু হাওয়া বয় শন শন! সেই মুহূর্তে দেখি মনিকা ভিত্তির চোখ। কী বলে সেই চোখ? সেই চোখ আমার বাল্যকালের কথা বলে। আমার মৃত্যুর কথাও। আমার এডভেঞ্চারে হারিয়ে যাওয়া তিমির কাকুর কথা বলে। কোথায় আছেন মনিকা? সেই মুহূর্তে? সান্দ্রোর কাছে, না দূরে?  অন্য কোথা, অন্য কোনখানে?। এইখানে দাঁড়িয়ে মনিকা আর মনিকা ভিত্তি নন। তিনি যেখানে আছেন, সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন অন্যখানে, অন্যকোথাও। এই অন্যকোথাও অবস্থানের নাম মনিকা। এই elsewhere বোধের নাম মনিকা ভিত্তি, যা আন্তোনিয়োনির সিনেমারও প্রাণভ্রমর। মনিকা ছাড়া লা আভেন্তুরা হয়না। মনিকা ছাড়া অন্তোনিয়নিও সম্পূর্ণ হননা। মনিকা আর তার চোখ আন্তোনিয়নির থাকা ও না থাকার দ্ব্যর্থকতার এক রূপক। মনিকা ভিত্তি আন্তোনিয়নির অনিঃশেষ গমনের এক সংহত শরীরী রূপ। মনিকা আর তার চোখ আমার বাল্যকালে ফিরে যাওয়া এক ব্যক্তিগত অনির্দেশের নিশিডাক।

গোড়ার কথা : মিতুল দত্ত

হাত-পা অসাড় হয়ে যাওয়া শীত আমাদের এই দিনকালে আর পড়ে না। হ্যাঁ, গরম পড়ে, সেটাও কেমন যেন জ্বালিয়েপুড়িয়ে। একটা বিচ্ছিরি ঘ্যানঘেনে বর্ষাকাল আসে এখন পৃথিবীতে, আর মনে পড়ে যায় সেই মাথায় গোঁত্তা খেতে খেতে শিল কুড়োনোর দিন। দাওয়া থেকে রোয়াক আর রোয়াক থেকে দাওয়া, ছপ্ ছপা ছপ্ কুমিরডাঙা খেলতে খেলতে, সন্ধে সাতটার মধ্যে বিছানায় নেতিয়ে পড়ার দিন।

আজকের এই শীতের সন্ধেবেলায়, ঘটিগরমের ঠোঙার একেবারে তলানি থেকে যা উঠে এল, তার দিকে ভালো করে তাকাতে না তাকাতেই, প্যাঁচার মতো মুখ করে সে আমাকে বলে, কী গো, ভুলে গেলে? অমনি আমার মনে পড়ে যায়, মাঠজোড়া ম্যারাপ বাঁধা, উঁচু স্টেজ, পর্দা নামানো, তার সামনে বাঁদিকে ব্যাটাছেলে আর ডানদিকে মহিলাদের জন্য পাতা হয়েছে চট। কার হাত ধরে হাঁটছি যেন, হাঁটছি না তো, লাফাচ্ছি, কত সামনে গিয়ে বসতে পারি। তারপর এক সময়, দুপাশ দিয়ে টেনে টেনে সরিয়ে দেওয়া হয় পর্দা, ঝং ঝং করে বাজনা বেজে ওঠে। শুরু হয়ে যায়, পুতুলনাচের ইতিকথা। একটু আগেও স্টেজের ধারে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল যে, গলা সরু করে সীতার রোলে সে কী কাঁদান কাঁদে! বছরের পর বছর, এইভাবেই তাদের সুতোর টানে, বেহুলা লখিন্দর, সাবিত্রী সত্যবান, সীতার বনবাস দেখে হাসতে-হাসতে কাঁদতে-কাঁদতে ঘরে ফিরেছে গ্রামবাংলার আপামর মানুষজন। ক্লোরোfeel-এর জন্য হাতে লিখে পাঠানো অতনুদার লেখাটা কম্পোজ করতে করতে খুলে গেল যেন, ছোট্টবেলার সেই পুতুলনাচের পর্দা। একটা শৈশব। হ্যাঁ, যে শৈশবে গাছের পাতারা সত্যি সত্যি সবুজ ছিল।

ভেবেছিলাম, সম্পাদকীয় লিখব না। থাক না, কী-ই বা লিখব, এককথাতেই তো বলে দিয়েছিলাম, যা আমি বলতে চাই। ক্লোরোfeel কী, ক্লোরোfeel কেন, খায় না মাথায় দেয়, এসব বোঝানো কি সত্যিই খুব জরুরি? কিন্তু যা হয়, কথা বলতে গেলে কথায় পেয়ে বসে। ভাবি, সবাইকে আর একবার অন্তত বুঝিয়ে দিই যে আমরা আসলে একটা রক্ত-সঞ্চালনের কথা বলতে এসেছি। কে কোথায় কীভাবে নিশ্বাস নিচ্ছেন, বাঁচিয়ে রাখছেন তার ভেতরে চারিয়ে যাওয়া অতিসূক্ষ্ম আর সেন্সিটিভ ডালপালাকে, তা সাহিত্যেরই হোক বা যেকোনও শিল্পমাধ্যমের, তাদের কথাই বলতে এসেছি আমরা। গোটা একটা জীবন খুঁটে খুঁটে, যে নির্যাসটুকুকে বাঁচিয়ে রাখার সাধনা করে যাচ্ছেন তারা, সেই নির্যাসই ছড়িযে পড়ুক আজ থেকে, ক্লোরোfeel-এর পাতায়।

রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়ের কথাপুরুষম নিয়ে একটি চিঠি : স্বপন রায়

"আমরা অমৃতবাজারে আমাদের ইংরেজি কবিতাগুলো ছাপছিলাম। সেই নব্বই-র গোড়ায়। পালা করে রোববার। মনে আছে তোর? আমার খুব ভাবনা ছিল আমাদের একটা অ্যান্থোলজি হবে। হল না। কিছুই হল না। কিছুই কি হল না! পুনশ্চ দিয়ে লিখি, এবার পশ্চিমবঙ্গে পচুর গণেশ পুজো  হয়েছে।" 

তোর এই বইটার অনেকগুলো প্রাপ্তির একটা হল এই উইট। আমি উইট না থাকা গদ্য পড়তে পারিনা আর তোর এই যৌগ কাজের ভেতরে উইট হল জলের সেলাই! 

"কথাপুরুষম" একদিকে যেমন প্রতিস্থাপিত কবিতায় ধনী সেরকমই বিস্থাপিত ভাবনাতেও! 'ব্যক্তিগত সুসমাচার' বা 'প্রিয় তাপস' যেমন আন্তরিক আর তথ্যানুসারী, 'রিপুবাসনা' সেরকম নয়। প্রথম দুটো বিস্থাপিত লেখার উদাহরণ আর শেষেরটি প্রতিস্থাপনার! 'দেওয়ালের এপার ওপার' আর' এক হলুদ বিকেলে লেখা' আবার এই দুটো ফর্মকেই সিন্থেসাইজ করেছে! ইটস আ টাফ জব বাট ইউ ডিড ইট! 


"যে কোন অপেক্ষার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা আছে। না থাকলে, থাকা উচিৎ। তাহলে, অপেক্ষা একটা ঘর। তার দেওয়ালগুলো অপেক্ষা, জানলাগুলো অপেক্ষা, দরজাগুলোও। খালি মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত যে অনুশীলিত তাকাচ্ছে বার বার, তাকে তুমি অপেক্ষা নামে ডেকো না। আসলে এসব কিছুই না, অপেক্ষা একটা বারান্দা, যে ঘরের ভেতর ঢুকতে পারবে না জেনেও একটা অনুমতির জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করে আছে।" আমি কবির বা লেখকের দক্ষতাকে দেখি তার কম্পোজ করার দক্ষতার নিরিখে! মিউজিকের মতোই গদ্য বা কবিতা কম্পোজ করতে হয়! বিন্যাস, শব্দপ্রয়োগ, ধ্বনিসাযুজ্য, ধ্বনিবৈপরীত্য, অন্তর্গত গমনাগমন এসবই একজন দক্ষ লিখিয়ে চাতুর্যের সঙ্গে ব্যবহার করে! "কথাপুরুষম"এ এর উদাহরণ প্রায় প্রতিটি লেখাতেই রয়েছে।


"Bridge that never gulfs... one diamond /এই তো তোমার কাছে যাবো বলে জলে দড়ি দিয়ে চাঁদ নামিয়েছি / pass two diamonds অসংখ্য তারা জেগে আছে তোমার ওড়নায় অথচ, জানে না কত মায়ায় আমায় জড়িয়ে নেবে তোমার তর্জনীতে তখনো লাল ছিটে / pass two no trumps / কাঠামোর মাপ গুণ টেনে নিয়ে যাবো / pass three hearts বল যদি four no trumps ছেড়ে যাবো আবাল্য এই মুগ্ধ কপিকল / pass pass pass" -- এই টেকনিক তোর ভাবনা থেকে আসায় নিজস্ব হয়েছে, আবার স্বাদুও। আমি কবিতা বা লেখায় নতুন চাই, দক্ষ কারিগরিও চাই! এই চাওয়াটা জানি খুবই বেশি চাওয়া। কারণ নিজের লেখায় সেসব আনতে গিয়ে বেদম হয়ে যাই! তুই অনেকটা পেরেছিস! 'মুখোস' এর নির্মাণে তাই অবাকই হয়েছি আমি, কারণ নাটকের চারিত্রকে অনাটকীয় করে তোলা ইজ টাফ, ভেরি টাফ। 


এই বইটা নিয়ে অনেক কথা বলার আছে। দেখা হলে হয়ত কথা হবে। তবে তোর লেখালিখির ক্ষেত্রে এই বইটা একটা মাইলস্টোন, নিরীক্ষাকে সইয়ে আনার যে দুরূহ কাজটি তুই করে ফেলেছিস এই বইটিতে তার জন্য এই আমি মাথায় হাত দিলাম আর নামিয়ে নিলাম আমার টুপি, হ্যাটস অফ! 


