১।
মহীনের আগের কথা
মহীনের ঘোড়াগুলি এখনও আমার কাছে স্মৃতি-সম্মোহে দুরন্ত হয়ে থাকা
ছুটন্ত জানালার একটা দুরপাল্লার ট্রেন।
সত্তরের গোড়ার দিকের কথা। নকশাল আন্দোলনকে
গলা টিপে মেরে ফেলেছে মধ্যবিত্ত ও মধ্যস্বত্বভোগী বাঙালি, পুলিশ,
সি-আর-পি, কংগ্রেসি
আর অর্ধসিদ্ধ কমিউনিস্টরা।
সেই থম্ ধরা সময়ের পরবর্তীকালীন কিছু ছবি।
মহীনের ঘোড়াগুলির জন্মেরও আগের ঘটনা। মণিদা
জেল থেকে বেরিয়ে তখন জব্বলপুরে। কিম্বা ভোপালে।
আমি যাদবপুরে এঞ্জিনিয়ারিং
পড়ি। মণিদার পরের ভাই, বুলা মানে প্রদীপ, যেহেতু আমার আপন মামাতো
দাদা এরা, ফলে বুলা নয়, বুলাদা।
বুলাদার সঙ্গে ছিল আমার গলায় গলায়। বুলাদা বি-ই কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে
সুললিত বেকার জীবন কাটাচ্ছে।
আমাদের একটু দূর সম্পর্কের আর এক মামাতো
দাদা,
ধূর্জটি চট্টোপাধ্যায় তখন যাদবপুরেই মেক্যানিকাল এঞ্জিনিয়ারিং-এ লেকচারার। এমনিতে লেকচারারের সঙ্গে
ছাত্রদের কফি হাউসে বসে হা হা হিহি করার কথা নয়। কিন্তু সে আর শুনছে কে? ধূর্জটিদার
প্রথম(এবং একমাত্র) কাব্যগ্রন্থ, ‘কেন জলশব্দে প্ররোচিত
হলে মালবিকা’ তখন ছেপে বেরিয়ে গেছে। কবি ও পাঠক মহলে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিল সেই
কবিতাগুচ্ছ। সেই ধূর্জটিদা আর বুলাদার সঙ্গে যাদবপুর কফি হাউসে তখন আমার নিরন্তর
আড্ডা। মাঝে মাঝে ট্রেনে করে বেরিয়ে পড়া। হোটর স্টেশনে নেমে একটা সরু খালে শালতিতে
চড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা, গভীর রাতে শ্মশান-ভ্রমণ, সবই ঘটত। অনেক সময়েই সঙ্গে থাকত একটা বাঁশি, বা গিটার, পদ্য লেখার খাতা আর একটা ট্যাম্বুরিন।
[এর কিছু আগে, ১৯৬৯ নাগাদ, বিশুর বয়স্কাউটের জাম্বুরিতে গিয়ে এব্রাহামের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়।
দুজন টিন-এজ সাংগীতিক ছেলের মধ্যে সাঙ্ঘাতিক
বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। জাম্বুরি থেকে ফেরার পর এব্রাহাম বিশুদের পঞ্চাননতলার
বাড়িতে এসে মণিদাকে প্রথম দেখে। গুরু-শিষ্য সম্পর্কের সেখানেই সূত্রপাত। তখনও মণিদা জেলে যায় নি। বাপি আর ভানু
দুজনেই বেহালার ছেলে,
বীট্ল্স ভালোবাসে, মণিদার কাছে আসছে। গিটার
বাজিয়ে গান গাওয়া শিখছে। এরাই ভবিষ্যতে বিধুর বিহঙ্গের গান গাইবে।]
মণিদার নেতৃত্বে এই বুলা,
বিশু(মণিদার সব চেয়ে ছোট ভাই), এব্রাহাম, বাপি, ভানু আর আমি এই সাতজন মহীনের ঘোড়াগুলির
প্রথম অফিশিয়াল ঘোড়া হিসেবে চিহ্নিত হলাম। [ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল আরও অন্তত দু ডজন
ঘোড়া, যাদের উৎসাহ ও শ্রম ছাড়া এই ব্যান্ড নির্মাণ সম্ভব
হত না। কিন্তু তাদের নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা অন্যসময়ে হবে।]
আজ কিছু ছিন্ন স্মৃতি-কুসুম।
ধূর্জটিদা আর আমি হোটর স্টেশনের সামনে দিয়ে
যে খালপথটা বেরিয়ে গেছে অনন্তের দিকে, সেই জলপথে ঘটত আমাদের নিরুদ্দেশ যাত্রা।
হঠাৎ আবিষ্কার, তারপর বহুবার গেছি ওই পথে। সেই খালের
দুধার দিয়ে ঝুঁকে পডেছে প্রাচীন বৃক্ষরাজি আর বাঁশবন। দিনমানেও তখন সেই নাব্য
খালটিতে ঝুঁঝকো আঁধার, যা কোনওমতেই
পার্থিব নয়। সেই খালপথে শাল্তিতে বসে জলশব্দে প্ররোচিত হচ্ছি আর গানের জন্য কথা লিখছি আমি আর ধূর্জটিদা,
মিলিত প্রয়াসে। বুলাদা গিটারে
সুর বানাচ্ছে।
