[সাহিত্য, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
বৎস, আমি আসিয়াছি
জীবন হইতে। স্মৃতি হইতে। স্মৃতিকথা হইতে। মানুষের যৌথ জীবনের আনকোরা স্মরণ উৎসবই
আসলে সাহিত্য নয়কি?
‘কাউয়া কো কো, আমাগো বাড়িতে আজ শুভ নবান্ন।’ জীবনের
একেবারে শুরুর দিকে কলকাতা শহরের কাঠখোট্টা বাতাবরণেই ছাতে উঠে নবান্নর চাল-ফলমাখা
খাওয়াতে শিখিয়েছিলেন কাকেদের ডেকে, আমার দিদা। সেই সব দিদা, সেই সব মা-মাসিমারা,
যাঁরা নিজেদের জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছিলেন একেবারে প্রকৃতির বুকে, সেই ভরভরন্ত
গ্রামসমাজে। গ্রাম শহরের ভেতরে দুর্লঙ্ঘ্য দূরত্ব তৈরি হয়নি তখনও। নিজেদের গ্রামীণ, কৃষি-কৃষ্টির শিকড় তখনও জলজ্যান্ত। কোথাও কোনও বিচ্ছেদ নেই, আম্বিলিকাল কর্ড কাটা
মাতৃ-ছিন্নতার বোধ নেই।
তারপর আসে তাঁদের জীবনের ঝড়বিধ্বস্ত সময়গুলি। আসে স্বাধীনতার হাত ধরে
দেশভাগের ভয়াবহতা। আর কলকাতার বুকে আশ্রয় নেওয়া মনের ভেতর শুধু থেকে যায় প্রাচীন
সেই যুগবাহিত কৃষি ঐতিহ্য, জলজ ঐতিহ্য।
লোকে বলে, বাঙাল মাত্রেই তো “গোলাভরা ধান আসিল, পুকুরভরা মাছ আসিল!” তেমনই এক বাঙালের এই স্মৃতি আখ্যান দিয়েই আজকের
পাতা সাজিয়ে দিলাম। কেননা স্মৃতি মানুষের সংস্কৃতি। আত্মবিস্মৃত মানুষ পাষাণের মতো।
অলকানন্দা রায়ের জন্ম ১৯৪১ সাল, গাববাড়ি গ্রাম, বরিশাল। গ্রামের পাশে বড় বড় নদী। বর্ধিষ্ণু, শিক্ষিত কৃষক পরিবার। পড়াশুনা স্থানীয় স্কুলে। পরিবারে গান,বাজনা, নাটকের চল ছিল। নিজে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতেন। ম্যাট্রিকে বাংলায় জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ
নম্বর পেয়েছিলেন। বরিশাল শহরের বিখ্যাত ব্রজমোহন কলেজে আই এ পড়েন। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য হিন্দু মেয়েদের নিরাপত্তা সমস্যা হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালে বিবাহসূত্রে কলকাতায় চলে আসেন। এখানে এসেও লেখালিখির চর্চা রেখেছেন, সাংস্কৃতিক
কাজকর্মের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন।
- যশোধরা রায়চৌধুরী]
জীবন তো বহতা নদীর মতন। এক জায়গায় শুরু হয়ে কোথায় যে শেষ হয়— নদী তা
জানেনা। আমার জীবনটাও তো তাই— পূর্ববাংলার
বরিশাল জেলার এক অখ্যাত পল্লী থেকে শুরু হয়ে আজ কলকাতা মহানগরীর বুকে এসে স্তব্ধ
হয়ে আছে। কিন্তু সেই সবুজে ঘেরা আমার গ্রামটি, গ্রামের পাশ
দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটি এখনও তো রয়ে গেছে বুকের মধ্যে।
গ্রামবাংলায় একএকটি
ঋতু তার সৌন্দর্য সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত, বসন্ত— প্রতিটি ঋতুর যে রূপ সে তো চোখের সামনে দেখেছি, হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। নানা
অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই সেই ঋতুকে স্মরণ করেছি। ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ আর এই
কৃষিকে ঘিরেই প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে নানা অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানেরই একটি
অনবদ্য রূপ এই নবান্ন উৎসব। শরৎ বিদায় নিলে হেমন্তের আগমন...কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস। বাতাসে
হালকা শীতের আমেজ। জোয়ার-ভাঁটার দেশ আমাদের বরিশাল। সেখানের মাটিতে যেন সোনা ফলে। বর্ষার
জল কমে গিয়ে মাঠে মাঠে তখন সোনার রঙ ধরেছে ধানে। আর এই নতুন ধানেই হবে নবান্ন— নবান্ন
তো নয়, নবান্ন উৎসব। এ উৎসব শুধু পূর্ববাংলায় নয়— পুরো বাংলা জুড়ে এ উৎসব; ধনী, দরিদ্র— যার যেটুকু জমি আছে, সবাই নবান্ন পালন করে। এ যে মা লক্ষ্মীর দান। এ প্রসঙ্গেই
আসছি আমার দেশের বাড়ির নবান্নের কথায়।
অগ্রহায়ণ মাস শুরু
হতেই আমার জেঠিমা বাবাকে ডেকে বললেন, “ঠাউরপো, পঞ্জিকাটা দ্যাহো তো— কবে নবান্নের
দিন পড়েছে। জোগাড়-যন্তর তো সব করতে হবে।” বাড়িতে ঢাউস একখানা পি এম বাগচির পঞ্জিকা— চৈত্রের
শেষেই কলকাতা থেকে পার্শেলে এসে যায়। সারা বছর পঞ্জিকার দরকার— কবে ধান রোয়া হবে,
কে কোথায় যাবে, যাত্রা করার শুভক্ষণ, কবে পূর্ণিমা, অমাবস্যা— সবই এই পঞ্জিকা
দেখে। বাবা সন্ধ্যেবেলা জেঠিমাকে ডেকে বললেন, “মাইজ্যা বৌ, নবান্নের দিন তো আছে
দুই দিন— হের মধ্যে তোমাগো সুবিধা মতো দিন ঠিক কইরগা লও।”
এমনিতেই অগ্রহায়ণ
শুরু হলেই গ্রামের সব গৃহস্থ বাড়িতে বাড়িঘর লেপাপোঁছার কাজ শুরু হয়। উঠানে যেন কোথাও ফাটল বা ছোট গর্ত না থাকে। এজন্য গোবর-মাটি দিয়ে ভাল করে লেপে দেওয়া
হয়। সামনেই পৌষমাস— মাঠ থেকে সব ধান কেটে এনে উঠানেই পালা করে রাখা হবে। নবান্নের
দিন ঠিক হলেই তার একসপ্তাহ আগে মাঠ থেকে পাকা ধান কেটে আনা হবে। জেঠিমা আমাদের
কাজের লোক জিতেনদাকে বললেন, “জিতু, নাইয়া, পরিস্কার কাপড় পইরগা ধান কাইট্যা আনো”।
ধুয়ে, শুকানো হোগলা পাতার মাদুরে সেই নতুন পাকা ধান বিছিয়ে রোদে দেওয়া। দু-তিনদিন
রোদে দেবার পর সেই হাত দিয়ে আছড়ে আছড়ে মাড়াই করে, কুলোয় ঝেড়ে আবার রোদে দেওয়া হবে।
দুদিন পরে বৌদিরা শুদ্ধবস্ত্রে সেই ধান ঢেঁকিতে ভেনে চাল বের করে দেবে। আবার কুলোয় করে সেই চাল ভালো করে ঝেড়ে পরিস্কার করে ঝাঁকায় তুলে রেখে দেবে। নবান্নর সব কাজই
শুদ্ধবস্ত্রে করতে হয়।
নবান্নের আগের রাতে
সেই চাল উলু দিয়ে ভেজানো হল। ওদিকে পুরুষমানুষরা নারকেল ছাড়িয়ে ঢিবি করল। এককাঁদি
ডাবও কেটে রাখা হল। শুধু সকালবেলা মুখটা ফুটো করে জলটা ঢেলে দেওয়া। তিন রকম নারকেল