ভালবাসায়, স্বপনদা 



কথাপুরুষম
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় কৃত বয়ান সংগ্রহ
প্রকাশক : সৃষ্টিসুখ
প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০১৬
প্রচ্ছদ : লেখক
মূল্য : ৭৯ টাকা

বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর 'বেহুলা লখিন্দর পালা' - একটি অভিনব প্রয়াস : অতনু বর্মন

এই নাটকের চরিত্ররা সকলেই পুতুল। পুতুল সাজা মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই এরা কথা বলেনা, কোনওরকম অভিব্যক্তি, এমনকী চোখের পলকও পড়েনা এদের। নেপথ্যে চলে সংলাপ, গান, বাজনা। সাধারণত পুতুলনাটক বলতে আমরা যা বুঝি, অর্থাৎ সুরেশ দত্ত মশাইয়ের হাতে যা বিশ্বজয় করেছে এ নাটক তাও নয়। এ এক বিলুপ্ত অধ্যায়। গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির মঞ্চায়ণ।

একদা বাংলার গ্রামে গ্রামে মেলায় মেলায় পড়ত পুতুলনাচের তাঁবু। হুবহু তারই অনুকরণে বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী মঞ্চের ওপর তৈরি করে নেন আরও একটি মঞ্চ, যা থিয়েটারের নয়, পুতুলনাচের আসরের মঞ্চ। তারপর চোখের সামনে ঘটতে থাকে এক অভাবিত অতীতায়ন। দর্শক পৌঁছে যান বাংলার মেলার মাঠে। তাঁবুর ভেতর একদা যে বিনোদন ছিল একান্ত প্রাণের।

গ্রামীণ সেই পুতুলনাচের আসরে সবথেকে জনপ্রিয় ছিল মনসামঙ্গল। বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর মঞ্চসেনারা বেছে নিয়েছেন সেই অতিপরিচিত গল্পটিকেই। বেহুলা লখিন্দরের গল্প সকলেরই জানা। যা জানা ছিল না তা এই যে, এভাবেও মানুষকে পুতুল বানিয়ে প্রযোজনা সম্ভব। প্রায় ২০০ অভিনয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছনো এই নাটকটির নৃত্য নির্মাণ করেছেন অন্বেষা ঘোয়। অন্বেষা এই নাটকের মূল চরিত্র বেহুলার ভূমিকাটিও সযত্নে পালন করেছেন। নাটক নির্মাণ ও সামগ্রিক প্রয়োগের কাজটি করেছেন উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। সুর বেঁধেছেন অশোক দাস, সনৎ মুখোপাধ্যায় ও কার্তিক দাস বাউল।

প্রকৃতপক্ষে বাংলার পুতুলনাচ বহুধাবিস্তৃত। এখানে যে রীতিটিকে নেওয়া হয়েছে তা একান্তভাবেই সুতোয় বাঁধা পুতুলের নৃত্যভঙ্গিমা। সুতোর টানে পুতুলগুলোর কাঠ-কাঠ অঙ্গ সঞ্চালন যেমনটি হওয়া উচিত বা হত একদা, এই নাটকে তার অবিকল প্রতিরূপ দেখে নস্টালজিক হয়ে উঠবেই যেকোনও মধ্যবয়স্ক মন। আর এই প্রজন্ম, যারা কোনওদিনই দেখতে পাবে না সেই পুতুলনাচের আসর, তাদের কাছেও এ এক ঐতিহাসিক দলিল।

বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর বেহুলা লখিন্দর পালায় নানান পুতুলের ভূমিকায় সুতোর টানে নাচলেন যারা, তাদের মধ্যে রূপা সুতার, হর্ষিতা ঘোষ, সন্দীপ রায়, কাজি খাইরুল ইসলাম, কাজি মেহেবুব ইসলাম, তুফান কোনাররা অনবদ্য। এরাই আবার নেপথ্যে গিয়ে গানও গাইলেন। কাজল মুখার্জীর ঢোলের বোলে আর প্রিয়ব্রত চক্রবর্তীর হারমোনিয়ামের সুরের তালে আলোর মায়া ছড়ালেন খাইরুল ইসলাম। সমস্ত ব্যাপারটাই কিছু হল অন্তত তিরিশবছর পিছিয়ে গিয়ে। বেহুলা লখিন্দর পালা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল মোবাইল ফোন এখনও আসেনি, এখনও বিজয়ার পোস্টকার্ডে আসে শুভেচ্ছাবার্তা, সময়টা আশির দশকের শুরু অথবা তারও আগে সত্তরের মেঠো আলপথ ধরে মেলা দেখতে গিয়ে পুতুলনাচের আসর ফেরত মানুষ আমরা, হাতে যেন লেগে রয়েছে এখনও মেলার পাঁপড়ভাজার ছাঁচি তেল।