এই ভাবে গড়ে উঠল প্রি-মহীনের ঘোড়াগুলির একটি দুরপনেয় গান
:
হয়
যদি হোক, নামটি তাহার আল্লা বা গড-ই।
একটি
গানে আমরা তাকে ভুলতে রেডি
আমরা
ট্রায়ো,
তিনজন
ধূর্জটি-বুলা-রঞ্জন
ডু
রু রু ডু, ডু রু রু ডু, ডু রু রু ডু রু ডি
এক
সহস্র ফুলের মাঝে একটি মেলডি।।
এক
কাপ কফি, পাঁচ পয়সায় একটি সিগারেট
মহিলাদের
বুক ভাঙি না, বুক করি না ডেট—
একটা
গানের বদলে
সব
কিছু যাই ভুলে
ডু
রু রু ডু, ডু রু রু ডু, ডু রু রু ডু রু ডি
রাজার
শূন্য সিংহাসনে একটি মেলডি।।
হ্যাভারস্যাকে
শান্তি রাখি, দুঃখ পেছনে
কিট
ব্যাগেতে ভালোবাসা, ছুটি আপট্রেনে।
বিশ্বের
শ্রেষ্ঠ সোনাটা
সুরের
স্বপ্নের সোনাটা
ডু
রু রু ডু, ডু রু রু ডু, ডু রু রু ডু রু ডি
মেলার
ভিড়ে চম্কে দিয়ে যাই একটি মেলডি।
গানটা গাইতে গাইতেই আমরা আবার উঠে পড়েছি
সাবার্বান ট্রেনে। যাদবপুর স্টেশনে নেমে অল্প হেঁটেই কফি হাউস। সেখানে বসে নিচু
চাপা গলায় চলল সুরের মাজাঘষা, একটা দুটো শব্দের অদল-বদল। গানটা দাঁড়িয়ে গেল।
এর ঠিক এক বছরের মাথায়, ধূর্জটিদা তখন
বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে, প্রেম উথালপাথাল,
কাব্য-জ্বরের
বেভুল। ধূর্জটিদা আত্মহত্যা করে। সে্টা ছিল ১৯৭৫ সাল।
আমাদের জীবনকে চমকে দিয়ে চলে গেল ধূর্জটি
চট্টোপাধ্যায়।
এখনও
কষ্ট পাই।
আর একটা কষ্টও পাওনা ছিল। দুহাজার তিন সালে, মানে মাত্র তিরিশ বছর পরে আমরা কয়েকজন মিলে হোটর স্টেশনে গিয়ে
নামি। দেখি খালটা অদৃশ্য। ওখানকার জনতা, সকলেই সদ্য যুবক ও কিশোর-কিশোরী— তারা
জানেই না ওখানে ছিল একটি স্রোতস্বিনী, বহতা জলপথ। সেখানে শালতিতে চেপে পাঁচ সাত
মাইল দূরের গ্রামে গঞ্জে চলে যাওয়া যেত। এই তো, মাত্র সেদিন।
কী করে হঠাৎ করে হারিয়ে গেল একটা জলজ্যান্ত
নদী?
এবং
ঠিক কী
করে চলে গেল একটি আদ্যন্ত রোম্যান্টিক মানুষ—
ধূর্জটি?
২। গোড়ার দিকের কথা — আশমানি আলখাল্লার কাহিনি
দীপক মজুমদার ছিলেন আমাদের দরবেশ। সেই দরবেশের আলখাল্লায়
হাজার জোড়াতালি,
হরেক নকশা, কত না বাঘবন্ধনের ছক, পাশার ফোঁটা, রঙিন সুতোর কারুকাজ। দরবেশের গলায়
স্ফটিকের মালা, হাতে তসবি, ওষ্ঠে জীবনমরণের
গান। না না দরবেশ কোথায়? উনি তো মুশকিল আসান। না কি উনি
বরাবরের একজন পথিক— মাইলস্টোন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যার যাত্রাপথ এক জনপথ থেকে অন্য জনপথে—
তাঁর পায়ে অস্পষ্ট ঘুঙুর— তার কাঁধে একটি দুরূহ বিস্ময়াকীর্ণ ঝোলা— তাতে রেকর্ডার,
সাপবাঁশি, পিকোলো ফুলুট খমক সহ কত না
বাদ্যভাণ্ড। ওই বাঁশি বাজিয়েই উনি ছেলে ধরেছেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছুটে গেছি তার পিছু পিছু— কুশাগ্রে পদতল ছিঁড়েছে।
পুলিশে ছিঁড়েছে গোপনাঙ্গের চুল, বাবা মা পেছু ডাক ডেকেছে- ‘বয়ে যাসনি, ফিরে আয়’। আহ্লাদি
মেয়েরা আঁখির কোণে রহস্যের কানকি মেরে
বলেছে— ‘চ সিনেমায় যাই’। আমরা সিনেমা যাইনি, আমরা ওই দরবেশের পেছু পেছু গেছি শহর ছাড়িয়ে, মাঠ
মরূদ্যান পেরিয়ে আলৌকিকের দেশে— সুধাকুন্ডের সন্ধানে, জীবনের
সুলুক-সন্ধান জানতে।
১৯৭৫ সাল। দীপক মজুমদার তখন নাকতলায় বুদ্ধদেব বসুর বাড়ির
ঠিক উল্টোদিকে বাসা নিয়েছেন। সঙ্গে স্ত্রী ক্যারল। ওদের দুই সন্তান— জীয়ন ও কলমি
তখন দুগ্ধপোষ্য। আলাপ হয়েছিল মনীষা-দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে— ওরা তখন বু.ব-র ভাড়াটে। দীপক আমাদের গান শুনেছেন— ও হ্যাঁ, মহীনের ঘোড়াগুলির যদিও তখন