ছাড়ানো হল— ঝুনো, অল্প নরম শাঁসওয়ালা আর ফোপড়াওয়ালা। শিলনোড়া, দা, বঁটি, পিঁড়ি, থালা-গেলাস সব ধুয়ে পরিস্কার করে রাখা হল। অনেক সময় নতুন মাটির
হাঁড়ি, সরাও কিনে এনে থাকে। আসল কথা কোনওকিছুই যেন এঁটোকাঁটার সংস্পর্শে না আসে। আমার
বাপের বাড়ি বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন বলে আয়োজনটা বেশ বৃহদাকারে হত। লোকজনও
প্রচুর। জেঠিমার নির্দেশে রাতের খাওয়াটা বেশ তাড়াতাড়ি হয়ে যেত। আমরা ছোটরাও খেয়েদেয়ে
প্রবল উত্তেজনা নিয়ে শুয়ে পড়তাম।
“ছোটবউ, বড়বৌ, তোমরাও
হগলে খাইয়া কামকাজ সাইরা শুইয়া পড়। রাইত থাকতে ওঠতে হবে। কাইল পুরা দিন তোমাগো খাটনির দিন।” জেঠিমা বউদিদের নির্দেশ দিলেন। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের
নবান্নের দিন ডাকা হত কাকভোরে। মা, জেঠিমারা যে কখন উঠে কাজ শুরু করে দিতেন, আমরা
তা জানতেই পারতাম না। বড় বড় কোড়ানিতে নারকেল কুড়িয়ে স্তুপ করছে দুজনে— অন্য দুজন
সেই নারকেল আর চাল একসঙ্গে মিহি করে বেটে রাখছে। কেউ ডাবের মুখে ফুটো করে জল
ঢালছে। আমাদের ঘুম থেকে তুলে দিয়ে মা বললেন, “শিগগির উইঠ্যা পড়। হাতমুখ ধুইয়া, জামা
পেন্টুল ছাইড়া, ধোয়া জামা পইরা আয়— কাউয়ারে নবান্ন খাওন লাগবে না?” আমরা উঠে
ছুট্টে বড় পুকুরে মুখ ধুতে চলে গেলাম। এদিকে মা ও জেঠিমা চান সেরে নবান্ন তৈরির
প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। জেঠিমা অবশ্য ঠাকুর ঘরে— ঠাকুরের গোঁসাই-ভোগের
ব্যবস্থা করতে হবে। মা, বৌদিরা সব একসাথে হাত লাগিয়েছেন। আগেই ডাবের জলে বাতাসা ও
মিছরি ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিরাট এক হাঁড়ির মধ্যে স্তুপাকৃতি চাল-নারকেল বাটা দিয়ে
ডাবের জল, নারকেলের জল মিশিয়ে বড় হাতা দিয়ে কেউ নেড়ে চলেছে; সবটা ভাল করে মিশে
গেলে তার মধ্যে আদা বাটা মেশানো হল। এর কোনও মাপ নেই। সবই অভিজ্ঞতা ও
আন্দাজ। খুব একটা পাতলা নয়, আবার ঘনও নয়— তৈরি হল নবান্ন। এর উপর ছড়িয়ে দেওয়া হল
বড় বড় টুকরো করা ফোপড়া, কমলালেবুর কোয়া আর সেই নরম নরম নারকেলের টুকরো চামচ দিয়ে
তুলে তুলে মিশিয়ে দেওয়া হল। সব কিছু হবার পরে নতুন গামছা দিয়ে হাঁড়ির মুখটা ঢেকে
দেওয়া হল। উলু দিয়ে শুরু করা হয়েছিল এসব কাজ। আমরা আসতেই মা আমাদের
হাতে একখানা কলাপাতায় (মাইজ) হাতা ভরে নবান্ন দিলেন— উপরে ফোপড়া, বাতাসা, কলা দিয়ে বললেন, “যা, এবার বাগানে
গিয়া কাউয়ারে নবান্ন খাওয়াইয়া আয়”।
আমরা চললাম মুখে “আয়-আয়-কো-কো-নবান্ন
খাইয়া যা” বলতে বলতে। পুকুরপাড়ে, আমতলা, বাগানে আমরা কাককে আবাহন করতে ব্যস্ত। আমরা শুধু কেন, অন্য সব ঘরের ছেলেমেয়েরাও ‘আয়-আয়-কো-কো’ বলে বেরিয়ে পড়েছে। কান পাতলে
শোনা যায় এবাড়ি ওবাড়ি সব বাড়িতেই কাককৃষ্ণ পাখির আবাহন চলেছে। সারা বছর কাককে লোকে