অ্যালব্রেখট ডুরারের জননী : অমিতাভ ভট্টাচার্য

এই ছবিটি বারবারা হপওয়ার্ডের। ১৬ শতকের বিখ্যাত জার্মান চিত্রকর ও খোদাইকার ডুরারের আঁকা তাঁর মায়ের প্রতিকৃতি, কাঠকয়লা দিয়ে আঁকা ঘোমটা সহ সেমিজ পরে মা— যিনি তাঁর বিস্ফারিত দৃষ্টিতে যেন দেখছেন অপারলোক। কিন্তু নির্ভয়, আর মর্ত্য আর অমর্ত্যলোকের মধ্যবর্তী গমনপথে দাঁড়িয়ে মা বারবারা।

ডুরার বহু প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন তাঁর মায়ের। যখন বৃদ্ধা বারবারা দীর্ঘ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী, এই সময়ে ডুরার দেখে চলেছিলেন তাঁর জননীকে আর রেখাচিত্রে ধরে রাখছিলেন কীভাবে তাঁর অশীতিপর জননী বুঝতে পারছেন এক নিঃশব্দ ও প্রশান্ত যন্ত্রণায় চলে যেতেই হবে তাঁকে মর্ত্যলোক ছেড়ে
— বেজে উঠবে শুধু চার্চের সুরেলা টুংটাং বাজনা। ডুরারের এই ছবিটি হয়ে উঠেছিল হাড়গিলে কন্ঠা, সেমিজের আড়ালে থাকা চুপসে যাওয়া বুক ও বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়ে যন্ত্রণার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নির্বাণ ও প্রশান্তির অভিলাষ।

‌অ্যালব্রেখট ডুরার জন্মেছিলেন এক দরিদ্র স্বর্ণকার পরিবারে। তীব্র মাতৃভক্ত অ্যালব্রেখট পিতামহের কাছে শিখেছিলেন কীভাবে কাঞ্চনপাতকে নিখুঁতভাবে খোদাই করে গহনা করে তোলা যায়। এই সুচারু কিরিকিরি খোদাই রেখাকে কীভাবে মূল্যবান করে তোলা যায়, তার কারিগরি ডুরারকে শিখিয়েছিলেন তাঁর পিতামহ হিরোনিমাস হপওয়ার্ড। স্যাকরা দাদু শিখিয়েছিলেন গহনা তৈরির আলঙ্কারিক চাতুরি, এই চাতুরিকে আত্মস্থ করেও ডুরার সেই পথে পা বাড়াননি, বরং কাঞ্চনপাতকে কীভাবে তার স্বর্ণালী চকচকানিকে হত্যা করে গহনা প্রস্তুত করা যায় তার প্রচেষ্টা করেছিলেন ডুরার। চেয়েছিলেন কীভাবে মানবিকভাবে অমার্জিত করে তোলা যায় রেখাকে যা উঠে আসবে কাঞ্চনপাতের খোদাইয়ের প্ররোচনায়।

ডুরারের কাছে ড্রইং, ড্রাইপয়েন্ট, কাঠখোদাই মাধ্যমই সহায়ক হয়ে উঠেছিল যন্ত্রণাময় শরীরকে মূর্ত করার
— যা সদর্থে হয়ে উঠবে এক শরীররূপ গহনা, জৈব, ক্ষয়, প্যাথোলজিক্যাল-যন্ত্রণাময়; অথচ সব মিলিয়ে এক ভিন্ন আলঙ্কারিক গুণ। এইজন্যই অ্যালব্রেখট আজও প্রাসঙ্গিক, প্রায় পাঁচশো বছর অতিক্রম করেও। ডুরার তাঁর ডায়েরিতে বলছেন, "আমার জননী, নিরন্তর অসহ্য প্রসব বেদনায় জন্ম দিয়েছেন অষ্টাদশ সন্তান, যার মধ্যে তেরোটির মৃত্যু ঘটেছে প্রসবান্তে, মা তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই গর্ভবতী থেকেছেন।" ডায়েরিতে ডুরার আরও লিখছেন, "আমার মা সতত গর্ভবতী ছিলেন তাঁর জীবনের বহু সময় ধরে, কিন্তু সদানন্দ থেকেছেন, তাই মায়ের এই যন্ত্রণাময় যাত্রা আমি সহ্য করতে পারছি না।" ডুরার কাঁদছেন বটে, কিন্তু মা-পুত্রের এই নিবিড় সম্পর্ক চারিয়ে যাচ্ছে তাঁর রেখাচিত্রের আখ্যানে। ডুরার নিজে ছিলেন না যখন বারবারা চলে যাচ্ছেন। ছিলেন তাঁর বাড়ির এক পরিচারক। ডুরার লিখছেন, "মা তার স্ব-ইচ্ছায় নির্বাসনে চলে গেলেন।" ডুরার ডুকরে কাঁদলেও মুষ্ঠিতে ধরে রেখেছেন চারকোল পেন্সিল। বারবারা চলে যাচ্ছেন এক সুগম আলোর পথ ধরে, সমস্ত সাংসারিক দায়িত্বের বন্ধন ছিন্ন করে। ডুরারের পণ্ডিত বন্ধু ফিলিপ অ্যারি বলেছেন মৃত্যু এক আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া— কেঁদোনা ডুরার। তিনি ফিলিপকে স্মরণ করছেন। তবুও কাঁদছেন। আবার ডায়েরিতে লিখছেন, "যাক মায়ের অগ্নিপরীক্ষা শেষ— যন্ত্রণাই সত্য, এ এক সেতু যা বিলাপময়, এ সেতু অন্যপাড়ে যাবার সুগম পথ।" মার্টিন লুথারও বলছেন, "আর কেঁদোনা ডুরার, এ সেতু সত্য ও সুগম।" তবুও ডুরার ডুকরে কাঁদেন। বারবারা চলে যাচ্ছেন, তাঁর অক্ষিগোলককে দেখছেন ডুরার। চারকোল পেন্সিল দিয়ে বুঝতে চাইছেন।