আঁতুড় কাটেনি, পাড়ার এক মজলিশে আমরা গান গেয়েছিলাম—
শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন দীপক(এক হিসেবে ওই পাড়াটা আমাদেরও পাড়া। মহীনের তিন ঘোড়া
গৌতম, বুলা, বিশু— তিন ভাই— নাকতলার বাসিন্দা। আর এক ঘোড়া আমি, ওদের পিসতুতো—
ঠিকানা বাঘাযতীন কিন্তু পড়ে থাকি নাকতলায়)।
দীপক আমাদের গান শুনে অদ্ভুত সব রোমহর্ষক মন্তব্য করলেন।
বললেন, জগঝম্পটা তোমাদের বাজাতে শিখে নেওয়া উচিত। শিঙে ফুঁকতেও জানা চাই। তোমাদের
গানের মধ্যে সেইসব ঈপ্সিত মুহূর্ত আছে যা খঞ্জনির খচড়ামিতে শিঞ্জিত হলে তুখোড়তর
হতে পারে। গানের ‘কথা’র প্রসঙ্গে আরও
বিচিত্র হলেন দীপক— “গ্রিসের পল্যু ভেরিয়াসে আর এখানকার
প্রকাশ কর্মকারের ইনফ্লুয়েন্স দেখলাম তোমাদের লিরিকস-এ। পল্যু ভেরিয়াসের একটা ছবি
ছিল— দি অটাম ইয়েলো— একটা শববহনকারী দল একটা ছোট্ট খুব ছোট্ট কফিন বয়ে নিয়ে চলেছে
কোনও অধরা সেমেটারির দিকে— আর তোমরা বলেছ, “সেখানে
চূর্ণফুল ঝরে তার কফিনে”— ভীষণ গ্রেকো মেডিটেরিয়ান বিয়োগ-বিলাসে
আচ্ছন্ন তোমাদের ওই চৈতন্য গ্রাফিক্স। “অজানা উড়ন্ত বস্তুর
পানে যেখানে তোমরা গাইছিলে— টিভির অ্যান্টেনা, যেন বা মাছের
কাঁটা বেড়ালের করে আয়োজন— এটা ভীষণভাবে প্রকাশ কর্মকার— শহরের মায়া-জঞ্জালের মধ্যে শীতল একটা নিভৃতি খোঁজার
অপচেষ্টা।”
আমরা সেদিন চটজলদি গান বানিয়ে বানিয়ে গাইছিলাম, মণিদার(গৌতম) হাতে ছিল
গিটার, বুলাদার হাতে বাঁশি আর এব্রাহামের ভায়োলিন, আমি বোধ হয় ট্যামবুরিন হাতে বসেছিলাম— গানের মধ্যে
একটা কথা ব্যবহার করলাম— ব্রহ্মশাপ।
করিস ক্যানে মনস্তাপ
পায়ে জড়ায় ব্রহ্মশাপ
ব্রহ্মশাপের দুধকলা
আধেক মারল সতীনাথ আর
বাকি আধেক উৎপলা।
সবাই আমোদ করছি। দীপক
দেবাশিসকে ডেকে বললেন— এর লাইনগুলো টুকে রাখা দরকার— এখানে আজ একইসঙ্গে বাংলা
গানের আদ্যশ্রাদ্ধ আর সাধভক্ষণের অনুষ্ঠান হচ্ছে।
দেবাশিস একটু ভুরু তুলতেই দীপক জানালেন, ব্রহ্মশাপের
হাঁচি বেদেয় চেনে। সাধভক্ষণ, আঁতুড়ঘর, হাতেখড়ি—
মহীনের ঘোড়াগুলির জন্মলগ্ন থেকে এভাবেই ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়তে থাকেন দীপক।
আমরা মাঝে মাঝে মচকানি দিতুম, বা
আলতো কামড়— দীপকদা, একটু ফকিরি ফক্সট্রট চালে বাঁধা বাউল
ব্লুজ শুনবেন নাকি? দীপক গম্ভীর হয়ে হয়তো বললেন— ফকিরি
ফক্কুড়ি? মন্দ কী? তা, রাতের দিকে এসো— বালীনিজ অপেরার একটা স্পুল হাতে এসেছে সেটাও ঐসঙ্গে
শোনা যাবে।
গভীর রাতে দীপক-নিবাসে বসত আমাদের বিশ্ব পরিক্রমা— সঙ্গীত
সাহিত্য সমাজ নৃতত্ত্ব থেকে নন্দনতত্ত্বের নব্যন্যায় কিছুই বাদ যেত না। মৃচ্ছকটিক
থেকে মেরিলিন মনরো— দীপক কথা বলতে শুরু করলে প্লাবন ডাকত— কলকাতা থেকে
কনস্তান্তিনোপল অবধি বিদ্যুচ্চমকে বিদারিত
হত। আমরা গম্ভীর হাতে গাঁজার কলকে চালাচালি করতুম। মদটদ তেমন না, রেস্তোরা বিলক্ষণ অভাব ছিল এই নয়া রামতনু লাহিড়ীর
তৎকালীন বঙ্গসমাজে।
নাকতলার খাল পেরোলেই উল্টোদিকে এক রহস্যময় জনবসতি কিংবা
তার প্রকৃষ্ট অভাব। রাত দু প্রহরে শেয়াল ডাকত, নিরাবয়ব মাতালেরা বাড়ি ফিরত—
বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে মাংসলোলুপ একটা বৃদ্ধ কুকুর বিলাপ গাইত। বু.ব তখন সদ্যপ্রয়াত,
দীপক কায়ক্লেশে তাঁর একটি অয়েল প্রতিকৃতি জোগাড় করেছিলেন— সম্ভবত