দূর ছাই করে, কিন্তু নবান্নের দিনে কাক মহামান্য অতিথি। কাক নবান্ন না খেলে কারুর
নবান্ন খাওয়া চলবে না। অতএব ডেকে যাও কাককে। এ বাড়ি, সে বাড়ি— শুধু ‘আয় আয় কো কো’
কলরব। এত ডাকাডাকিতে কাক আর কতক্ষণ মুখ ফিরিয়ে থাকবে? আমরা পুকুর পাড়ের বাগানে
সযত্নে কলাপাতাটি রেখে দাঁড়িয়ে আছি কাকের প্রতীক্ষায়— এমন সময়ে শুনি পূবের ঘরের
ঊষা, সন্ধ্যার উল্লাসধ্বনি, “আমাগো নবান্ন খাইছে!” আমরা বড় বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম। মেজদার
ছেলে তো কান্না জুড়ে দিয়েছে, “ওরে কাউয়া, তুই আয়, মোগো নবান্ন খাইয়া যা। আয় না
ক্যান ওরা— ও পিসিমা...” ছোট্ট বিনুর কান্না আর আমাদের কাতর প্রার্থনায় কাক
বাবাজির দয়া হল। কলাপাতার উপরে বসেই সে কা-কা রবে জানান দিল সে এসেছে। আমাদের
দেশের কাক হল দাঁড়কাক। বড়সড় চেহারা,কাল কুচকুচে রঙ এবং জোরালো গলা। মাথাটা এদিক
ওদিক ঘুরিয়ে কাক নবান্নে মুখ দিল। “ওমা, ও জেডিমা— খাইছে,খাইছে” চিৎকার করতে করতে
বাড়ির মধ্যে চলে এলাম।
ততক্ষণে জেঠিমার
ঠাকুরঘরে ঠাকুরকে গোঁসাই নবান্ন নিবেদন করা হয়ে গেছে। গোঁসাই নবান্ন গোটা চাল, কলা,
নারকেল, সন্দেশ, বাতাসা দিয়ে বানানো হয়। মেয়েরা সবাই মন্দিরের সামনে উলু দিচ্ছে, বাবা-দাদারা
সকলে নমস্কার করছে। ওদিকে উঠানে সারি সারি পিঁড়ি পাতা হয়ে গেছে। সবাই এসে এবার বসে
পড়ল। বসা হয় বয়সানুসারে। প্রথমে মেজজ্যাঠামশাই, বাবা, তারপর একে একে দাদারা, লজিং
এ থাকা মাস্টারমশাই, দু একজন আত্মীয়পরিজন, জমি চাষ করে গেছে হালটিরা— তারা আর
সকলের শেষে আমরা খুদে বাহিনী। আমার বড় জ্যাঠামশাইর আলাদা সংসার— তাকে আমি দেখিনি বললেই
চলে; কিন্তু নবান্নের দিনে বড়পক্ষের দাদা, বৌদিরা, তাদের ছেলেমেয়েরা— সবাই এই
আনন্দানুষ্ঠানে যোগ দিত। বাড়িতে যেন আনন্দের হাট বসে যেত। আমাদের দেশে এক উঠানকে
ঘিরেই সব শরিকের বাড়ি। সকালবেলার অরুণ আলোয় ভরে গেছে গাছপালা— বাগান-পুকুর-ঘর। সেই
আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে সারি সারি মুখগুলো।
জেঠিমা এসে সকলের
হাতে একটু করে গোঁসাই নবান্ন দিলেন। উচ্চস্বরে সমবেত উলুধ্বনির মধ্যেই বউদিরা
সকলের সামনে থালা গেলাস বসিয়ে দিলেন। জেঠিমা যেহেতু কর্ত্রী— তাই উনিই প্রথম হাতা
ভরে নবান্ন দিলেন মেজজ্যাঠার পাতে। বাবা এসে জ্যাঠার সামনে বসে হাত পাতলেন— মেজজ্যাঠা
নিজে একফোঁটা মুখে দিয়ে ভাইর হাতে তুলে দিলেন একটু। এক এক করে সব দাদারাই তাই
করলেন। আমাদের আর সবুর সয় না...“আরে দ্যাও দ্যাও তড়াতড়ি, দেরি করলে খামু কোনসময়ে?” মহিলাদল হাতে হাতে নবান্ন পরিবেশন
করে যেতে লাগল— সঙ্গে মুড়ি, খই। পূবের ঘরের(বড় পক্ষ) বিধবা বড় বউ এক হাঁড়ি নবান্ন
নিয়ে হাজির। “অ ঠাউরমশাই— মোর বানানো নবান্নডা এবার খায়েন— দ্যাহেন, কেমন হইছে?”