বারবারা দেখেছেন প্লেগ সহ ভিন্ন রোগ যাতনা সহ সীমাহীন দারিদ্রের চাপা কান্না। সহ্য করেছেন সামাজিক ব্যঙ্গ, কটুক্তি
— এমনকী কিঞ্চিত অত্যাচার। তথাপি তিনি বিদ্বেষহীন, শান্ত, অভিযোগহীন মাতৃকা। অথচ, তিনি ছিলেন অসম্ভব মৃত্যুভয়ে কম্পিত নারী, মৃত্যুর পূর্ব লগ্নে তিনি বলেছিলেন, "ইহলোক ছেড়ে যেতে ভয় নেই, যদি স্বয়ং পরমেশ্বর সামনে থাকেন উত্তরণের লগ্নে।" ডুরার তাঁর ডায়েরিতে আরও বলছেন, "কী আশ্চর্য, অন্তিম লগ্নে যখন দেখি জননী প্রায় মৃত্যুঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে প্রলাপ বকছেন ভয়ঙ্কর মৃত্যুভয়ে, জানিনা কেন, চাইছেন পবিত্র গঙ্গাজল তার মুখে কয়েক ফোঁটা মাত্র। এরপর দেখি উনি নির্বাক হয়ে গেলেন, ধীরে ধীরে তার দুচোখ শান্ত হয়ে গেল, দেখলাম কীভাবে তার হৃদয়ে আঁচড় কেটে তার বুকে থাবা বসাচ্ছে মৃত্যু, যেভাবে নৌকাতে নাবিক হাল টানে বৈতরণী পার করতে— কালো জল অতিক্রম করে। দেখলাম তার দুচোখ, কীভাবে হাঁপ টেনে বাঁচতে চাইছে, চাইছে তার নুরেমবার্গ শহরের বাড়িতে চলে যেতে। তার ঠোঁট যন্ত্রণাকে পাশ কাটিয়ে এক প্রশান্ত সমাহিত অবস্থায় চলে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় আমি কী করতে পারি প্রার্থনা করা ছাড়া?" এই অবস্থাকে প্রকাশ করা অসম্ভব— বলছেন ডুরার। "ঈশ্বরকে বলি, আমার জননীকে ক্ষমা করো...আর কিস্যু চাওয়ার নেই। হে ঈশ্বর মুক্তি দাও তাকে। জননীকে যেতেই হবে, যে জননী রেখে গেছেন অজস্র কৃতী সন্তানসন্ততি যার মধ্যে একজন স্বয়ং ক্ষমতাবান শিল্পী ডুরার।" ডুরার তাঁর জননীকে দেখছেন, বারবারা আছেন কী নিদারুণ এক কক্ষে— যিনি হয়তো চলে যাবেন ইহলোক ছেড়ে। সারা কক্ষে আমোদিত এক অপারলোকে চলে যাবার সুবাস। "এই সীমাহীন যন্ত্রণা ও সুবাস বড় সুতীব্র হে পরমেশ্বর", বলছেন ডুরার। বারবারা, এক সবুজ চাদরে ঢাকা বিছানায় শুয়ে আছেন— ভীষণ জোরে বাতাস নিতে চাইছেন বুকে, ডুরার সব দেখেছেন কিন্তু কিছু করবার নেই তাঁর, শুধু তাম্রপাত তক্ষণ বা কাঠখোদাইয়ে সব যন্ত্রণাকে মূর্ত করে তোলা ছাড়া। শিল্পীরা বড় অসহায় জাগতিক যন্ত্রণাকে সহ্য করার ক্ষেত্রে। বারবারা, হাঁফ টানছেন, সবুজ চাদরে ঢাকা তাঁর শরীর। ডুরার শুধু দেখে চলেন— চলে যাচ্ছেন মা, বেজে উঠছে তাঁর নুরেমবার্গ শহরের মন্দিরে সুরেলা ঘন্টাধ্বনি। আকাশে উড়ছেন মাতা মেরির মা অ্যানি। আকাশে মধু বৃষ্টি হচ্ছে অশ্রুধারার মতন।

মা বারবারা চলে যাচ্ছেন বহুদূরে আর সেই যাত্রা দেখে চলেছেন চিত্রকর ডুরার। চোখের জল টসটস করে গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। হে মাতা চলে যেওনা এভাবে। তবুও এই অসহনীয় যন্ত্রণার অভিঘাতে চিত্রকর ডুরার স্থিতধী হয়ে ভাবছেন কীভাবে এই যন্ত্রণাকে তাম্রপাত তক্ষণে ধরে রাখা যায়। "ককিয়ে কেঁদে লাভ নেই ডুরার", আকাশে ধ্বনিত হল পরমেশ্বরের বাণী। অবশেষে ওই সবুজ চাদরে ঢাকা মা সমাহিত হলেন। চিকিৎসকের আদেশে নার্স সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন বারবারার মুখ। সরকারি নিয়মে মা বারবারাকে নিয়ে যাওয়া হল ঠান্ডা কক্ষে যেখানে শুয়ে আছেন অনেক মৃতদেহরা। ডুরার বারবারাকে দেখলেন প্লাস্টিকে বাঁধা এক আবৃত শরীর
— কী শান্ত হয়ে শুয়ে আছেন মা, ডুরার আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন— মা, মাগো!