বিনামূল্যে, এবং সম্ভবত সেই কারণেই ছবিটির গঠন ও নির্মাণ
ঠিকঠাক ছিল না— ওটি একটি বাঁকামুখো নাটা বুদ্ধদেব বলে ভ্রম হত। একদিন বুলাদা ও আমি
ওই ছবিটিকে নিয়ে এক ঐক্ষণীয় গান বাঁধি র্যাপ ঢঙে— দীপক বুদ্ধদেবকে গুরু মানতেন,
ফলে উনি যারপরনাই উদ্বুদ্ধ ও বিচলিত হন— পরদিন থেকে ছবিটি ওই দেওয়াল
থেকে অপসৃত হয়েছিল।
আমাদের জীবন থেকে অপসৃত হয়েছিল যাবতীয় শুভাশুভ বোধ। আমরা
ক্রমশ আরও অস্থিচর্মসার,
শাস্ত্রলোলুপ জ্ঞানভিক্ষু, শ্মশানচারী,
দাম্ভিক ও দুরুপযোগী(unemployable অর্থে) হয়ে
উঠতে থাকি। যাদের চাকরিবাকরি ছিল, যেমন বুলা, বুলাই
একমাত্র, প্রায়োপবেশনের ভয়ে, র্যাশন
কার্ডটি কাটা যাবার ভয়ে যেমন আরশোলার নাদিসমৃদ্ধ গমের আধাকিলো নিতেই হত
সপ্তাহান্তে— বুলা অফিসের বুড়ি ছুঁয়ে আসত। আমি তখন কলেজে ক্লাস করা ছেড়ে
দিয়েছিলাম। মণিদা(মানে গৌতম) প্রথমদিকে যৎপরোনাস্তি দীপক-সন্দিগ্ধ পরে প্রবল
দীপক-অনুরাগী হয়ে পড়ে। ভাগ্যিস মণিদা চাকরিবাকরির পাট অনেক আগেই তুলে দিতে
পেরেছিল। আমাদের শ্মশান-নৃত্য আরও
বিভঙ্গিম,
দুপুরে চিত্রবাণী, গভীর রাতে নাকতলা
নৈমিষারণ্যে শুকদেব সহ নানা মুনি সমভিব্যাহারে মহাভারতের অমৃতকথা শ্রবণ। দীপক তখন
আমাদের অন্তরচেতনা কোঁচ মেরে মেরে আত্মাশোল বিদ্ধ করে করে ডাঙায় এনে পেড়ে ফেলছেন।
আমরা চিত্ত বুদবুদের বৈতরণী সাঁতরাতে খাবি খাচ্ছি, খাচ্ছি
শুকনো ডাঙায় আছাড়। আউল বাউল সাঁই দরবেশরা আসছেন, তাঁদের
দেহতত্ত্বে, তালাশে, ঝুমুরে, ভাওয়াইয়ায় দিবারাত্র একাকার করে আমরা লাট্টু।
ভোম ধরা লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে একসময় আমি
ব্যাঙ্গালোরে। অভিজাত চাকরি, মসৃণ শহর— মহীনের ঘোড়াগুলি ধীরে ধীরে
অপসৃয়মান অতীত। বছর দু-এক বাদে, ১৯৮২ সালে দীপক মজুমদারকে
ডেকে এনে দেওয়া হয় ব্যাঙ্গালোরের যাবতীয় নাট্টকর্মীদের একটি কর্মশালার নেতৃত্ব।
গ্রোটাউস্কি অনুপ্রাণিত দীপক এবার রন্ধ্রে, শোণিতে, মজ্জায় পুনঃপ্রবেশ করলেন। তিনমাস— অন্ধ্রপ্রদেশের পেনেকোন্ডায় যে
ওয়ার্কশপের সূচনা, তার পল্লবায়ন ও প্রতিস্থাপন ঘটে
ব্যাঙ্গালোরে। সত্তর জনকে নিয়ে প্রতিদিন দাঁত-নখ নিশিপাত, দিনযাপন,
সে বড় অ-সরল শরীরপাত। একমাত্র দীপকই জানেন কোন ভয়ঙ্কর জীবনপ্রপাতের
সন্ধানে আমাদের ছুটিয়ে মেরেছিলেন। আমরা বাস করতাম এক কমিউনে— সেখানে নাট্য উল্লাস, দর্শন
নিয়োজিত,
দন্তধাবন, আহার মৈথুন ও নিদ্রার সমস্ত পরীক্ষা
নিরীক্ষা ছিল সিলেবাসের বাইরের— এমনকী
নাট্যগুরু জেরসি গ্রোটাভস্কিও যা বাপের জন্মে শোনেননি এমনতর জীবনানুসন্ধানের
বিক্ষোভশালা হয়ে উঠেছিল দীপক নিয়ন্ত্রিত এই কমিউন— নামকরণ হয়েছিল প্রাক্সিস(Praxix)। প্রাক্সিস-এর
অর্থ হল অনুশীলন— অন্য অস্থিরতর জীবনযাপনের। দীপক শেখালেন, পাঁচপেচি
সাধারণ মানুষের মতো তৈল তণ্ডুলের অন্বেষণ নয়। আরও গভীর আরও অশালীন জীবনতত্ত্ব। কী
সেই তত্ত্ব? মাইরি আর কী? আমরা সেই
তত্ত্ব শিখলুম জীবন তন্ন তন্ন করে, দীপক ছাড়লেন জীবনের ছন্ন—
নিজেকে বিদ্ধ করতে করতে— ছিন্ন করতে করতে, শেষ হলেন জীবনের কাছে সামান্য ঝুঁকে পড়ে— সর্বাঙ্গে
বাঁধা ছিল আর-ডি-এক্স— প্রচণ্ড বিস্ফোরণে— সেই যা জীবনতত্ত্ব— তা আপনাদের হাতে
মোয়ার মতো তুলে দিই আর কী! যান মুখ ধুয়ে আসুন। হঃ
হঃ হঃ হঃ।
৩। প্রথম প্রকাশ — একটি স্মৃতিকাতরতা।
“কী বললি? মহীনের ঘোড়াগুলি? ঘাস
খাস? না চানা”?