আমাদের মেজদাদা খুব খাইয়ে মানুষ। সে সহাস্যে বলল, “আর দ্যাহনের কিছু নাই। দেতে
থাহো আর আমরা খাইতে থাহি।”
এই যে নবান্ন
পরিবেশনের আগে কিন্তু সকলের উদ্দেশে প্রণাম করা হয়। বড়রা তো খাচ্ছেই, আমরা ছোটরাও পিছিয়ে
নেই। কেউ বলে ফোপড়া দ্যাও, কেউ বলে মোরে কমলা দ্যাও। কী অতুলনীয় স্বাদ— মা লক্ষ্মীর
মহাপ্রসাদ। যারা কখনও খায়নি তারা বুঝবে না এর কী মধুর স্বাদ। চাল-নারকোল বেটে এই নবান্ন বরিশাল
ছাড়া অন্যান্য কোথাও হয় বলে আমার জানা নেই।
হাসি, গল্প, আনন্দে
খাবার পাট চুকতেই বড় বউ হাঁক পাড়েন, “ও মাইজগা ঠাইরেন, ছোট ঠাইরেন— আপনেরা এবার
বইয়া পড়েন দেহি”। এরপর মহিলাদের খাওয়ার পাট চুকলে মৌজ করে পান-টান খেয়ে সবাই ফের রান্নাঘরে।
দাদারা সব জাল নিয়ে বড় পুকুরে মাছ ধরতে নেমে গেল। পুকুরভর্তি মাছ।বরিশাল জেলায়
যেমন শস্য, তেমনই জলে-মাছে সমান। কত মাছ ধরা হল। বড় বড় বঁটি দিয়ে মাছ তরকারি কোটা
হচ্ছে। উলু দিয়ে বড় হাঁড়িতে বসানো হল নতুন চালের ভাত। কত
পদের রান্না যে সেদিন হল! এখনও মুখে লেগে আছে যেন আমার মায়ের হাতের রান্না কচুর
শাক, কুমড়ো-আলু দিয়ে রাঁধা লাবড়া, নারকোল দিয়ে ছোলার ডাল, মাছের মাথা দিয়ে মুগ
ডাল, কই মাছ দিয়ে মেটে আলুর তরকারি। পাতায় মাছভাজা। কত খাবে খাও। ওঃ বলতে ভুলে
গেছি, শেষপাতে সরপড়া দুধ আর বাড়ির খেজুর গুড়। খেতে খেতে বেলা গড়িয়ে যায়। গ্রামের
বুকে সন্ধ্যা নেমে আসে— ঘরে ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ দেখানো হল। রাতে রান্নার পাট নেই। বউদের
তাই মজলিস বসেছে। আমরা ছোটরা বিধ্বস্ত হয়ে গেছি— বিছানায় পড়েই ঘুম আর মনে মনে বাসি
নবান্ন খাবার আশা নিয়ে। রাতে কাঠের উনুনে ঢিমে আঁচে বড় কড়াইতে বাড়তি নবান্ন যা
থাকে বসিয়ে দেওয়া।অল্প অল্প জল শুকিয়ে সকালবেলা সে একেবারে পুডিং।
জীবনের এই প্রান্ত
বেলায় সেই সেদিনের সব মধুর স্মৃতিগুলো স্মরণ করে আনন্দে আপ্লুত হই। নাতি, নাতনিদের
গল্প বলি আর মনে মনে ফিরে যাই আমার শৈশব— কৈশোরের সেই আনন্দের হাটে।