Friday, 6 January 2017

আখের খেতে ঢুকেছে এক চোর শেয়াল : জয়ন্ত ঘোষাল

বছর কয়েক আগে, তখন কর্মসূত্রে নাসিকে। টাউনশিপ আর ফ্যাক্টরি শহর থেকে প্রায় বাইশ কিমি দূরে— জায়গটার নাম ওঝার গাঁও। এখনও প্রধান সড়ক একটিই, ন্যাশানাল হাইওয়ের— যেটা ১৮০ কিমি দূরে মুম্বাইতে গিয়ে শেষ হচ্ছে। চারপাশ ঘিরে আঙুরখেত আর নতুন নতুন গজিয়ে ওঠা ওয়াইনারি। সেসময় ই-টেন্ডারিং-এর কারণে ইন্ট্রিগ্রেটেড মেটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের একটি অল্পবয়েসি মেয়ের সঙ্গে আলাপ। মেয়েটি সিস্টেমের লজিস্টিক দিকটা দেখে। ফলত নানা বিষয়ে কথা থেকে আলাপ জমে যায়। মেয়েটির বাবাও আমাদের সহকর্মী। এরা যদিও ওড়িশার লোক কিন্তু মেয়েটি জন্ম থেকেই টাউনশিপে আছে। লেখাপড়া সবই স্থানীয় ইস্কুল কলেজে, ফলত মারাঠিটা প্রায় মাতৃভাষার মতো বলে। শুধু কী কথা, মাঝে মাঝে দেখি অখেয়ালে খুব দ্রুতলয়ের কিছু গান গুনগুন করে। একদিন জানতে চাইলাম কিন্তু দেখলাম নানা কথায় মেয়েটি এড়িয়ে গেল। ভাবলাম লজ্জা পেয়েছে। আমিও বিষয়টা আর  উত্থাপন করলাম না। কিন্তু কানে রয়ে গেল অদ্ভুত এক দ্রুতলয়ের সুর। ব্যাপারটা ভুলেই গেছি। একদিন এক স্থানীয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণে গেছি মানমারে। মানমার ওঝার থেকে বেশ কিছুটা দূর এবং আরও একটু বেশি গাঁওটি— মানে গ্রাম্য। সেখানে বিয়েবাড়িটা একটা বড় সব্জিমান্ডির পাশে। যারা ওখানকার পেঁয়াজ বা আঙুরের মান্ডি দেখেছে তারা বুঝবে কত বিরাট হয় তার আয়তন। তা সেই মান্ডির পাশে দেখি মঞ্চ বাঁধা হয়েছে আর সন্ধে নামতে সেখানে মাইকে খুব জোরে জোরে ঘোষণা হচ্ছে। মারাঠিতে বলে কিছু বুঝছি কিছু বুঝছি না, কিন্তু এইটুকু বুঝলাম এখানে জলসা হবে। বিয়েবাড়ির মধ্যে ডুবে ছিলাম তাই আর ওদিকে খেয়াল করিনি। ফেরার সময় গাড়ির কাচ নামিয়ে দেখি মঞ্চের সামনে প্রচুর ভিড়। স্থানীয় সব বয়সী পুরুষ মহিলা এমনকি নাবালকেরাও ভিড় জমিয়েছে আর মঞ্চে ঢোলকের আওয়াজের সঙ্গে দারুণ ছন্দে নেচে যাচ্ছে একদল নর্তকী। তাদের পায়ের দ্রত ছন্দ আর কোমরের বিভঙ্গের সেই লোকনাচ দেখে না দাঁড়িয়ে উপায় নেই। এখানে মেয়েগুলো গাইছে না, শুধু নাচছে আর গান হচ্ছে বক্সে। মারাঠি নওয়াড়ি শাড়ি পড়া, চুলে সাদা ফুলের মালা জড়ানো আর পায়ে বাঁধা ধাতব ঘুঙুরের আওয়াজ— সব মিলে এক অন্যমাত্রার শ্রবণ ও দৃশ্যসুখ যা কখনও আগে শুনিনি বা দেখেনি— হয়তো শুনেছি হয়তো দেখেছি তবে অন্য রকম— কীরকম সেটা? ওই যে ওড়িয়া মেয়েটা গুনগুন করেছিল সেই সুরটা মনে পড়ে গেল এদের নাচের সঙ্গে বাজা গান শুনে আর এও মনে হল মুম্বাই সিনেমার করিওগ্রাফাররা বহু চটুল নাচে যেন এই নাচের ধাঁচটাকেই ব্যাবহার করে। আমার থতমত খাওয়া দেখে বন্ধু খান্ডারে বলে— আপন দিসত নাহি, হে লাভনি আহে— মানে আপনি দেখেননি আগে, এটা হল লাভনি। খান্ডারে কিছুটা চোখ কুঁচকে বলে চলে, আরে এইসব গাঁওটি মিনিংলেস গান দেখতে দাঁড়ালেন কেন। আমি বললাম দারুণ লাগছে। একটু দাঁড়ালে হয় না? খান্ডারে বলে এগুলো সব খারাপ মেয়েমানুষদের নাচ (ওর ভাষায় চিকনি-চামেলি), গ্রাম-মফস্বলের মারাঠিরা দেখলেও শহুরে শিক্ষিত মারাঠিরা এগুলোকে অশ্লীল প্রদর্শন ভাবে। বুঝলাম ওই মেয়েটি কেন আমার কাছে ওর ছান্দিক ভালোলাগাকে লুকিয়েছিল। পরের দিন পি এফ অফিসের প্রবীণ কর্মী গাঙ্গুরেকে জিজ্ঞাসা করলাম। জানতাম গাঙ্গুরে মাহার সম্প্রদায়ের এবং ধর্মে বৌদ্ধ। বাবা সাহেবের কারণে এরা অনেকেই এখন বৌদ্ধধর্মের বিন্দুবিসর্গ না জেনে ও বুঝেই বৌদ্ধ হলেও পূর্বের জাত-ধর্মের অনেককিছু, যেমন আমিষ ভক্ষণ থেকে লাভনির প্রতি টান ছাড়তে পারেনি। গাঙ্গুরের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি, দেখি খান্ডারে এল, আমরা একসাথেই ব্রেকফাস্ট করছিলাম।কথায় কথায় লাভনি ফিরে এল, ফিরে এল আরও কিছু কাঁচামিঠে কথা।বুঝলাম এই বৃন্দ-নাচের শরীরী উদ্দামতার সক্ষম প্রয়াস আর দ্ব্যর্থবোধক গানের কথার যে উদ্ভাস তার মৌতাত পেতে গেলে মনের আগলটুকু খুলতে হবে— কখনও সেই কথার কোনও মাথামুন্ডু নেই মনে হবে— আদপে যেন পাগলামি! 