আমি বললাম, ঘাস তো খাইই। কিন্তু
যেহেতু আমরা গরু নই, আমরা অতীতের জাবর কাটি না।
এই বলে অভিমানী ও অহঙ্কারী মুখে
বসে রইলুম।
সুনীত সেনগুপ্ত বললেন, আচ্ছা, ঠিক
আছে, অতীতমুখো হতে বলছি না তোদের। সলিল চৌধুরী শুনিস তো? আইপিটিএ? পল রোবসন? বব ডিলান?
জন লেনন?
নেহাৎ সুনীতদা আমাদের বন্ধু
নীলকমলের দাদা, আর বয়সে আমাদের চেয়ে অনেকটাই বড়ো, তার ওপরে আবার সত্যজিৎ রায়ের বন্ধু।
মুখের ওপর কথা বলা যায় না। বলা যায় না, আমরা নিধুবাবুও শুনি, পিঙ্ক ফ্লয়েডও শুনি।
সংক্ষেপে বললাম, শুনি বৈকি।
সুনীতদা বললেন, শুনবি। রক অ্যাণ্ড
রোল-এ পড়ে থাকিস না। রক্ শুনবি। অ্যাংস্ট-এর গান। দুনিয়া পাল্টে দেবার ঝাঁকুনি গান।
নইলে শুধু ঘাস খাবি আর গোবর করবি।
আমি চুপ করে রইলাম। আমাদের প্রথম
ডিস্ক বেরিয়েছে তখন। সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক। চারটি গানের ইপি। সুনীতদার
হাতে অ্যালবামের জ্যাকেট। ওঁদের রেডিওগ্রামে চাপানো আছে রেকর্ডটি। সুনীতদা বোতাম
টিপতেই রেকর্ড চেঞ্জারের স্টাইলাসটি আপনাআপনি গিয়ে ঘূর্ণায়মান ডিস্কের ওপর আলতো করে
এসে পড়ল। ঝম্ঝম করে বেজে উঠল আমাদের গাওয়া
“ভেসে আসে কলকাতা, কুয়াশা-তুলিতে
আঁকা শহরতলীর ভোর মনে পড়ে...”
আক্ষরিক অর্থেই কষ্টের গান। কাবলিওলার
কাছে থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করতে হয়েছে ডিস্কটা বের করার জন্য। সে নিত্য এসে হানা
দেয় আমাদের ‘আস্তাবলে’।
সুনীতদা বড়ো চাকুরে। বিজ্ঞাপনের
ঘাঁৎ ঘোঁৎ-ও জানেন। প্রচুর পড়াশুনো। কিন্তু গম্ভীর মানুষ। উনি চোখ বুঁজে চারটি গানই শুনলেন।
তারপর বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শুরু করলেন,
কল্পনা কর বসে আছিস ভিক্টোরিয়া
মেমোরিয়ালের অন্ধকার মাঠে। হঠাৎ খুরশব্দে চমকে উঠে দেখলি মাঠের একপ্রান্ত থেকে ছুটে
আসছে একদল অশ্ব। তাদের মুখে লাগাম নেই। অন্ধকারে শুধু ঘোড়াগুলোকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, কোনও পশ্চাদপট
নয়। অন্ধকারে শুধু স্বতঃপ্রভ অশ্ববৃন্দ। ক্রমে চোখের সামনে ফুটে উঠল একটি জানালা, যেখান থেকে
দেখা যাচ্ছে একটি বেলাভূমি। সেখানে সমুদ্র আছড়ে পড়ছে। শুনতে পাচ্ছিস তার গর্জন। প্রোজ্জ্বল
ঘোড়াগুলো এক মুহূর্তও না থেমে সেই বেলাভূমির ওপর দিয়ে সশব্দে ছুটে প্রান্তরের
অন্যপ্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে গেল। ক্রমশ মিলিয়ে গেল খুরশব্দ।
কন্টিনিউয়াস স্ক্রীন,
মাল্টি-প্রোজেক্টর, সংখ্যায় চব্বিশটাও হতে পারে, অডিও-ভিশ্যুয়াল এক্সপিরিয়েন্স।
এই ভাবেই হোক তোদের মহীনের
ঘোড়াগুলির শুরুয়াৎ। তারপর তোরা স্টেজে উঠবি, গেয়ে যাবি তোদের ক্রুদ্ধ কান্নার গান।
গিটার, ড্রাম্স, গুব্গুবি, দোতারা, খমক, ভায়োলিন, ট্রাম্পেট ট্রম্বোন নিয়ে তোরা সাতটা
ঘোড়া। নামগুলো টুকে রাখলাম, গৌতম, প্রদীপ, তাপস, তপেশ, তুই, বিশু আর এব্রাহাম, এই
তো? মাতিয়ে দিবি মানুষকে। না, না, আর দেরি করিস নি। দুমুঠো ঘাস খেয়ে বেরিয়ে পড়্।
সুনীতদার ভালো লেগেছে? এতটাই? উনি
তখন চল্লিশও ছোঁননি। চশমা পরেন না। তবু “চশমাটা কোথায় রাখলাম?” বলতে বলতে চেয়ার
ছেড়ে উঠে চলে গেলেন অন্য ঘরে। জানি আবেগাশ্রু মুছছেন।
সুনীতদার ভবিষ্যৎবাণী ফলে নি।