“মাঝা উসালা লাগাল খোলা গা...”, কী এর মানে? মানে করে বলা খুব কঠিন— অনেক চেষ্টা করে বন্ধু খান্ডারে অনুবাদ করে বলল, এই গানের কথার অন্তর্নিহিত মানে হল—
“একটা শেয়াল আমার আখের খেতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে...।”
আহাঃ কী দারুণ করে বলা! যৌনতার এমন বিস্তার গ্রাম্য লোকগানের কথায়!

“ফড় সামভাল তুরিয়ালা গ আলা
তুজিয়া উসালা লেগাল কোলহা গ

মুল জমিন কাল সোন
তায়াত নামাঙ্কিত রুজল বিয়ান
তুজা উস ভাদলা জোমান
ধাটাধাটাত উভারি ধরলি
পিরাপিরাত সাখার ভরলি
নাহি ভইচ জাগা উরলি
রঙ পানাছা হিরভা ওলা
তুজিয়া উসালা...”

— সাবধান (আখের খেতে) চিত্ত চঞ্চল করা ফুল এসেছে
ব্যাটা শেয়াল আসতে পারে সেই লোভে
আমার আসলি জমিটা কালো সোনা
সেখানে ভাল বীজ ছড়ালে
(রসালো)পুরুষ্ট আখ বেরোবে
যে দেহের সবটা উদলা
কোথাও খালি নেই— সে আখের অঙ্গ অঙ্গ মিঠে
আর পাতাগুলো ঘন সবুজ
সাবধান চোর শেয়ালের থেকে।

খান্ডারে শহুরে মারাঠি, ওর কাছে এটা মিনিংলেস লাগে— আমি সেই সেয়ানা শয়তান চোর শেয়ালের মতো পুরুষ আর আখের খেতের অনুষঙ্গে নারীর মধুভাণ্ডের মেটাফরকে ভেবে খান্ডারেকে চেপে ধরি— আরও শোনাও। জোওয়ারের ভকরি, মানে পাঁপড়ের মতো মুচমুচে ইন্সট্যান্ট রুটি আর সবুজ মুগডালের রসা খেতে খেতে ও বলে এইসব গাঁওটি মানে গ্রাম্য কথার মানে বোঝানো খুব কঠিন— সুলোচনা চ্যবন খুব নাম করা শিল্পী ছিলেন, ওঁর কিছু লাভনি আছে আপানাকে দেব তবে কটার মানে ঠিকঠাক পারব জানিনা। তেমন গানের কথায় আমিও মজেছি। আমি ওদের লাভনি কথার মানে জিজ্ঞাসা করি, জিজ্ঞাসা করি এর ইতিহাস। যা জানলাম তার বিস্তারে যাওয়ার আগে কিছু বলি সংক্ষিপ্ত করে। লাভনি নামটা এসেছে লাবণ্য শব্দ থেকে। অনেক ভারতীয় নাচের জন্ম মন্দিরের চাতালে বা রাজসভায়। ধর্মীয় অনুষঙ্গ আর আধ্যাত্মিকতায় তাদের বিস্তার, কিন্তু লাভনিতে আছে শৃঙ্গার রসের মাতামাতি। মধ্যযুগের মারাঠাদের তখন দোর্দণ্ড প্রতাপ। লাওনি বা লাভনি শুরু হয়েছিল, রণক্লান্ত মারাঠা সৈনিকদের মনোরঞ্জনের জন্যে। লাভনি ছাড়াও আরও কিছু লোকনাচ ছিল পশ্চিম ও মধ্য ভারতের নানা অংশে। তার মধ্যে তামাশা বিশেষ উল্লেখ্য। মারাঠি লোকনাট্য তামাশার খোঁজ পাওয়া যায় সেই পেশোয়ারের যুগ থেকে। গ্রাম্য মারাঠি দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জন আর লোকশিক্ষার প্রয়োজনে গ্রামবাংলার যাত্রাপালার মতোই শত শত বছর ধরে তামশা হয়ে আসছে। শতাধিককাল প্রাচীন এই লোকনাট্যে লাভনি এক অত্যাবশক উপাদান। লাভনি মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণ মধ্যপ্রদেশের নয় শুধু, এমনকী কর্নাটক ও তামিলনাড়ুর কিছু অংশেও লাভনির চর্চা হত। যদিও আজ শোলাপুর কোলাপুরের নাচ বলেই লোকে চেনে আর চেনে নিছক যৌনতার ভঙ্গিসর্বস্ব এই তকমায়। আমি বেশ উদ্দীপ্ত হয়ে ওদের আরও কিছু গান তর্জমা করে বলতে বলি। কিন্তু আমাকে অবাক করে গাঙ্গুরে এক বাঙালির নাম বলল। তিনি আমার ডিপার্টমেন্টেই ছিলেন,  বছর দুয়েক আগে রিটায়ার করেছেন, যদিও এখন নাসিক শহরে বাড়ি করেছেন কিন্তু মাসে বার দুই কোম্পানির বাসে চেপে ত্রিশ কিমি দূর থেকে টাউনশিপের হাসপাতালে আসেন। এও জানলাম সেই প্রবীণ বাঙালিটির নাকি এইসব ব্যাপারে খুব ঝোঁক, নিয়মিত লেখালেখি করেন এবং সেটা অফিসের সবাই জানে। আমি হাতে চাঁদ পেলাম। কয়েকদিন পরে বাস্তবিক দেখা হল দেবনাথবাবুর সঙ্গে। আলাপ খুব দ্রুত সখ্যে পরিণত হল। যদিও প্রথমে লাভনির ব্যাপারে কিছু বলিনি। কিন্তু জানতে পারলাম মানুষটি গত চল্লিশ বছর ধরে মহারাষ্ট্রে আছেন আর ভাষাটার প্রেমে পড়ে গেছেন, ফলত মারাঠি সাহিত্য বাঙলায় অনুবাদ করার নেশা। সেটা এতদুর গড়িয়েছে যে সাহিত্য একাদেমি নামদেও কামলের দলিত চরিত্র নিয়ে লেখা ১৯৯৫ সালের একাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মারাঠি উপন্যাস ‘রাঘোয়া ভেল’ দেবনাথবাবুকে দিয়ে অনুবাদ করিয়েছেন আর তিনি এজন্য পুরস্কৃতও হয়েছেন। এসব জানার পর আমার এবার লাভনি নিয়ে কথা বলতে সাহস হল। অন্তত এই মানুষটি মধ্যবিত্তসুলভ মরালিটি কপচাবেন না। বাস্তবিকই তাই হল। বুঝলাম, লাভনির আজ বেশ দুর্দশা। এই গানের শব্দে নানা ‘ব্যভিচারের চিহ্ন’ একে সিভিল সোসাইটি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, ফলত এই গান ও নাচের শিল্প হিসেবে যে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। দেবনাথ বলছিলেন, আমিও জানিনা লাভনি অবজ্ঞাতেই তলিয়ে যাবে কিনা। নাকি মুম্বাই-এর আইটেম সঙ-এর লেজুরবৃত্তি করবে এই লোক-নাচগান! কারন এই গানে লজ্জাশরম না রেখেই যে বলে—
“কত আর সামলাব বুকের কাপড় এবারে বিয়ে করব গো— বিয়ে করবই
কত লোক দেখে পথে যেতে যেতে—
 (আর) মনে মনে কতই(মিচকি)হাসে
আঁচল কেবলই খসে পড়ে— কত আর সামলাব তাকে
 মনেতে আছে কেউ একজন— কেমনটা হয় যে বুকে
ঘুম আসে না রাতে মোটেই
স্বপ্নে দেখতে পাই কাকে যেন,  পথে চলতে ধাক্কা মারে—
মনেতে ঝড় ওঠে— মনের মত পুরুষ কোথা—
 (আমি) কোথায় থামবো গো
এবারে বিয়ে করতেই হয় গো—” 


(চলবে)