মহীনের ঘোড়াগুলি সেই তমসাচ্ছন্ন যুগে শ্রোতা পায় নি।
কিন্তু তাতে কী? এই পরশু সুনীতদা
ওঁর সল্ট লেকের বাড়ি থেকে ফোন করেছিলেন। ছিয়াত্তর বছরের যুবা। বললেন, জানিস, তোদের
রেকর্ডখানা আমার কাছে এখনও যত্ন করে রাখা আছে। ওটার দাম ছিল সাড়ে ন’ টাকা। দেয়া
হয়নি। কলকাতায় এলে বাড়িতে আসিস একবার। টাকাটা নিয়ে যাস।
আমার চশমারই দোষ। এবার নম্বর বদলাতে হবে।
৪। সেই সব দিন
আমাদের
রবীন্দ্রসদনে কনসার্ট। সারাদিন ধরে স্টেজ সাজাচ্ছি। স্টেজের পরিকল্পনাটি অযান্ত্রিক।
বাঁশ আর দড়িদড়া দিয়ে তৈরি ভারা। মাচানের স্টেজ। ১৯৭৭, নির্মীয়মান মহীনের ঘোড়াগুলি।
শর্মিষ্ঠা আর সঙ্গীতা সামুদ্রিক ঘোড়ার বড়ো বড়ো কাট আউট তৈরি করে যাচ্ছে। বেহালার পঞ্চাননতলা আর চৌরাস্তার
একদল যুবক হরিশ মুখার্জি রোডে, চেতলায়, কালীঘাটে চোঙা ফুঁকে এসেছে এক রাউণ্ড।
“মহীনের ঘোড়াগুলির মোহিনী গান। শুনতে আসুন রবীন্দ্রসদনে, আজ সন্ধে সাতটায়। ঠিক সাতটায়। এই গান শুনলে বাতব্যাধি সারে, মামলায় জিত হয়, ফেল
করা ছেলে পরীক্ষায় পাশ হয়, ব্যবসায়ে দেখা যায় লাভের মুখ, ফুটবলে জয়লাভ। মহীনের
ঘোড়াগুলির গান। নিজে শুনুন অন্যদের শোনান। সাত টাকার টিকিট আর বেশি পড়ে নেই কিন্তু!”
আবার বেরোবে ওরা। মহীনের ব্যাকবোন। খাওয়া-দাওয়াও হয়নি কারও। ব্রেগাঞ্জা থেকে পিয়ানোটা এসে পৌঁছনোর কথা, এখনও
আসে নি, গুব্গুবির জবাটা পাওয়া যাচ্ছে না, অডিয়েন্স হবে তো? হল ভরবে কি?
শর্মিষ্ঠা
ও সঙ্গীতা, চিত্রাংশু থেকে যথাক্রমে বুলাদা ও আমি। মণিদার মেজাজ তুঙ্গে। আমরা তেড়ে
বকুনি খাচ্ছি আসতে যেতে। তারই মধ্যে মেয়েদুটো মাথা ঠাণ্ডা রেখে কীভাবে কাজ করে
যাচ্ছে জানি না। অবশ্য বকুনি কিন্তু ওরা এক্কেবারেই খাচ্ছে না। ওরা দুটোতে আসলে
মন্ত্র জানে। মণিদাকে কীভাবে যেন বশ করে ফেলেছে ওরা। গত কয়েক রাত ধরেই, নিজেদের
বাড়িতে বসে গাদা গুচ্ছের পোস্টার হাতে এঁকে, লিখে তৈরি করে এনেছে শর্মিষ্ঠা আর
সংগীতা। আর আমাদের বেহালার বন্ধুরা সেগুলো শহরময় সাঁটতে বেরিয়ে পড়েছে। [প্রসঙ্গত
বলা দরকার, আজকাল মহীন নিয়ে প্রচুর হৈ চৈ হচ্ছে, বই বেরুচ্ছে, সিনেমা বানানো হচ্ছে
কিন্তু মহীনের ইতিহাসে অনেকেই অকীর্তিত থেকে গেছে। নেপথ্যের নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে
কথা বলার সময় এসেছে।]
কিন্তু,
না, আজ সে গল্প নয়। অন্য একটা ছোট্ট গল্প এখন। তো সেই কনসার্টের দিন, তখন বিরতির
সময়, আমরা পরের গানগুলোর জন্য রেডি হচ্ছি, মণিদার হাতের গিটারের তার ছিঁড়ে গেছে, সেটা পরানো হচ্ছে। মামিমা একটা আদা মিছরির পাঁচন বানিয়ে দিয়ে দিতেন সেটা একটা
ফ্লাস্কে থাকত, যারা গাইবে, তাদের গলাটা বশে রাখার জন্য ঐ গরম পাঁচন ছিল অব্যর্থ।
কে যেন ফ্লাস্কের ঢাকনাটা খুলে রেখে স্টেজে ঢুকে গিয়েছিল, পাঁচন জুড়িয়ে জল! ভানু
আদা-চা চাই বলে করে অস্থির, সময় আর দশ মিনিট হাতে, এমন সময়ে একজন কাঁচুমাচু মুখ,
মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক এসেছেন ব্যাকস্টেজে, দেখা করতে চাইছেন। বলছেন অনেক দূর থেকে
এসেছি, একটু কথা বলতাম। আপনারা নিজেরা গান বেঁধে গাইছেন কিনা, খুব ভালো লাগছে। আমি নিজেও একটু আধটু লিখি,
সুর দিই, শুনবেন?
কিন্তু
না আমারা কী করে শুনব। আমাদের হাতে তো একদম সময় নেই। কী ঝক্মারি রে বাবা!
ভদ্রলোক
করুণ মুখ করে চলে যাচ্ছেন। মণিদা ওঁকে ডাকলেন, আচ্ছা, শুনিয়ে যান।
মফঃস্বল
থেকে আসা লোক, বগলে ছাতাটাতাও ছিল বোধ হয়। মুহূর্তে উদ্ভাসিত হয়ে গেলেন। দু লাইন
গাইলেন নিজের লেখা গান। এখনও সুরটা কানে লেগে আছে। গানের কথা গেঁথে গেছে মনের মধ্যে—
কলকলিয়ে বৃষ্টি ঝরে, জ্যোছ্না ফোটে অল্প
কুড়িয়ে পাওয়া নাকছাবিটি বাঘের চোখের গল্প।
হারিয়ে গেছে পাতালটি
ভাসছে আলোয় চাতালটি—
দুপুর
রাতে ভুল বকছে চন্দ্রাহত মাতালটি।
চমকে গিয়েছিলাম আমরা সবাই। কী অসাধারণ
শ্রাব্যকাব্য। গাইবার ঢংটিও সোজাসাপটা। সোজা এফ শার্পে ধরলেন, যেমন বাউলরা ধরেন। আমাদের আত্মার আত্মীয় যেন
লোকটি।
ততক্ষণে স্টেজে ঢোকার ঘন্টা বেজে গেছে।
শো-এর পরে আর ওঁকে দেখি নি। হয়তো ট্রেন ধরবার তাড়া
ছিল, চলে গেছেন। কিন্তু কোথায়? কোথায় হারিয়ে গেলেন উনি? ওঁর সঙ্গে আর দেখা হয় নি
কোনওদিন।
কী ভাবছেন? কী লিখছেন উনি? বেঁচে আছেন তো?
খোঁজ চাই।
৫। বেলাশেষের গান — পরের প্রজন্মের গলায়
রঞ্জনকাকু,
আমি গতবছর তোমাদের(তোমাকে
আর বুলাকাকুকে) ফোন করেছিলাম চৈত্রের কাফন গানটি নিয়ে। তখন কাজের চাপে আর এগোতে
পারিনি। এ বছর আবার উদ্যোগ নিয়েছি গানটা রেকর্ড করার...
তবে সমস্যাটা হচ্ছে
মূল সুরটা। রেকর্ডিংটায় যে হারমনি পার্টটা গেয়েছে, তার(অডিও) লেভেল এত
উঁচুতে রাখা হয়েছে যে মূল সুরটা বোঝা দুষ্কর হয়ে উঠছে। যদি তোমাদের কারওর কাছে এর চেয়ে বেটার রেকর্ডিং থাকে কিম্বা কাউকে
দিয়ে এমনি একটা রাফ্ রেকর্ডিং করে পাঠাতে পারো তাহলে খুব সুবিধে হয় সুরটা চিনতে।
এই গান রচনার
ব্যাকগ্রাউণ্ডটা একবার শুনতে চাইছি।
ভালোবাসা।
অনুপম(রায়)
চৈত্রের কাফন (মহীনের ঘোড়াগুলি, ১৯৭৭)
যে গেছে বন মাঝে
চৈত্র বিকেলে
যে গেছে ছায়াপ্রাণ বনবীথি তলে
যে গেছে ছায়াপ্রাণ বনবীথি তলে
মন জানে অভিমানে
গেছে সে অবহেলে
যে গেছে অশ্রুময় বন অন্তরালে
যে গেছে অশ্রুময় বন অন্তরালে।
আকাশে কেঁপেছে
বাঁশিসুর
আঁচলে উড়েছে ময়ূর
চলে যাই বলেছিল চলে যাই
মহুলতরুর বাহু ছুঁয়ে
যে গেছে অশ্রুময় বন অন্তরালে
সে বুঝি শুয়ে আছে
চৈত্রের হলুদ বিকেলে
সেখানে চূর্ণ ফুল
ঝরে তার কাফনে।
---
প্রিয় অনুপম্ ,
কাফনে চূর্ণ ফুল
দাঁড়াও, এ গল্প বলতে গেলে
অনেকটা পিছিয়ে যেতে হবে। আসলে পুরো ছেলেবেলা জুড়েই ছিল আলি আকবরের আলাপ, রবিশঙ্করের ঝালা, আমীর খাঁয়ের বন্দিশ, সে যে অর্থেই ধরো না কেন। আর বেন্হার— প্রথম হলিউড। ছবি দেখছি কলকাতায় এসে গ্লোব সিনেমায়।
বিশাল পর্দা জুড়ে সম্পূর্ণ অলৌকিক রঙিন চিত্রগাথা। সেই প্রথম শুনছি অস্ত্রের ঝঞ্ঝনার
সঙ্গে, তুরঙ্গমের খুরশব্দের সঙ্গে মিশে যাওয়া ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রা।
গভীর খাদে বেজে চলা টিউবা আর ডাব্লবেস— ঢুকে পড়ছে শ্রবণযন্ত্র আর ধমনী বেয়ে সোজা হৃদ্পিণ্ডে। দূরে যেন পাহাড় ভাঙছে কেউ।
সেই থেকে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি প্রেম।
তার অনেক পরে এসেছে ব্রিটিশ পপ আর অ্যামেরিকান কান্ট্রি
মিউজিকের প্রতি ভালোলাগা।
কলেজে পড়ি। ‘টাই আ ইয়েলো রিবন
রাউন্ড দি ওল্ড ওক ট্রি’, গানটা তখন সদ্য বেরিয়েছে। অ্যামেরিকান পপ গ্রুপ ‘টোনি ওরল্যান্ডো অ্যান্ড ডন’-এর গাওয়া। শুনতে
পেয়েছি আমার বড়দার দৌলতে। বড়দা তখন ইংলন্ডের ক্র্যানফিল্ডে এরোনটিক্স
নিয়ে গবেষণারত। বড়দা বিবিসির টপ অভ্ দ্য পপ্স প্রোগ্রাম রেকর্ড করে পাঠাত সেখান থেকে। পোস্টে আসত ক্যাসেট-চিঠি। সেই প্রথম শোনা।
গানটা যেন জেল থেকে প্রেমিকাকে লেখা চিঠি।
খবর পেয়েছ নিশ্চয়ই যে আমি এবার ছাড়া পাচ্ছি।
তুমি কি এখনও আমাকে ভালোবাসো?
তাহলে আমাদের গ্রামের ঠিক বাইরে যে প্রাচীন ওক গাছটা
রাস্তা থেকেই দেখা যায়,
সেটায় একটা হলুদ ফিতে বেঁধে রেখো।
আমি বাস থেকে যদি সেই ফিতে দেখতে পাই, নেমে পড়ব।
নইলে, তোমার ছুটি।
আমি নামব না, চলে যাবো অন্য
কোথাও।
বাসের ড্রাইভারকে বললুম, দেখুনতো ভাই,
বুড়ো ওক গাছটি বেড় দিয়ে কোনো হলুদ রঙের ফিতে বাঁধা
আছে কিনা—
আমি মাথা নিচু করে বসে আছি, তাকাচ্ছি না।
বাসভর্তি লোক বলে ঊঠল, হলুদ রিবন?
সে তো একটা নয়, কেউ অন্তত একশোটা
রিবন
বেঁধে রেখেছে গাছটায়।
গানটা শুনে মন মেদুর হয়ে যেত। আমি মনশ্চক্ষে দেখতে
পেতুম, একটা কেন, বনের সবকটি গাছে
বাঁধা আছে অসংখ্য হলুদ রিবন। মেয়েটি পুরো অরণ্যটিকেই যেন হলুদ রিবনে সাজিয়ে রেখে প্রতীক্ষায়
আছে তার জেল খাটতে যাওয়া প্রেমিকের জন্য।
তারপর গানটি হারিয়েও যায়। কোন্ গহন অরণ্যে চলে গেল এই হলুদ ফিতের গান, জানতেই পারলাম না। তখন কত ঢেউ, কত উন্মাদনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নতুন নতুন জিনিস শিখছি। পড়াশুনোর জগতের
নয় সেসব বিষয়। শিখছি সাইকেডেলিক স্বপ্ন দেখা কাকে বলে, আর তার জন্য কী বড়ি খেতে হয়। বীট্লসের ‘ল্যুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ডস’-এর নানান্ ইন্টারপ্রিটেশন্স
শুনছি আর উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছি।
তারপর একদিন লিখে ফেললাম একটি হলুদ বিকেলের গান— চৈত্রের কাফন।
আর তৎক্ষণাৎ বুলাদার হাতে তৈরি হয়ে গেল সুর। মাঝখানে গিটারের একটা আরবী রিফ্ সমেত।
“আঁচলে উড়েছে ময়ুরে”র আঁচলটা তোমার রিঙ্কু-কাকিমার। চিত্রাংশুতে ঢুকছি আর ও বেরোচ্ছে। পরনে একটা বাটিকের সিল্ক। তার আঁচল জুড়ে মস্ত
একটা ময়ূর। উড়ন্ত ময়ূর সমেত রিঙ্কু রাজা বসন্ত রায় রোডের মোড়ে অদৃশ্য হল। কিন্তু ছবিটা
রয়েই গেল, একটু বিষাদের কুয়াশা মেখে।
আর একটা কথা :
মনে রেখো, গানটিতে মেয়েটি
কিন্তু থার্ড পারসন। “যে গেছে বনমাঝে” থেকে শুরু করে
“সে বুঝি শুয়ে আছে...” এবং “বলেছিল চলে যাই” সর্বত্রই। একটা রেকর্ডিং-এ ভুল গাওয়া আছে। “বলেছিলে চলে যাই”।
তোমার পংক্তিগুলোতে যদি সেইভাবে তৃতীয় পুরুষের (তৃতীয় মহিলা বলাটাই হয়তো ঠিক হবে) ব্যাপারটা আনতে
পারো, ভালো হয়।
ভালোবাসা।
রঞ্জনকাকু
অনুপমের নতুনতম অ্যালবাম ‘এবার
মরলে গাছ হবো’-তে চৈত্রের কাফন শোনা যাবে।
https://www.youtube.com/watch?v=MzievnVpS8M